হুলা পার্টি
সুমিত্রা মাহাত
ভরা জ্যোৎস্নায় কংসাবতী নদী মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে। নদীর কানে কানে জ্যোৎস্নার কিরণ যেন কোনো দূর দেশের দুঃখী রাজকুমারী র কাহিনী বর্ণনা করছে। দূর থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে আসছে। হাতির পালকে কংসাবতী নদী পার করে দিয়ে পরেশ ও নগেন নদীর পাড়ে খানিক জিরিয়ে নেয়। মশাল দুটো পাশে রাখে। জ্যোৎস্নারাত্রির মায়াবী আলো গায়ে মেখে বাস্তবতার দুর্নিবার স্রোতে গা ভাসায় দুই বন্ধু।
পাওনা বাকী আছে বেশ কিছু দিনের। বাইশ এর জুলাই-আগস্ট নাগাদ কিছু টাকা তারা পেয়েছে।
খৈনি মসকানা হলে , দুই বন্ধু ভাগ করে ঠোঁটে গুঁজেছে, এমন সময় টিম লিডার গণশা র ফোন," ওবে আয়,ফরেস্টারের গাড়ি আসিঞ গেএছেএ।"
" হঞঅ যাছি" উত্তর দেয় পরেশ। গ্রাম থেকে হাতি তাড়াতে তাড়াতে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দৌড়ে চলে এসেছে তারা , আর পায়ে হেঁটে ফিরবার যুগতা নায়। এখন বীট সাহেবের পাঠানো গাড়িতে করে গ্রামে ফিরে যাবে। যতগুলো টিম ততগুলো পিক আপ ভ্যান থাকে। এছাড়াও একটাতে থাকে বড়ো মোবিলের ড্রাম। বীট বাবু থাকেন তাঁর পার্সোনাল গাড়িতে। রাত্রি প্রায় দুটা বাজে। পরেশ বলে , " আইজ চঞাড়েই হঞইছে কি বল লগনা " আজ অপেক্ষাকৃত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছে তারা। তা না হলে বেপরোয়া হাতির পেছনে ছুটতে ছুটতে কখন যে রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে যায় টেরই পায় না।
জঙ্গলে হাতি এলেই বীট বাবু দলের হেড গণেশ কে ফোন করেন। গণেশ ফোন করে তার সাঙ্গোপাঙ্গ দের জড়ো করে। একেকটা দলে প্রায় পনেরো-ষোলো জন থাকে। হাতির অবস্থান জানার পর তারা দুপুর তিনটে-চারটে নাগাদ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। হাতির অভিমুখ নির্ধারণ করে। তারপর সেই অভিমুখে হাতির পাল কে পরিচালিত করে। সঙ্গে থাকে হুলা এবং আন্দাজ মতো মোবিল। লম্বা বাঁশের ডগায় যোগ চিহ্নের আকারে লোহার রড বাঁধা থাকে । লোহার রডে প্যাঁচানো থাকে বস্তা। বস্তাতে মোবিল মাখালেই দাউ দাউ করে জ্বলে হুলা। হুলা বীট অফিস থেকেই দেওয়া হয়। তবে প্রায় সকলের কাছেই টর্চ থাকে । মশালের সীমাবদ্ধ আলো দূর পর্যন্ত যায় না,তখন টর্চ ই ভরসা। রাস্তায় হুলা পুড়ে ফুরিয়ে গেলে পুনরায় বস্তা বাঁধতে হয়। দলের সঙ্গে মোবিল ভর্তি জারকিন বহন করে দুজন। পেছনে বহুদূরে থাকে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের গাড়ি।
