জ্বলদর্চি

আদা হলুদ /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৮৩
আদা হলুদ

ভাস্করব্রত পতি

চৈত্র সংক্রান্তি থেকে শুরু করে সারা বৈশাখ মাস জুড়ে পালিত হয় এই আদা হলুদ উৎসব। এটি পালন করেন সধবা নারীরা। প্রতিদিন সকালে ব্রতীনীকে একজন সধবা ( এয়ো) ও একজন ব্রাহ্মণকে ৫ টি হলুদ, ৫ টুকরো আদা, এক মুঠো ধান, এক মুঠো ধনে, মিষ্টি বা সন্দেশ ও দক্ষিণা হিসেবে ৫ টি টাকা বা পয়সা দিয়ে উৎসব পালন করতে হয়। এইভাবে টানা চার বছর পালন করতে হয়। প্রথম বছরে একজন সধবা, দ্বিতীয় বছরে দুজন সধবা, তৃতীয় বছরে তিনজন সধবা এবং চতুর্থ বছরে চারজন সধবাকে দিয়ে ব্রত পালন করতে হয়। 

চতুর্থ বছরে বিষ্ণুপদী সংক্রান্তিতে মোট চারজন সধবাকে একসাথে বসিয়ে সিঁদুর চুবড়ি, আলতা, শাঁখা, আয়না, নোয়া, আংটি, মাথাঘসা, পাখা ইত্যাদি সামগ্রী দিয়ে এবং চারজন ব্রাহ্মণকে যথাসাধ্য দক্ষিণা (ষোলো আনা) দিয়ে ভোজন করাতে হয়। তবে যাঁকে দিয়ে প্রথম শুরু করা হয়েছিল, তাঁকে এগুলি ছাড়াও একটি লালপেড়ে শাড়ি পৃথকভাবে দেওয়া হয়। লোকবিশ্বাস যে, এটি পালন করলে বৈধব্যযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়না। সুখ সৌভাগ্য ও স্বামী সোহাগ কামনাই হল এই লৌকিক উৎসবের উদ্দেশ্য।
'আদা হলুদ ব্রত ক'রে এই পেলাম বর। 
এ জীবনে থাকবে নাকো বৈধব্যের ডর॥'
জিঞ্জিবারেসী গােত্রভুক্ত ZINGIBER OFFICINALE বা আদা ব্যবহৃত হয় রান্নার এক অন্যতম মশলা হিসেবে। গুজরাটিতে আদু, ইংরেজিতে Ginger, হিন্দিতে আদরক, সংস্কৃতে আদ্রক, কন্নড়ে অল্ল, তেলুগুতে অন্ন, ফারসিতে জিঞ্জি এবং অসমিয়াতে জিঞ্জিবিলতর বলা হয়। এছাড়াও বন আদা বা Zingiber casumunar এবং জঙ্গলী আদা বা Zingiber capitunatum পাওয়া যায়। শাস্ত্রকারদের কাছে এটি অপাকশাক, গুল্মমূল, শুন্ঠী, অদ্রক, শৃঙ্গীবের, মূলজ, বর, মহীজ, অনুপজ, একবেষ্ঠ, কন্দল নামেও খ্যাত।

আদার মতো হলুদও ZINZIBERACEAE পরিবারভুক্ত। পাঁচ রকমের হরিদ্রা বা হলুদ পাওয়া যায়। সেগুলি হল — (১) কর্পূর হরিদ্রা (২) বনহরিদ্রা (৩) কালা হলুদ (৪) আম্রগন্ধি হরিদ্রা এবং (৫) দারুহরিদ্রা। এই হলুদকে কোঙ্কনীতে বলে হলদি, কন্নড়ে বলে অর্শিনা, তেলুগুতে পঙ্গুহ, ফার্সিতে জবদচোর, ওড়িয়াতে হলদ, গুজরাটীতে হলদর, সংস্কৃতে রজনী বলা হয়। বিজ্ঞানসম্মত নাম Turmeric murmeric এবং Curcuma longa। সারা ভারতে হলুদের চাষ হয়। কন্দ জাতীয় গাছ। অত্যন্ত ভেষজ গুণসম্পন্ন। হলুদকে অন্যান্য যে সব নামে ডাকা হয় তা হল – শ্যামা, বিলাসিনী, জয়ন্তিকা, হরবিলাসিনী, যোষিৎপ্রিয়া, মঙ্গল্যা, সুভাগা, হরিদ্রা, হরিদ্রঞ্জনী, স্বর্ণবর্ণা, সুবর্ণা, কাঞ্চনী, শিবা, দীর্ঘরাগা, কৃমিয়া, বিষয়ী, বরবর্ণিনী, বর্ণদাত্রী, গৌরী, হরিতা, বরাঙ্গী, হরিদ্রী, পীতা, শোকা, শোভনা, বরা এবং জনিষ্ঠা। আমরা লোকগানে ব্যবহার করি, “তোদের হলুদ মাখা গা, তোরা সোজা রথে যা / আমরা হলুদ কোথায় পাবো, আমরা উল্টোরথে যাবো'। যজুর্বেদে পাই –‘হরিৎ হরিদ্রং প্রতনু বিশ্বমস্য শোনং রুক্ল মাস্যৎ দেবানাং'। যজুর্বেদের অন্যত্র পাই— 'হরিতা ত্বমিমা ওষধিঃ সোমঃ সাদন্যং বিদুয্য সভেয়ং / হিরণ্যগর্ভা, ত্রিদিবাসু শোনিতং ইচ্ছন্তি গ্রারাণঃ সমিধানে অগ্নৌ'। আবার অন্যত্র পাই ‘যাস্তে রুচো আতন্বত্তি রশ্মিভিঃ অভির্নো / সৰ্ব্বাভৌ রুচে জনায়ন কৃধি হরিদ্রে'।
হলুদের মধ্যে লুকিয়ে আছে রস, বীর্য এবং বিপাকের প্রভাব। নানা মারণরোগের বিরুদ্ধে হলুদের কার্যকারিতা প্রমানিত হয়েছে। নিয়মিত হলুদ সেবনে গাত্রবর্ণের উজ্জ্বলতা এবং কান্তিরক্ষা বৃদ্ধি পায়। হিন্দুদের অসংখ্য লৌকিক উপচারে হলুদ একটি অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হলুদ নিয়ে একটি গান প্রায়শই শোনা যায়— 'হলুদ বনে বনে, আমার নাকছাবিটি হারিয়ে গেছে, স্মরণ নেইকো মনে'।

আদা এবং হলুদ দুটিই স্বাস্থ্যের পক্ষে মঙ্গলজনক। যা মানুষকে নিরোগ রাখে এবং আয়ু বাড়ানোর জন্য সুস্থ সবল রাখতে পারে। যদিও এই মুহূর্তে এই লৌকিক উৎসবটির কথা বেশিরভাগ মহিলাদের কাছে অজানা এবং অচেনা।
🍂

Post a Comment

0 Comments