জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব - ৮০
ভাদুর উৎস সন্ধানে
সূর্যকান্ত মাহাতো
জঙ্গলমহলের একটি অন্যতম আঞ্চলিক লোক উৎসব হল 'ভাদু উৎসব'। এই অঞ্চলের মানুষেরাই নাকি 'ভাদু উৎসবের' নামকরণ করেছেন 'ভাদু পূজা'।(ভাদু ও টুসু/ রামশঙ্কর চৌধুরী, পৃষ্ঠা- ২) এই পূজা আবার কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়। বরং একেবারেই তার বিপরীত। রামশঙ্করবাবু 'ভাদু পূজা' সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, "'পূজা' শব্দটি এখানে শ্রদ্ধার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ভাদু এখনও হিন্দুর তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর তালিকায় স্থান পাননি। ভাদু লৌকিক দেবীও নন।"(ভাদু ও টুসু, পৃষ্ঠা - ২) তার এমন কথা বলার কারণ হল, এই পূজায় ধূপ, চন্দন, পুষ্পাঞ্জলি, অর্ঘ্য, মন্ত্র, পুরোহিত, কিচ্ছু নেই। যা আছে তা হল কেবল গান আর গান। গানই হল এই উৎসবের প্রাণ। তবে গানগুলোতে কোথাও ভাদুকে 'দেবী' বলে বর্ণনা করা হয়নি।( ভাদু ও টুসু / রামশঙ্কর চৌধুরী, পৃষ্ঠা- ২)
তাহলে কে এই ভাদু? জঙ্গলমহলে কীভাবে এই উৎসব বা পূজার সূচনা হল? সত্যিই কি 'ভাদু' পুরুলিয়ার কাশীপুরের রাজকন্যা 'ভদ্রেশ্বরী'? এর উত্তর ও তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। এ সম্পর্কে বিশিষ্ট জনেদের মতপার্থক্য সেই জটিলতাকে আরো বাড়িয়ে দিল যেন।
যেমন প্রাচ্য বিদ্যার্ণব হিসাবে খ্যাত নগেন্দ্রনাথ বসু তার 'বিশ্বকোষ' গ্রন্থের ত্রয়োদশ খন্ডে 'ভাদু উৎসবকে' বাঁকুড়া ও মানভূম জেলার বাউরিদের উৎসব বলে উল্লেখ করেছেন। তার মতে 'ভাদু' নামটি এসেছে ভাদ্র মাসের সংক্রান্তি ও তার আগের দিন এই উৎসব সংঘটিত হয় বলে।(পৃষ্ঠা- ২২৮) তবে পুরুলিয়ার কাশীপুরের রাজপরিবারের সঙ্গে ভাদুর কাহিনী বা যোগসূত্রকে নগেন্দ্রনাথ বসু 'প্রবাদ' বলেই উল্লেখ করেছেন। 'প্রবাদ' মতে তিনি দুটি কাহিনীর কথা উল্লেখ করেছেন। একটি হল, পাঁচেটের এক রাজকন্যা বাউরি জাতির দুঃখে দুঃখিত হয়ে তাদের দারিদ্র্য মোচনে যতটা সম্ভব অর্থ সাহায্য করতেন। কিন্তু এক ভাদ্র মাসে তার অকাল মৃত্যু ঘটে। তাই বাউরিরা রাজকন্যার অকাল মৃত্যুতে দুঃখ পেয়ে তার দেবী মূর্তি গঠন করে ভাদ্র মাসে তার পূজা ও উৎসব শুরু করেন।(পৃষ্ঠা - ২২৮) অন্য মতটি হল, পাঁচেটের রানী কন্যা 'ভদ্রাবতী'-র অকাল মৃত্যুতে দুঃখ পেয়ে কন্যাকে স্মরণ করতেই তার একটি মূর্তি স্থাপন করেন। ভাদ্র মাসে মৃত্যু হয়েছিল বলে ঐ মাসেই তার স্মরনার্থে বাউরি প্রজারা ভাদু উৎসব করে থাকেন।( পৃষ্ঠা- ২২৯)
"বাংলার লোকসাহিত্য" গ্রন্থে ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য 'ভাদুগান' সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, আর্যেতর সমাজে এর উদ্ভব। কিন্তু হিন্দু পৌত্তলিকতার প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনি বলেই কাশীপুর রাজপরিবারের কাহিনী এবং প্রতিমা নির্মাণের রীতি যুক্ত হয়েছে। তবে রাজপরিবারের সঙ্গে প্রচলিত কাহিনীকে তিনি অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, "রাজপরিবারের কাহিনীটি যেমন অবান্তর, প্রতিমাটিও তেমনি বিশেষত্বহীন।"(বাংলার লোকসাহিত্য, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা - ৭৬)
