দেশান্তরী -২৯
হিল্লোল রায়
মিনিয়াপোলিশ পথে...
ডেট্রয়েটে বরফ দেখে মনটা বেশ খারাপই লাগছে। নর্থ ডাকোটায় না জানি কতখানি বরফ জমে আছে। আমার প্লেনখানা বেশ ফাঁকাই যাচ্ছে। এখনও রানওয়ের উপর স্নেহচুম্বন জানাচ্ছে। চারিদিকে বেশ মেঘলা হয়ে আছে। আমার ঘড়ি এখনও ফিলাডেলফিয়ার সময় দিচ্ছে। ঠিক ১০-১০ মিনিটে প্লেন আকাশে উঠে গেল। জানলা দিয়ে নীচের দৃশ্য দেখছি। চারিদিকে শুধু বরফ আর বরফ। বাইরে ঘন মেঘ, এখন কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। ভগবানের কাছে প্রার্থনা- যাত্রা যেন নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ হয়। প্লেন এখন বেশ কাঁপছে, দুলছে। যাত্রীরা কেউ কেউ তন্দ্রাচ্ছন্ন কেউ বা ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছেন। ফিলাডেলফিয়া থেকে ডেট্রয়েট আসার পথে ব্রেকফাস্ট দিয়েছে- স্যান্ডুইচ , মধু, কফি, লেবু। বেশ ভালই ছিল। এয়ারহোস্টেসরা নিজেদের মধ্যে বেশ জমাট গল্প জুড়ে নিয়েছে। কানের কটকটানি শুরু হয়েছে। হঠাত সূর্য্যের আলো দেখতে পাচ্ছি। মেঘের মধ্যে দিয়ে যেন ঠিকরে পড়ছে। একটা 'মিনি' ঘুম হয়ে গেল। ১০-৩৫ নাগাদ এয়ারহোস্টেস এসে 7-UP ড্রিংক্স দিয়ে গেল। ব্রেকফাস্টের পর পেটটা বেশ ভারী ভারী লাগছে। তাই 7-UP এর সদগতি করছি। মেঘের মধ্যে দিয়ে উড়ে চলেছি। সাদা নীল মেঘ এর উপর সূর্য্যের আলো এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করেছে। ডায়েরি লিখছি আপনমনে।
মিনিয়াপোলিশ অবতরণ, স্বল্প বিরতি যাত্রাপথের!!
ঘড়ি অনুযায়ী সকাল ১১-১৩ মিনিট। প্লেন ক্রমশঃই নীচুতে নামছে। নিচের কিছু কিছু দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি। মিনিয়াপোলিশের কাছাকাছি এসে পড়েছি। বাইরে সোনালী রোদ, নীল মেঘ। সময় এগিয়ে চলেছে। এয়ারহোস্টেসরাও ব্যস্ত হয়ে ছুটোছুটি করছে। মিনিয়াপোলিশ থেকে আমাকে আবার প্লেন বদল করতে হবে ফার্গো যাবার জন্য। প্লেন এখন বেশ উঁচু নীচু করছে। কানগুলো কটকট করছে। পাশের যাত্রীর কথাবার্ত্তা খুব আস্তে আস্তে শুনতে পাচ্ছি। ঘন মেঘের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার ফলে বাইরের কিছু দেখতে পাচ্ছি না ক্ষণিকের জন্য। মনে হচ্ছে শরীরটা হঠাত হাল্কা হয়ে গেল। প্লেন যেন সুস্থির হয়ে ভেসে রয়েছে। মনটা উসখুস করছে নামবার জন্য। বেলা ১১-৩৫ এ আমা্র প্লেন মিনিয়াপোলিশ বিমানবন্দরে পৌঁছাল। সুস্থির হল ১১-৪০ এ। এবার প্লেন বদলের পালা। গায়ে ওভারকোট চাপিয়ে গুটি গুটি এগুচ্ছি বেরুবার জন্য। চারিদিকে বরফ জমে সাদা হয়ে রয়েছে মিনিয়াপোলিশে।
মিনিয়াপোলিশে এসে ঘড়ির কাঁটা এক ঘন্টা পিছিয়ে দিলাম স্থানীয় সময় ১০-৪০ মিনিট । ফার্গো যাবার প্লেন ছাড়বে ১১-৫৫। অর্থাৎ হাতে ১ ঘন্টা ১৫ মিনিট সময় রয়েছে। সময় কাটাবার জন্য, মিনিয়াপোলিশ এয়ারপোর্টে ঘোরাঘুরি করছি। সুর্য্যের প্রখর কিরণ চোখে পড়ছে মাঝে মাঝে। টিকিট Endorse করে নিলাম ফ্লাইট ৩০৯ । কোনো সীট নম্বর এবার আর নেই। প্লেন পুরোপুরি ভর্তি।
🍂ফার্গো অভিমুখে, মিনিয়াপোলিশ ছেড়ে!!
