ভোলগা নদীর খোঁজে – ১১
বিজন সাহা
বেলি গোরাদক
কিম্রি থেকে আমরা রওনা হলাম উগলিচের পথে। ঠিক হল পথে কালিয়াজিন নেমে কিছুক্ষণ ঘুরব। আমি অবশ্য ভাবছি বেলি গোরাদে নামা যায় কিনা। সেটাও পথেই। কিম্রি থেকে বাসে ও ট্রেনে এখানে যাওয়া যায়। এক্সপ্রেস ট্রেনে সময় লাগে মাত্র ১৮ মিনিট। আমার যাবার ইচ্ছা এ কারণে যে কিছু দিন আগে নদী পথে এখানে এসেছিলাম আর এর আগে নদী পথে কালিয়াজিন যাবার পথে এর সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। নদী পথে আসার ফলে শুধু নদী তীরের গির্জা দেখা হয়েছে কিন্তু এই গ্রাম বা শহর দেখা হয়নি। পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছি তখন সেই শূন্যস্থান পূরণ করা যায় কিনা সেটাই ভাবছিলাম।
কিম্রি থেকে ১৪ কিলোমিটার উত্তরপূর্ব আর তভের থেকে ১৪১ কিলোমিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত বেলি গোরাদ গড়ে উঠেছে খৎসা নদী যেখানে ভোলগায় পড়েছে ঠিক সেখানে। দুবনা থেকে বেলি গোরাদ কত দূরই বা হবে? ৩৫-৪০ কিলোমিটার? এরই মধ্যে আমার জানা মতে অন্তত চারটি নদী ভোলগায় এসে পড়েছে – দুবনা, বুইয়াঙ্কা, কিমরকা আর খৎসা। বুইয়াঙ্কা বাদে সব নদীর মোহনায় গড়ে উঠেছে জনপদ, গড়ে উঠেছে গির্জা বা অন্য কোন উপাসনালয়। সেটা হয়েছে মনে হয় বিশ্বব্যাপী। আমাদের দেশের দিকে তাকালেও একই জিনিস দেখি – যেখানেই জনপদ – সেখানেই মন্দির বা মসজিদ বা প্যাগোডা। তাই আমরা চাই বা না চাই ধর্মীয় স্থাপনা বাদ দিয়ে বা ধর্ম বাদ দিয়ে মানব ইতিহাসের পূর্ণ চিত্র পাব না। এটা অনেকটা শৈশব আর কৈশোর বাদ দিয়ে কারও জীবনী লেখার মত হবে। ধর্মকে শুধু ধর্ম হিসেবে না দেখে ইতিহাসের ও সংস্কৃতির অংশ হিসেবে দেখলে কোন সমস্যা থাকে না। তাছাড়া অধিকাংশ রুশ অর্থোডক্স চার্চে ছোটখাটো মিউজিয়াম থাকে যেখানে শুধু ধর্ম নয় বিভিন্ন সময়ের পোশাক পরিচ্ছদ, সেসব জনপদ বা শহর গড়ে ওঠার ইতিহাস থাকে। তাই ধর্মের বাইরেও এসব চার্চে স্থানীয় জনজীবনের অতীতের অনেক কিছুই জানা যায়।
বেলি গোরাদের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৩৬৬ সালের দিনলিপিতে। প্রথমে এই এলাকা ছিল তভের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ক্লিন জমিদারির অংশ। ১৩৬৬ সালে তভের রাজ নিজ রাজ্যের দক্ষিণ অংশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য বর্তমান বেলি গোরাদে দুর্গ তৈরি করেন আর এর নামকরণ করেন গোরাদক বা বেলগোরাদক। এই দুর্গ ছিল খৎসার মোহনায় পুরানো জনপদে। ১৩৬৭ সালে কাশিনের রাজা ভাসিলি মস্কো রাজের সহায়তায় বেল গোরাদ অবরোধ করেন, তবে তা সফল হয়নি। ১৩৬৮ সালে মস্কোর রাজা বেলি গোরাদ দখল করে সেখানে নিজের লোক বসান। কিন্তু পরের বছর তিনি এই শহর তভের রাজকে দিয়ে দেন। পরে ১৩৭৫ সালে মস্কো ও তভেরের দীর্ঘ যুদ্ধের সময় তভের রাজ্যের অন্যান্য অনেক শহরের সাথে বেলি গোরাদও মস্কো রাজ দ্মিত্রির সেনাদের দ্বারা মস্কো রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ষোড়শ শতকের শুরুতে বেলগোরাদক কাশিন জমিদারির এক অংশের কেন্দ্রে পরিণত হয়। পরে বেলগোরাদক গ্রামে পরিণত হয়।