আশুতোষবাবুও ভাদ্র মাস জুড়ে 'ভাদুগান' গীত হয় বলে এর নাম 'ভাদুগান' এমনটাই উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে 'রাজপরিবারের কাহিনী' এর সঙ্গে পরবর্তী কালে যুক্ত হয়েছে এবং একে স্মৃতিপূজার রূপ দিয়েছে।(বাংলার লোকসাহিত্য, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা - ৭৬) আশুবাবু রাজপরিবারের কাহিনীকে অস্বীকার করার পিছনে যে যুক্তিগুলো দিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হল, এই গান রাজপরিবারের কাহিনী গড়ে ওঠার অনেক আগে থেকেই নাকি প্রচলিত ছিল। তার মতে 'ভাদুগান' কেবল ব্যক্তিবিশেষের স্মৃতি সঙ্গীত নয়। বরং পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবনও গানে গানে ফুটে উঠেছে। সেইসঙ্গে এই অঞ্চলের কুমারী নারীদের সুখ, দুঃখ, আশা ও স্বপ্নও গান হয়ে উঠেছে।(পৃষ্ঠা - ৭৬)
তাহলে আশুবাবুর মত কী? তিনি বলেছেন, "ভাদু পূজা আদিবাসীর করম উৎসবেরই একটি হিন্দু সংস্করণ।"( পৃষ্ঠা - ৭৭) কিন্তু করম উৎসবের সঙ্গে ভাদু উৎসবের কোন যোগসূত্রই নেই। গবেষক 'বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত' আশুবাবুর এই মতের বিরোধিতা করে বলেন, করম উৎসব হল বৃক্ষ পূজা ও শস্য উৎসব। কিন্তু 'ভাদু পূজা' এ দুটির কোনটিই নয়।(ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য/ বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত, পৃষ্ঠা - ১০০)
নগেন্দ্রনাথ বসু ও আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতো যারা ভাদ্র মাসে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয় বলে 'ভাদু' নামকরণটি এসেছে বলে মনে করেন, তাদের ওই যুক্তিকে বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত অস্বীকার করেন। তার কারণ হিসেবে উনি বলেছেন, "ঝাড়খণ্ডে মাসের নামানুসারে পূজা উৎসবের নামকরণ করা হয়নি।"(ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য, পৃষ্ঠা -১০০)
বঙ্কিমবাবু আবার রাজপরিবারের কাহিনীকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে রাজা নীলমনি সিংহদেবের কন্যা 'ভদ্রেশ্বরী'-র অকাল মৃত্যু ঘটেছিল। সেই কন্যাকে কেন্দ্র করেই 'টুসু' পূজার অনুকরণে 'ভাদু' পূজার প্রচলন ঘটে। ( পৃষ্ঠা- ১০০) শুধু তাই নয়, একে 'ব্যক্তিকেন্দ্রিক পরব' বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন। কারণ ভাদু পূজার মধ্যে 'নায়ক পূজার' সব লক্ষণই নাকি বিদ্যমান।
বঙ্কিমবাবুর মতো যে কজন রাজপরিবারের কাহিনীকে স্বীকার করেছেন তাদের মধ্যে 'সুধীর কুমার করণ' অন্যতম একজন। "সীমান্ত বাংলার লোকযান" গ্রন্থে ভাদুকে তিনি 'রাজকন্যা' রূপেই উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে এই রাজকন্যাকে কেন্দ্র করেই টুসু পরবের অনুকরণে 'ভাদু'র প্রচলন ঘটে। তবে এই উৎসব কয়েকটি অঞ্চলের মধ্যেই যে সীমাবদ্ধ সে কথাও উনি বলেন।(সীমান্ত বাংলার লোকযান, পৃষ্ঠা- ১৪৩)
সুধীরবাবু 'ভাদু' নামটি যে রাজকন্যা 'ভদ্রেশ্বরী' বা 'ভাদুরানী' থেকেই এসেছে সে কথাও বলেছেন।(সীমান্ত বাংলার লোকযান, পৃষ্ঠা- ১৪৪)
