বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত
নির্মল বর্মন
আইনজীবী, প্রাবন্ধিক , সাহিত্যিক ও অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত অধুনা বাংলাদেশের বগুড়া জেলার ১৮৮৩ সালের ৩ রা মে জন্মগ্রহণ করেছিলেন । পৈতৃক নিবাস ছিল টাঙ্গাইলের বাঁশি। ১৯০৩ এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে এম.এ পাস করেন। ১৯০৬ সালে 'ল'পাস করে হাইকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেছিলেন। অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত "প্রাচীন ভারতের ব্যবহার এবং সমাজ নীতি" বিষয়ে গবেষণা করে ডি.এল (D.L)উপাধি পান। ১৯১৭ সালে ঢাকা আইন কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল হন ।একসময় তিনি "ডিন অফ দ্যা ফ্যাকাল্টি অফ ল" হয়েছিলেন! ১৯৫০ এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের "ঠাকুর আইন অধ্যাপক" হয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে প্রথম বিভাগীয় প্রধান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের প্রথম "প্রোভস্ট"! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক বক্তব্যে পরিষ্কার বলেছিলেন ' -- "বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের গুরুত্ব ও পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি" তিনিই প্রথম করেছিলেন। অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের উৎসাহ উদ্দীপনায় জগন্নাথ হলের বার্ষিক পত্রিকা "বাসন্তিকা" প্রকাশিত হয়েছিল। সাহিত্যিক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত'র প্রবন্ধ, গল্প ,নাটক ও উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক সময় যথেষ্ট আড়োলন ফেলেছিল। বর্তমানে প্রায় বিস্মৃতপ্রায় অবস্থার কাছাকাছি। তবুও 'বাংলা সাহিত্যে জীবনধর্মী উপন্যাস'র পথিকৃৎ নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। ১৯৬৪ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আইনজীবী, সাহিত্যিক ও অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত'র উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ গুলি হল ঃ-"The Evolution Of Law"
'প্রবন্ধ সমগ্র', এ ছাড়াও "শুভা" ১৯২০; "অগ্নি সংস্কার" ১৯১৯ ; "পাপের ছাপ"১৯২২ ; "লুপ্ত শিখা" ১৯৩০; "অভয়ের বিয়ে" ;" রূপের অভিশাপ" (গল্প গ্রন্থ) ; "ঠানদিদি" "মেঘনাদ" (গল্প গ্ৰন্থ)ও "আনন্দ মন্দির" (নাটক)।
লব্ধ প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী ও বিশিষ্ট প্রগতিশীল সাহিত্যিক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, তার নিজস্ব জীবনের অভিজ্ঞতা আইন সামাজিক রাষ্ট্রিক বিষয় সম্বন্ধে অর্জিত দৃষ্টিভঙ্গিকে বাস্তব রূপে উপস্থাপিত করেছেন তার রচনাবলীতে। অধ্যাপক সেনগুপ্ত'র প্রবন্ধ গুলিতে মননশীলতা পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ যুক্তি নিষ্ঠা ও উদার মনোবৃত্তির বিনির্মাণ আমরা দেখতে পাই। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত "লেবার পার্টি অফ ইন্ডিয়া"র প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ "সাহিত্যের ধর্ম" নিয়ে প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন ।তাঁর গঠনমুলক উত্তরে নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত লিখেন
"শরীর - ব্যাপার মাত্রই তো অপাঙক্তেয় নয়, কেননা চুম্বনের স্থান সাহিত্যে পাকা করিয়া দিয়াছেন বঙ্কিমচন্দ্র হইতে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সকল সাহিত্য সম্রাট। ----সে সীমানা কবি কোথায় টানিয়াছেন , তার বাহিরে কোন বই , ভিতরেই বা কোন বই তাহা নির্ণয় করিবার কোনও নির্দেশই কবি দেন নাই"।
🍂অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তর প্রবন্ধ সংগ্রহের বিখ্যাত যৌথ পরিবার প্রবন্ধটি বর্তমান সময় সমাজ যৌথ পরিবারের ভিত্তি অর্থনৈতিক , সামাজিক ও আইনগত দিক বেদের কাল থেকে সাম্প্রতিক কাল অবধি বিস্তৃত তথ্যের সমন্বয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ।তাঁর বক্তব্যের সূত্র গুলির কয়েকটি উজ্জ্বল উদ্ধার করা যেতে পারে----
১. "জাতির সামাজিক ও আর্থিক অবস্থা পরিবর্তনের সহিত পরিবারের গঠন ও আদর্শের নানা প্রভেদ দেশ - কালভেদে ঘটিয়াছে"।
২. "সেকালে আর্যেরা প্রায়ই ভাই - ভাই ঠাঁই ঠাঁই হইয়াই থাকিতেন"।
৩."পিতার সম্পত্তি পরম্পরাগতই হউক, আর স্বোপার্জিতই হউক, অতি প্রাচীনকাল তাহাতে যে পুত্রদিগের কোনো স্বত্ব ছিল না তাহা স্পষ্ট দেখা যায়"। তার পরবর্তীকালে পারিবারিক সম্পত্তিতে পুত্রাদির অধিকার সম্বন্ধে স্মৃতি গ্রন্থে নানাজাতীয় বাক্য দেখা যায়।"
৪."ভারতবর্ষে দেশভেদে ও কালভেদে পরিবারের আয়তন কখনও প্রসারিত কখনও সংকুচিত হইয়াছে"
অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত'র প্রাবন্ধিক যুক্তি ও তথ্যকে সজ্জিত করে সুললিত গদ্যে অর্থনৈতিক সামাজিক ও আইনগত দিক থেকে তার রচনা সামগ্রিককে হৃদয়গ্রাহী পাঠকূলকে উপহার দিয়েছেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জগতে ও আইনের দরবারে অসামান্য অবদানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জগন্নাথ হলের 'সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য' ভবনের কনফারেন্স কক্ষের নামকরণ করেছেন "অধ্যাপক ড. নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত কনফারেন্স কক্ষ"!
সাহিত্যিক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত' র আধুনিক বাংলা উপন্যাস জগতের গুরুত্ব সম্পর্কে ড.শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন----
"বর্তমানে তিনি কেবল কতকগুলি নূতন ইঙ্গিত ও পথ নির্দেশের কৃতিত্ব দাবি করিতে পারিবেন। তথাপি এই নূতন ধারা প্রবর্তনের দ্বারা তিনি যে উপন্যাসের সীমা প্রসারিত করিয়াছেন তাহা সর্বতোভাবে স্বীকার্য"।
আরও পড়ুন
1 Comments
অনেক অজানাকে জানলাম। ড. বর্মন তথা 'জলদর্চি' পরিবারকে জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন।
ReplyDelete