জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ১১ / সালেহা খাতুন

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ১১ / সালেহা খাতুন 

হরিষে বিষাদে পরিপূর্ণ জীবন। সাবালক হয়ে উঠার অনেক যন্ত্রণা। অনেক সংকোচ সংকট দেখা দিচ্ছে জীবনে। কুসুমাস্তীর্ণ জীবন কণ্টকাকীর্ণ হয়ে উঠছে। পাকামিও বাড়ছে। ফলে শাসনে খড়্গহস্ত হয়ে উঠছেন বাবা। মায়ের শাসন তো আছেই। সাধারণ গৃহস্থ সংসারে গরু বাছুর মুরগী পায়রা কুকুর সবাই একসাথে থাকে। সবার যত্ন নিতে হয়। বড়োদের সাথে সাথে ছোটোদের উপরও দায়িত্ব চাপে এদের দেখভালের। গরুকে মাঠে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসা, মুরগীদের খাবার দাবার দেওয়া, বিড়ালের হাত থেকে পায়রাদের বাঁচানো কী নেই সেই তালিকায়।

 একেবারে শৈশবে আমাদের একটি অ্যালশেসিয়ান কুকুর ছিল। অনেকবার আমার হাত থেকে বিস্কুট খেয়ে নিয়েছে। ভীষণ কাজের ছিল সে। নারকেল পাড়া হলে পুকুরে যেগুলি পড়তো সাঁতার দিয়ে সেগুলি তুলে আনতো। চোরের উপদ্রব কমেছিল। পাড়ার রুহুল চোর মাংসের লোভ দেখিয়ে ওকে শেষ করে দেয় মাংসের সঙ্গে বিষ প্রয়োগ করে। ওর মৃত্যুতে আমাদের সংসার বিষাদের কালো ছায়ায় আবৃত হয়ে যায়। দিন থেমে থাকে না। সময় বয়ে যায়। ক্লাস এইটের দুর্বুদ্ধিতে একটি মুরগী বাচ্চার ডিম থেকে বেরিয়ে আসাকে ত্বরান্বিত করতে গিয়ে তার অকাল মৃত্যুর কারণ হয়ে যাই। ডিম থেকে আর একটু মাত্র বেরোতে বাকি, আমি কাঁটা কম্পাস সহযোগে তাকে ডিম থেকে বের করে আনি; ব্যস অসম্ভব রক্তপাত আর তুলতুলে বাচ্চাটির প্রাণের বিনষ্টি। বাবা বাজার থেকে ফিরে বাক্যবাণে আমাকে প্রায় বধ করলেন।
 সেসময় বাবা নতুন বাড়ি তৈরি করছিলেন। ইচ্ছে ছিল পয়লা বৈশাখে নতুন বাড়িতে উঠে যাবেন। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিবেশ চৈত্রেই অসম্পূর্ণ বাড়িতে চলে যেতে বাধ্য করলো। চিরকালীন সেই পড়ার পরিবেশ ছেড়ে নতুন বাড়িতে কাঠের তৈরি চেয়ার টেবিলে পড়াশোনা শুরু হলো। দাদু ইংরেজি ডিকশনারি উপহার দিয়ে প্রতিদিন পঁচিশটি করে ওয়ার্ড মুখস্থ করতে বললেন। মেজো মামা দিলেন চাইনিজ ইঙ্ক পেন। পড়াশোনায় খুব একটা সিরিয়াস হইনি বলে এইটের হাফ ইয়ারলি পরীক্ষায় আরবীতে খুব কম পাই। ফলে র‌্যাঙ্ক পিছিয়ে যায়। বাবা সাবধান করলেন। সাদা বাংলায় বলা যায় মরতে বললেন।