আনন্দবাজার পত্রিকাও 'ভাদু' নামটি কাশীপুরের রাজা নীলমনি সিংহদেবের কন্যা 'ভাদ্রেশ্বরী' বা 'ভদ্রেশ্বরী' থেকেই এসেছে বলে উল্লেখ করেছেন। রাজকন্যার অকাল মৃত্যুর কারণ হিসেবে সেখানে বলা হয়েছে যে, রাজকন্যাকে বিয়ে করতে আসার সময় পাত্র ডাকাতের হাতে পড়ে মারা গেলে ভাদুও আত্মহত্যা করেন।(আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৬/১২/২০১৭) রাজকন্যার এই আত্মঘাতীর খবরটা অন্যদের লেখায় অনুপস্থিত। তারা কেবল অকাল মৃত্যুর কথাই উল্লেখ করেছেন।
🍂আর একটি কাহিনীর কথাও বলা হয়েছে। ভাদ্র মাসেই নাকি পঞ্চকোট ও ছাতনার রাজার মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। পঞ্চকোট রাজা সেই যুদ্ধে জয়ী হয়ে যে বিজয় উৎসব পালন করেছিলেন সেখান থেকেই ভাদু উৎসবের সূচনা ঘটে। তবে আনন্দবাজার পত্রিকা একটি বিষয়ে জোর দিয়েই বলেছেন যে, "শুরুর গল্প যাই হোক না কেন ভাদু উৎসবের উৎস কিন্তু সেই কাশীপুরের রাজবাড়িই।"(আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬/১২/২০১৭)
কিন্তু "পুরুলিয়া" গ্রন্থের লেখক 'তরুণদেব ভট্টাচার্য' আগের মতগুলোর সঙ্গে আবার একেবারেই সহমত নন। তিনি বরং কিছুটা বাস্তবধর্মী দিক দিয়ে 'ভাদু উৎসবকে' ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। 'পুরুলিয়া' গ্রন্থে তিনি অন্য যে সম্ভবনার কথাটি বলেছেন, তা হল 'ভাদোই ধান'। তিনি মনে করেন এই 'ভাদোই' ধানের নবান্ন উৎসব হল 'ভাদু উৎসব'। কারণ ভাদ্র মাসেই আউশ ধান পাকে। দামোদরের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের জমিগুলোতে আমনের চাষ হত না বলে ওই অঞ্চলের বাগদী ও বাউরিরা আউশের চাষ করতেন। করম, জাওয়া, ইঁদ, ছাতা পরবের মতো ভাদ্র মাস এমনিতেই একাধিক উৎসবের মাস। তাই 'ভাদোই' ধানের নবান্ন উৎসব থেকে ভাদু উৎসবের সূচনা না হওয়ার কিছু নয়। তাই তো তিনি জোরের সঙ্গেই বলেছেন, 'ভাদু' আউশ ধানের নবান্ন উৎসব।(পুরুলিয়া, পৃষ্ঠা - ২৫৯) রাজকন্যার কাহিনী এর পরে যুক্ত হয়েছিল।
তবে আসল বোমাটি ফাটালেন "ভাদু ও টুসু" গ্রন্থের লেখক রামশঙ্কর চৌধুরী। তিনি ভাদুকে কাশীপুরের 'রাজকন্যা' রূপে মানার কথাকে একেবারেই উড়িয়ে দিলেন। কারণ 'ভদ্রেশ্বরী' নামে কোন রাজকন্যা কাশীপুরের রাজপরিবারে নাকি ছিলই না। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন যে, উনি রাজপরিবারের বংশ তালিকা নিজের চোখে দেখেছিলেন, সেখানে 'ভদ্রেশ্বরী' নামে কোন রাজকন্যার অস্তিত্ব তিনি খুঁজে পাননি। এমনকি সেই রাজকন্যা যদি রাজার মানস কন্যাও হয়ে থাকেন তারও প্রমাণ তিনি পাননি।( টুসু ও ভাদু, পৃষ্ঠা - ৭) একই কথা তরুণদেব ভট্টাচার্যও বলেছেন। তিনিও বলেছেন, নীলমনি সিংহদেওয়ের তেরোটি পুত্রের পরিচয় পাওয়া যায়, কিন্তু কোন কন্যা সন্তানের হদিস পাওয়া যায়নি। আবার এটাও বলেছেন যে, কোন কন্যা সন্তান যদি থেকেও থাকে, তার নাম 'ভদ্রেশ্বরী' ছিল কিনা সেটাও জানা যায় না।(পুরুলিয়া, পৃষ্ঠা - ২৫৯)
তাহলে?
চলবে...
তথ্যসূত্র: ১) পুরুলিয়া/ তরুণদেব ভট্টাচার্য
২) বাংলার লোকসাহিত্য, ৩য় খণ্ড/ আশুতোষ ভট্টাচার্য
৩) ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য/ বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত
৪)সীমান্ত বাংলার লোকযান/ সুধীর কুমার করণ
৫) ভাদু ও টুসু/ রামশঙ্কর চৌধুরী
৬) আনন্দবাজার পত্রিকা
0 Comments