১৬১২ সালে পোলিশ হানাদাররা বেলগোরাদক দখল করে পুড়িয়ে দেয়। সেই সময় বর্তমান জনপদের ওখানে বরিস গদুনভের জমিদারী ছিল। বেলগোরাদকের সাথে গদুনভ ছাড়াও মেজর জেনারেল শাতিলভের নাম জড়িয়ে আছে। শাতিলভ নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে বারাদিনোর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন আর তাঁর জমিদারী ছিল বেলোয়ে নামে পাশের গ্রামে।
বেলি গোরাদ জনপদের অর্থনীতির মূলে রয়েছে জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত কারখানা “বেলগোরাদস্কায়া সুদোভেরফ” যা কিনা ১৯৩৯ সালে তৈরি করা হয়েছিল। এছাড়াও আছে নৌকা তৈরির কারখানা এবং নদী ও সাগরে উদ্ধারকার্য সার্ভিস। নদীবন্দর ছাড়াও এখানে আছে রেল স্টেশন বেলি গোরাদক। মস্কো-কালিয়াজিন ও মস্কো-রিবিনস্ক ছাড়াও বিভিন্ন লোকাল ট্রেন এই স্টেশনে থামে।
🍂বেলি গোরাদ সম্পর্কে আমার প্রথম আগ্রহ জাগে ১৯১৮ সালের আগস্ট মাসে যখন ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে কালিয়াজিনে একটা নৌ ভ্রমণের আয়োজন করা হয়। নৌকা পথে সেখানে যাবার সময় ভোলগার তীরে দুটো সুন্দর গির্জা দেখে খুব জানার আগ্রহ জাগে এই জায়গা সম্পর্কে। আসলে নিজেও জানি না কেন, তবে যেকোনো প্রাচীন উপাসনালয় দেখলেই আমার প্রচণ্ড আগ্রহ জাগে সে সম্পর্কে জানার। না না, কোন ধর্মীয় কারণে নয়, এটা সেই স্থানের, সেই এলাকার মানুষের ইতিহাস, জীবনযাত্রা বিভিন্ন খুঁটিনাটি জানার জন্য। তাছাড়া রুশ অর্থডক্স চার্চের অনেক কিছুই আমাকে হিন্দু মন্দিরের কথা মনে করিয়ে দেয়। ঠিক ঠাকুর দেবতার মূর্তি না হলেও আইকন অনেকটা সেরকমই। ধূপের পরিচিত গন্ধ। ঘন্টা ধ্বনি। এমনকি এদের উপাসনাও অনেকটা মন্ত্র পড়ার মতই। গির্জার ভেতরের দেয়ালের কারুকাজ! সোভিয়েত আমলে খুব কম গির্জাই কাজ করত। সেখানে যেতেন মূলত বৃদ্ধা মহিলারা। আমি আর আমার ভারতীয় রুমমেট শ্রীকুমার বিশেষ করে ক্রিস্টমাস আর ইস্টারের রাতে ওখানে যেতাম দেখতে। বৃদ্ধা মহিলারা আমাদের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতেন। নতুন রাশিয়ার প্রথম দিকে এ রকমই ছিল। এখন অধিকাংশ মানুষ সেখানে বরং খুব হেল্পফুল। তাছাড়া আমি সেসব জায়গায় যাই মূলত ছবি তুলতে। কোন কোন জায়গায় অর্থের বিনিময়ে সেটা করা যায়, কোথাও সেটা করতে হয় চার্চের লোকদের সাথে আলাপ জমিয়ে। সব মিলিয়ে সেটাও এক ধরণের অ্যাডভেঞ্চার।