ঘড়িতে এখন স্থানীয় সময় অনুযায়ী দুপুর ১২-০৭ মিনিট। যাত্রীরা সবাই সীট বেল্ট বেঁধে নিয়েছেন। এবারে প্লেন বেশ ছোট, BOEING 727. প্লেন রানওয়ের উপর চলতে শুরু করেছে। শিকাগো থেকে মিনিয়াপোলিশ আসার পথে দেরী করায় আমার প্লেন পাঁচ মিনিট দেরী করে ছাড়লো। কানের কটকট শুরু হয়েছে। প্লেন দুলছে, পাখা ওঠানামা করছে। এয়ারপোর্টের চারিদিকে শুধু বরফ আর বরফ। যতদূর দৃষ্টি যায় ততদূর দেখে নিচ্ছি। জানি না, আবার কবে এগুলো দেখতে পাবো। হাতের লেখা কেঁপে যাচ্ছে, প্লেন কাঁপছে বলে। বাইরে বেশ ঠান্ডা আছে। মিনিয়াপোলিশ আসতেই সেটা বেশ মালুম হল। ঠিক ১২-২০ মিনিটে প্লেন আকাশে উঠে গেল।
আমার এবা্র যাত্রা ফার্গো অভিমুখে। সীট নং 17 C। বেশ গতিবেগ নিয়েছে। বাইরে এত ঘন মেঘ যে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু মহিলা যাত্রী বেশ খোস গল্পে মত্ত। কেউ কেউ আবার তন্দ্রাচ্ছন্ন। বেশ ক্ষিদে পেয়েছে আমার। এয়ারহোস্টেসরা অবশ্য দৌ্ড়াদৌড়ি করছে। বুঝতে পারছি লাঞ্চ সার্ভ করবার জন্যই এদের এই ব্যস্ততা। লাঞ্চ এসে গেল ১২-৩৫ এ, মিনি লাঞ্চ। হ্যাম সান্ডউইচ আনুসঙ্গি্ক কিছু ফল, কোক। সাত মিনিটেই লাঞ্চ সেরে নিলাম। ঘোষণা এল আমরা ৩৩০০০ ফুট উঁচু দিয়ে চলেছি। ঘড়িতে এখন ১২-৪৫। ফার্গো পৌঁছাবে ১২-৪৭।
ফার্গো বিমানবন্দরে অবতরণ!!
মিনিয়াপোলিশ থেকে ছাড়তে দেরী করার দরুণ ফার্গো পৌঁছাতেও মিনিট পাঁচেক দেরী হবে। প্লেন এখন বেশ নীচুতে নেমে এসেছে। ফার্গোর হেক্টর এয়ারপোর্ট-এর কাছাকাছি তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট। এই ঠান্ডার জন্য আমার মনটা খারাপ কারণ আমি একটুও ঠান্ডা সহ্য করতে পারি না।
প্লেন আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ল্যান্ড করবে। গতিবেগ, ডানার উত্থানপতন এখন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। সীট বেল্ট বেঁধে নিয়েছি। যাত্রীরাও তৈরী হচ্ছেন নামবার জন্য। তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছি মাঝে মাঝে। এত খানি Journey করে শরীরটাও একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। মনে হয় এত বড় journey ভারতবর্ষ ত্যাগ করার পর আমেরিকায় এসে প্রথম। কারণ নর্থ ডাকোটা থেকে ফিলাডেলফিয়ার দূরত্ব প্রায় দু হাজার মাইলের কাছাকাছি। তারপর ফিলাডেলফিয়া থেকে নিউ জার্সি প্রায় ১২৫ মাইল। এখান থেকে Virginia Beach ও ফিলাডেলফিয়া প্রত্যাবর্ত্তন, ৮৮০ মাইল। আবার ফিলাডেলফিয়া থেকে নর্থ ডাকোটার ফার্গো অর্থাৎ ৪৮৮০ মাইল+ ফিলাডেলফিয়া থেকে হ্যারিসবার্গ প্রায় ১২০ মাইল, হ্যারিসবার্গ থেকে ফিলাডেলফিয়া প্রত্যাবর্ত্তন ১২০ মাইল অর্থাৎ ২৪০ মাইল। সব মিলিয়ে ৫০০০ মাইল । দুপুর ১-০২ মিনিটে ফার্গো রানওয়ে স্পর্শ করল, সুস্থির হল ১-০৫ মিনিটে। এয়াপোর্টে নেমে আমার বাড়ীওয়ালী মিসেস স্মিথ , ১৫২৬-১২ নং স্ট্রীট -নর্থ, ফার্গো -কে ফোন করতেই উনি গাড়ী নিয়ে হাজির। বাড়ী পৌঁছাই বেলা ১-৩০ নাগাদ। নির্বিঘ্নেই পৌঁছে গেলাম।
ফার্গো, নর্থ ডাকোটা থেকে ফার্গাস ফলস, মিনেসোটা!!
শুক্রবার
ফেব্রুয়ারি২৭, ১৯৭৬
ফার্গো, নর্থ ডাকোটা
ঘুম থেকে উঠতে আজ একটু দেরী হয়ে গেল। কারণটা খুবই স্বাভাবিক। গতকাল অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি ২৬, ১৯৭৬ আমার নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে “উইন্টার কোয়ার্টার” শেষ হয়েছে। আপাততঃ মার্চ ৭, ১৯৭৬ পর্যন্ত স্কুল ছুটী। এই দিন দশেকের অবকাশ যাপনের ক্ষণিক অংশ হল আমার আজকের কর্মসূচী। সমস্ত কিছু গুছিয়ে বাড়ী থেকে বেরিয়েছি ঠিক সাড়ে তিনটে নাগাদ। দুপুর বেলায় সূর্য্যকিরণ একটু প্রখর ছিল। ঝোড়ো হাওয়া বইছিল। নর্থ ডাকোটায় এখন শীতকাল । চারিদিকে বরফ জমে আছে। আমরা অর্থাৎ সমস্ত আন্তর্জতিক ছাত্রেরা সবাই মিলে জড়ো হয়েছি Old Main Buildingএ। সময়শসূচি অনুযায়ী আমরা বিকাল ৪-১৫ নাগাদ Old Main Building(North Dakota State University) থেকে যাত্রা করব। এই অবকাশ যাপনের হোতা হচ্ছেন International Student Embassy Of Fergus Falls, Minnesota. সমস্ত উৎসাহী Host Family আমাদের নিতে এসেছেন। সবাই মুখেই হাসি। পরীক্ষা শেষে অবকাশ যাপন ফার্গাস ফলসে যাত্রা।
ক্রমশ
0 Comments