নগেন ও পরেশ হুলা পার্টি র সদস্য। গণেশ তাদের হেড। বছরের নানা সময়ে বীট বাবুর সঙ্গে জঙ্গল রক্ষণাবেক্ষণ ও বন সংক্রান্ত নানান বিষয়ে মিটিং হয়। তখন উদ্যম,সাহস আছে এমন মানুষদের নিয়ে গঠিত হয় হাতি খেদানোর এই দল। বয়সের কোন সীমাবদ্ধতা নেই। কোন ট্রেনিং নিতে হয় না। প্রত্যেক সদস্যের দৈনিক মজুরী সাড়ে তিনশো থেকে পাঁচশো টাকা। আগে হাতির পাল চলে গেলে , মাস্টার রোল ফর্ম পূরণ করে পাওয়া যেত ক্যাশ টাকা। এখন অ্যাকাউন্টে টাকা ঢোকে। যে পরিমাণ পরিশ্রম হয়,সেই অনুযায়ী মূল্য জোটে না , হিসেব করলে দুপুর তিনটে থেকে মাঝ রাত্রি, ভোর অথবা সকাল পর্যন্ত আট থেকে চৌদ্দ ঘন্টা হয়। ঘন অন্ধকারের বুক চিরে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার, মশাল হাতে,পায়ে হেঁটে বা দৌড়ে পাড়ি দেওয়া মুখের কথা নয়। যতক্ষণ না হাতি এক বীট থেকে আরেক বীটে প্রবেশ করছে ততক্ষণ চলে এই ছুটে চলা। কর্মরত অবস্থায় এদের দেখলে নিশ্চিত ভাবে,ম্যারাথন দৌড় কিম্বা অলিম্পিকে মশাল হাতে দৌড়রত মানুষটির কথা মনে পড়ে যাবে। কোন পরিচয় পত্র নেই বলে বিপদে পড়লে হ্যাপা পোহাতে হয়। ট্রেনিং না থাকলেও হাতির পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে, শিয়াড়চাঁদা,খরিসের ফোঁস, বনশুয়োরের গুতো খেয়ে , এইসব দামাল ছেলের দল,আপনা আপনিই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যায়। নাবালক ও বয়স্করাও থাকে। তারা সংখ্যায় কম। কেউ কেউ মায়ে তাড়ানো,বাপে খেদানো হলেও জীবনের দাম তো সকলেরই সমান।
সাধারণত যে বনাঞ্চলে হাতির বসবাস বা সাময়িক ভাবে অবস্থান করে অথবা যাতায়াত করে,তার সংলগ্ন গ্রাম গুলি থেকে সাহসী মানুষদের নিয়ে গঠিত হয় হুলা পার্টি। জঙ্গলে হাতি অবস্থান করলে, সদস্য রা দুপুর তিন-চারটে নাগাদ যাত্রা শুরু করে। পাঁচ, দশ থেকে শুরু করে চল্লিশ- পঞ্চাশ কিলোমিটার যেতে হয় কখনও কখনও,পায়ে হেঁটে বা দৌড়ে। নির্দিষ্ট টার্গেট অনুযায়ী হাতি কে এক বীট থেকে অন্য বীট অভিমুখে গমন করানো খুব সহজ কাজ নয়। লোকালয়ে থাকতে থাকতে হাতিও এখন বেয়াড়া। হঠাৎ পিছন ফিরে আক্রমণ করে। তখন সদস্যদের পিছিয়ে আসার নিয়ম নেই। আরও দ্বিগুণ বেগে এগিয়ে যেতে হয়। অনুমান, এতে হাতি ভয় পেয়ে নির্দিষ্ট গতিপথে যেতে বাধ্য হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়,অনেক সময় তা হয় না। সদস্যদের অনুমান ভ্রান্ত প্রমাণ করে একটার জায়গায় তিনটা হাতি যখন আক্রমণ করতে ছুটে আসে,তখন হাতির প্রবল শক্তি ও রোষানলের কাছে আত্মাহূতি দেয় অসহায় মানুষ।
পরেশ , নগেন সহ অন্যান্যরা গাড়ি করে ভালোয় ভালোয় ঘরে ফিরে আসে। সাধারণত কুড়মী,সাঁওতাল,মুন্ডা,লোধা,ভূমিজ,বাগাল ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষেরা এতে যুক্ত থাকে। হাতির হাত থেকে গ্রাম কে বাঁচানো ও হল,আর কিছু রোজগার ও হোল। একবার তো সম্পূর্ণ একটি গ্রাম হাতির কবলে পড়েছিল। হাতি নষ্ট করে দিয়েছিল পনেরো-ষোল টা ঘর। ধান জমি বা ঘরবাড়ির ক্ষয়ক্ষতি হলে কিছু ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়। পাঁচশো-সাতশো-হাজার। তার জন্য অবশ্য অফিসার এসে এনকোয়ারি করে যান। হাতির উপদ্রব বেড়েই চলেছে। দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর পরিমাণ বাড়ায় উপযুক্ত ট্রেনিং, পরিচয়পত্র, বীমা,ন্যায্য মজুরী ছাড়া হুলা পার্টি ও গরজ দেখাচ্ছে।