বেলি গোরাদে যাবার সুযোগ আসে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে। সেটাও নদী পথে – লঞ্চ জার্নি। ভখদো ইয়েরুসালিমস্কায়া গির্জা সেখান থেকে একটু দূরে। হলুদ রঙের এই গির্জাও ভোলগার তীরে, তবে যেতে হয় বাসে করে, কেননা সেখানে জাহাজ ঘাঁট নেই। সেবারের জার্নি বিভিন্ন কারণেই আনন্দদায়ক ছিল। আমি আর আমার স্ত্রী গুলিয়া ছাড়াও সেবার আমাদের সাথে গেছিল তথাগত ও নীতা। ওরা পশ্চিম বাংলা থেকে, সেই মুহূর্তে দুবনায় কাজ করত। তাই সারা রাস্তা ওদের হাতে গল্প করতে করতে সময় কেটে গেছে। তাছাড়া ওরা নিজেরা ছবি তুলতে পছন্দ করে। এই যে আজ আমি জ্বলদর্চিতে লিখছি সেটাও তথাগতের মাধ্যমেই হয়েছে। এক কথায় যত দিন ওরা দুবনায় ছিল সময় পেলেই আমরা সেদিক সেদিক ঘুরতে যেতাম। এই জার্নিতে আমরা গেছিলাম স্থানীয় এক ট্যুর এজেন্সির “ইন্টেল ট্যুর”এর মাধ্যমে। এসব জার্নির একটা সুবিধা হল যে সাথে গাইড থাকে এবং যাত্রার সময় আশেপাশের বিভিন্ন গ্রামগঞ্জের ইতিহাস বলতে বলতে যায়। তাই লক্ষ্যস্থলে পৌঁছানোর আগেই সেই জায়গা সম্পর্কে অনেক তথ্যই জানা হয়ে যায়। এসব এক্সারশন কোন শহরে হলে সেই শহরের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য স্থান পরিদর্শন ছাড়াও থাকে খাবারের ব্যবস্থা। যদি বড় শহরে খাবার ব্যবস্থা থাকে কোন ক্যাফে বা স্তালভায়ায় (হোটেলে) তাহলে গির্জা প্রদর্শনে গেলে খাবার ব্যবস্থা সেখানেই করা হয়। যেখানে খাবার দেয়া হয় তার নাম ত্রাপেজনায়া আর খাবারকে আবিয়েদ বা লাঞ্চ না বলে বলা হয় ত্রাপেজ। যেহেতু আমাদের ভ্রমণ স্থল ছিল শুধুই গির্জা তাই খাবারের ব্যবস্থা ছিল ত্রাপেজনায়ায়। বলতেই হয় খাবারের মান ছিল খুবই ভালো এবং স্বাস্থ্যকর। প্রথমেই আমরা গেলাম জেরুজালেমের ঈশ্বর মাতা আইকনের নামে গির্জায়। দেখলাম ভেতরের কারুকার্য। শুনলাম ইতিহাস। বেলি গোরাদে প্রথম গির্জার উল্লেখ পাওয়া যায় ১৬২৯ সালে। নতুন কাঠের গির্জা তৈরি হয় ১৬৯৩ সালে আর এর নাম রাখা হয় গিওরগি পাবেদোনসেৎ। বর্তমান গির্জা তৈরি হয় ১৮২৫ সালে। গির্জায় তিনটি সিংহাসনের প্রধানটায় জেরুজালেমের ঈশ্বর মাতা আইকন স্থান পেয়েছে, বাকি দুটোয় গিওরগি পাবেদোনসেৎ ও আরখাঙ্গেল (প্রধান দেবদূত) মিখাইল। ১৯৩০ এর দশকে গির্জা বন্ধ করে দেয়া হয়, তবে ১৯৯০ সালে সেটা আবার রুশ চার্চের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। ২০০৩ সাল থেকে গির্জা কাজ করতে শুরু করে। সেখানে খাওয়া দাওয়া শেষ হলে বাসে করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল ভখদো ইয়েরুসালিমস্কায়া গির্জায়। এখানে গির্জা তেমন জাঁকজমকপূর্ণ না হলেও সার্বিক পরিবেশ বেশ সুন্দর। বিশাল বাগান, ছোট বন। এখানেই আমরা উঠলাম বেল টাওয়ারের মাথায়। সেখান থেকে ভোলগার রূপ একেবারেই ভিন্ন রকম। আজকাল ড্রোনের সাহায্যের উপর থেকে ছবি ও ভিডিও করা ডালভাত হয়ে গেছে। কিন্তু সেই সুযোগ না থাকলে উঁচু জায়গা থেকে নীচে কিছু দেখার, তার ছবি তোলার মজাই আলাদা। তবে দিলীপের সাথে আমাদের ওখানে যাওয়া হয়নি। আমরা পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম কালিয়াজিনের দিকে আর যাওয়ার সময়ে আমার মনে ভেসে উঠল মাত্র কিছুদিন আগে বেলি গোরাদ ভ্রমণের সেই চিত্র।
বেলি গোরাদ ভ্রমণের কিছু ছবি এখানে
http://bijansaha.ru/albshow.html?tag=199জ্ব
লদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇
0 Comments