জ্বলদর্চি

কালের অতল তলে কলোরাডো --১৩ পর্ব / চিত্রা ভট্টাচার্য্য

কালের অতল তলে কলোরাডো -১৩ পর্ব   

চিত্রা ভট্টাচার্য্য

সুদূর দিগন্তের থেকে ভেসে আসা বসন্তের উদাসী বাতাসে পথের ধারের জুনিপার উইলো গাছের হলদে পাতা গুলো পায়ে চলার কাঁকুড়ে পথের ওপর রিনরিন শব্দে ঝরে পড়ছে।  রৌদ্রোজ্জ্বল সাত সকালে মনে খুশির তুফান তুলে বেড়াতে বেরিয়েছি  কিন্তু  ইউটার স্প্রিংডেলের  দক্ষিণ প্রান্তের  weather report বলছে March ,April এ  এখানে সবচেয়ে বেশী বৃষ্টি হয়। যখন তখন অপ্রত্যাশিত ঝড় ওঠে,বিশাল এলো মেলো  বাতাসে গাছ ভেঙে পড়ে। রুক্ষ কঠিন পাথুরে পাহাড়ে ধস নামলে  পাথর গড়িয়ে যায়। ঝোড়ো হাওয়া  শান্ত প্রকৃতিকে লন্ড ভন্ড -- বিদ্ধস্থ করে জীবনের ছন্দ হারায়।  যদিও এ অঞ্চলের  বৃষ্টি ভারী  অদ্ভুত, এই মুষলধারে  ঝমঝম করে ঝরছে অথচ কোথাও জল কাদা একফোঁটা ও জমে নেই। তৃষিত ধরণীর শুষ্ক মরু প্রান্তরের  সব জল চোখের পলকে  শুষে নেওয়ায় রাস্তা ঘাট নিমেষে শুকিয়ে যায়।
ভাবছি অসময়ে প্রকৃতির তান্ডব লীলা শুরু হলে তো এই পাথুরে মরুদ্যানে সব বেড়ানো পন্ড হয়ে যাবে জায়ন পার্ক দেখা হবে না। যদি ও ঘাড় উঁচু করে স্বচ্ছ নীলাকাশের বুকে তাকিয়ে থেকে এক টুকরো কালো মেঘের সম্ভাবনা ও তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোথাও দেখতে পেলাম না। উৎফুল্ল মন বেশ শান্তিতে  গুনগুন করে আপন মনে গেয়ে ওঠে  ''কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে ''.। উদাসী বসন্ত বাতাসে পথের ধারে অবিরাম নানা রঙের বুনো ফুলের মেলায় চোখে নেশা লাগে। গাইড সাহেব আলভারো  বলেন জায়ন পার্ক সবচেয়ে মনোরম সুন্দর হয়ে ওঠে  September  ,October এ  --Autumn  অর্থাৎ  শরতে। সে সময় গাছে গাছে পাতায় পাতায় অপরূপ রঙের প্রদর্শন শুরু হয় , ঝড় বৃষ্টি বিশেষ থাকে না আবহাওয়া ও বেশ মনোরম । কিন্তু এখন 10th March,,,বসন্ত এসে গেছে। 