এযাবৎ কতগুলো প্রাণী পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়েছে,তার সঠিক হিসেব একমাত্র বিজ্ঞানীরা ই দিতে পারেন। তবে এখন যে প্রাণী টি লোপ পাওয়ার জন্য হাঁক-পাঁক করছেন,তিনি হলেন হাতি মশাই। নিভে যাওয়ার আগে প্রদীপ যেমন হঠাৎ জ্বলে ওঠে, হাতিও তেমনি মুছে যাওয়ার আগে প্রাণপনে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাচ্ছে। আর বনবাসী মানুষেরা হারাচ্ছে তাদের মূল্যবান জীবন। গতবার আঁধার রাতে বিল-ঝাড়,বন-বাদাড় পেরিয়ে নলিনী যখন হুলা হাতে ছুটছে,তখন শিয়াড়চাঁদার এক খাবলে তার জীবন যায়।
গ্রামকে বাঁচানো, সামান্য রুজি-রোজগার তো আছেই, কুড়মীদের হুলা পার্টিতে যোগ দিয়ে , মশাল হাতে দৌড়ানোর আরও একটি বিশেষ কারণ ,রিঝ। পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে এদের যে তীব্র রসবোধ, তার জুড়ি মেলা ভার। অর্ধেক মানুষ তো হেসেই জীবনটা উড়িয়ে দেয়। এই রিঝ - হাউস এর সুসন্তান হিসেবে ঝুমুর ও ছৌ এর মাহাত্ম্য সর্বজনবিদিত। এগুলো কে যদি তারা সঠিকভাবে নৃত্য-গীতে কাজে লাগাতো,তবে এক কাতা নিয়ে ছাড়ত । কিন্তু হাতির পেছনে মশাল হাতে দৌড়াতে দৌড়াতেই জীবনের অর্ধেক চলে যায় । এ ছাড়া আর কিই বা করার আছে -
" বনের ধারে ঘর হামদের -
হাতির বড়ো ডর,
বাঁচবি যদি গো দিদি,
ঘুমাবি সতর।"
দিন পনেরো পরের কথা। ভোর চারটে নাগাদ পরেশের সদর দরজায় হড়াস হড়াস শব্দ হয়। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর এসেছে,চোখ ফুলে লাল হয়ে গেছে বলে , সে কাল হাতি তাড়াতে যায় নি। ঘুম চোখে দরজা খুলতে না খুলতেই নগেন হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে। তাকে ধরে বসে যায় মাটিতে।
পরেশ প্রশ্ন করে," কি হইল?"
নগেন, " বাদল , ফটিক আর নায়"এই বলে হাউ মাউ করে কান্না জুড়ে দেয়।
ফটিক, " কি করিঞ হইল?"
নগেন, " আঁধারে ভালঅ দেখায় নায় , হাথি পেছান ঘুরিঞ রগদালে, সঁয়া কুইল বুদায় আটকিঞ পালাতে পারে নায়। সঅবাই ভাভিঞ ছিল একটা হাথি আছে। যঅখন দেএখলি তিনটা,আমরাও কিছু কইরতে পারি নায়।"
অন্ধকারে হাতি পিছন ফিরে তাড়া করলে,বাদল আর ফটিক পালাতে পারেনি। বুনোকুলের ঝাড়ে জামাকাপড় আটকে অসহায় ভাবে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। অন্যান্য সদস্যরা ভেবেছিল একটা হাতি, সেই মতো তাড়াও করেছিল কিন্তু যখন দেখল তিনটে,আর কিছু করার রইল না। পরেশ স্থবিরের মতো , হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে। খোলা দরজা দিয়ে বাইরের আকাশে দা এর মতো একফালি চাঁদ অস্পষ্ট দেখা যায়। মরা চাঁদ, অমাবস্যা আর দু-এক দিন পর । সে মনে মনে ভাবে, আরও দুজন কমে গেলো তাদের দল থেকে ! অকালে ঝরে গেলো আরো দুটি তরতাজা প্রাণ!
0 Comments