আসলে নতুন বাড়ি  নতুন পড়ার জায়গায় ঠিকমতো অভিযোজিত হতে পারিনি। রাগে দুঃখে একমাত্র আশ্রয় পড়াশোনায় গভীরভাবে মগ্ন হয়ে গেলাম। সেবার অ্যানুয়াল পরীক্ষায় জীবনের সর্বোচ্চ নম্বর পেলাম। হেডমাস্টারমশাই ঘোষণা করলেন এ পর্যন্ত বিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নম্বর এটি। মানুদার কাছে তখনও পড়ছি। মিডল টার্ম বিশ্লেষণ ঠিকমতো পারি নি বলে মানুদাও খাতা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। রেজাল্ট দেখে, অঙ্কে একশোয় একশো দেখে তিনিও খুব খুশি হন। ঘোষ বাড়ির সবাইকে আমার রেজাল্ট দেখান।
এই মানুদার বাড়ি থেকে একদিন সকালে পড়ে ফিরে ঘরের বাইরে রাখা একটা কাঠের গুঁড়ির উপর বসে খেলছি, মা জানালা দিয়ে ইশারায় আমাকে ঘরে ডাকলেন। বললেন দেখি তোর জামায় কীসের দাগ লেগেছে। তারপর সকালবেলায় আমার ছেড়ে রাখা লালপাড় সাদা শাড়িটি খুঁজতে গেলেন। আমি তখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। সকালে কোরআন তেলায়ত করি। বড়োমাসির দেওয়া ঐ শাড়িটি পরেই ধর্ম সাধনা করি। শাড়িটি পুরো রক্তমাখা হয়ে আছে। আমি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে আমাদের পোষা বেড়ালটির উপর দোষারোপ করতে লাগলাম। ওর সেদিন তিনটি বাচ্চা হয়েছে। আর আমার শাড়ির ওপর জমিয়ে বসেছে। মা যা বোঝার বুঝলেন। পরিষ্কার কাপড়ের টুকরো আর শাড়ির পাড় ছিঁড়ে বিশেষ পদ্ধতিতে আমাকে পরিয়ে দিলেন। বুঝিয়ে দিলেন আমার “শরীর খারাপ” হয়েছে। বোন আর আমি পরে ব্যাপারটি সংঘটিত হলেই কোড ল্যাঙ্গুয়েজে বলতাম “মহাপুরুষের আগমন” ঘটেছে। “পিরিয়ড” শব্দটি বন্ধুদের মধ্যে ব্যবহার করতাম। কোএড স্কুলে পড়ি। ছেলেরা মাঝে মাঝে “আয়নায় দাগ লেগেছে” শব্দটি উচ্চারণ করতো। পরীক্ষাটরীক্ষা এলে কী যে গোলমাল হতো বলে বোঝানোর নয়। মাধ্যমিক পরীক্ষার টেনশনে প্রায় তিনমাস পিরিয়ড হলো না। বাবার বন্ধু বিলেত ফেরত ডাক্তার শ্যামল রায়ের (বোমু কাকু) কাছে গেলাম। তিনি কোনো ওষুধ দিলেন না। আমাকে দাঁড় করিয়ে বললেন “হেঁট হ”। তারপর কোমরের ওপর নিজের হাতটাকে ঘুরিয়ে এক ঘা দিলেন। বললেন “চলে যা সব ঠিক হয়ে যাবে”। আমি অবাক। সত্যিই ঠিক হয়ে গেল। উচ্চমাধ্যমিকে কৃপাসিন্ধু বাবু চিকিৎসা করেন। 
🍂

যেসব দিনগুলো পেরিয়ে এসেছি ভাবলে অবাক হয়ে যাই। ইরেগুলার ব্লিডিংয়ের শিকার আমি। একারণে পরবর্তীকালে বিভিন্ন অসুবিধায় পড়েছি। অনার্স পার্ট ওয়ান পরীক্ষা দিতে দিতে হঠাৎ ব্লিডিং শুরু হয়ে যাওয়ায় সাদা সালোয়ার কামিজের দাগ ঢাকতে বন্ধুরা সাহায্য করে। এখনকার মতো দোকানে দোকানে স্যানিটারি ন্যাপকিন সর্বত্র পাওয়া যেতো না। বা অতোটা আর্থিক সামর্থ-সাধ্য সবার ছিল না। যতদিন না আর্থিক স্বাবলম্বন অর্জন করেছি প্যাড ব্যবহার করিনি। আর সন্তানের জন্মও দিই নি। 

এখন কর্মক্ষেত্রেও মাঝে মাঝে বিপদে পড়ি হঠাৎ ব্লিডিং শুরু হলে। ইনভিজিলেশন ডিউটি দিতে দিতে, ক্লাস নিতে নিতে ছুটে যাই বাথরুমে। অ্যাটাচ বাথরুম সব ডিপার্টমেন্টে নেই। সব বাথরুমে ডাস্টবিনও নেই। ছাত্রীদের জন্য গার্লস কমন রুমে ভেন্ডার মেশিন বসানো হলেও আমাদের মতো অধ্যাপকদের তা ব্যবহার করার মতো সুবিধা নেই। এতো জমানো কথা, আমার নারীজন্মের কথা হয়তো কোনোদিন বলতাম না যদি না হাতে “এগারোয় পা : মেয়েদের অন্তরঙ্গ কথা” বইটি হাতে আসতো।
( ক্রমশ )

Post a Comment

0 Comments