গাইড সাহেব এই পার্কের আদি ইতিহাস বলে চলেছেন যা প্রতি ট্রিপেই রোজই বলে থাকেন।  পারভীন মন দিয়ে শুনছে , গিরিখাত পাহাড় নদী ঝর্ণা খাল বিল ভূ সম্পর্কিত যে কোনো আলোচনার ওপর ওর বিশেষ মনোযোগ।  আমি  বহুকাল আগে লেখা পড়ায়  ইস্তফা দিলে ও এখনো ও প্রাচীন ইতিহাসের ওপর অমোঘ টান কে কিছুতেই অস্বীকার করতে পারিনা। যে কোনো জায়গা দেখতে গিয়ে তার ইতিহাস ভূগোল না জানলে মন অতৃপ্তিতে ভরে থাকে । পারভীন আমার ইতিহাসের চর্চার বিশেষ সঙ্গী।   তাই দুজনেই আপাতত মননিবেশ করেছি  জায়ন পার্কের ইতিহাসে । বাস সর্পিল পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে ঘুরেঘুরে ওপরে উঠতে লাগলো।খাড়া পাহাড় গুলো যত দেখছি তত শরীরের রক্ত হিম হয়ে আসছে। ভাবছি     পর্বতারোহীরা ,হাইকার রা কেমন করে ঐ কঠিন পথ বেয়ে এগিয়ে চলে ? প্রতি মুহূর্তে প্রাণের আশঙ্কা তবু ও জীবন কে বাজী রেখে এই দূর্গম পাহাড়ি পথ পরিক্রমায় কীসের এত আনন্দ? 
  প্রায় ৮,০০০ বছর আগে আদি আমেরিকানরা ছোট ছোট পরিবারের সাথে এখানে বসতি স্থাপন শুরু করেছিল। যার মধ্যে একটি ছিল আধা যাযাবর বাস্কেট মেকারের পূর্ব পুরুষ। প্রত্নতাত্ত্বিক দের মতে এই আদি আমেরিকানরা আনসাজি নামে পরিচিত ছিলেন এবং পরবর্তী কালে এরা ছিলেন ভার্জিন আনসাজি সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। খ্রীস্ট পূর্ব  ৫০০ অব্দে বাস্কেটমেকার রা স্থায়ী সম্প্রদায় গুলোতে বসতি স্থাপনের ফলে প্যারোওয়ান ফ্রেমেন্ট গ্ৰুপের বিকাশ ঘটেছিল। ক্রমশঃ প্যারুসিটস  ও পাইউট উপজাতির স্থায়ী নিবাস গড়ে  উঠলেও ঐতিহাসিক বিবর্তনের পথ ধরে ১৮৫৮সালে মর্মনস জাতি এই অঞ্চলে জাঁকিয়ে বসে এবং  ১৮৬০ এর দশকে তারা এখানে পাকাপাকি স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন।    
🍂

       ব্রতীন বলে  আধুনিক সভ্য মার্কিন দের অগ্ৰাসী নীতি শেষ আদিবাসী সম্প্রদায়ের  ধারক মর্মন দের হটিয়ে উৎখাত করে সম্ভবতঃ ১৯০৯সালে জায়ন ন্যাশানাল পার্কের স্থাপনা হয়েছিল। অবশ্যই এই প্রাকৃতিক সম্পদ বন পাহাড় গিরিখাত নদ নদীর সৌন্দর্য যাতে অটুট থাকে এবং  ১৯১৯সালে অনেক ঝড়ঝাপ্টা পেরিয়ে এই পার্ক টি প্রাচীন পৃথিবীর এক বিস্ময়কর অস্তিত্বের স্মারক হয়ে আমেরিকা যুক্ত রাষ্ট্রের জাতীয় উদ্যান হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। বিশালাকৃতির দৈত্যের মত সারি সারি নিঝুম পাহাড় গুলো প্রহরা রত হয়ে লক্ষ লক্ষ  বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অতনু ও ইয়ম গভীর আলোচনায় ব্যস্ত। ওরা  বলে   প্রকৃতি প্রেমিক এই  মার্কিনী মুলুকের মানুষ গুলো প্রাকৃতিক সম্পদ কে যথেষ্ট মর্যদা দিয়ে তাকে ভালোবেসে যথাসাধ্য রক্ষণাবেক্ষণ করে সাজিয়ে বিশ্বের দরবারে প্ৰতিষ্ঠা করেছে যা দেখলে অভিভূত হতে হয়।   
জায়ন ন্যাশানাল পার্কটি সেন্টজর্জ শহরের প্রায় তিরিশ মাইল উত্তর পূর্বে কলোরাডো মালভূমির উত্তর পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত।  দক্ষিণ পশ্চিম ইউটাহ ,মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের রঙিন গভীর গিরিখাত ,উঁচু পাহাড় ,মেসা এবং বনভূমির অপরূপ বিস্ময় কর ল্যান্ডস্কেপ মুগ্ধ চোখে দেখেই চলেছি । বাসটি  এখানে কিছুটা সময় বিরতি নিলে আমরা ও নামলাম।  যে দিকে তাকাই প্রত্যেক টি পাহাড়ের গায়ে রক্তিম বর্ণের সাথে মিলেছে আরো নানা রঙের বাহার। ভূতত্ত্ব বিদদের মতে জায়নের এই অপরূপ রূপরাশি প্রকাশ হতে অন্ততঃ আড়াই কোটি বছর লেগেছিল ।  বেলে পাথরের খাড়া পাহাড় আর গভীর খাদ মাঝে মাঝে সবুজ ধূসর কিম্বা ছাই রঙা পাহাড়ের উপলখন্ডের গা বেয়ে গড়িয়ে চলেছে সরু সূতোর মত প্রস্রবনের ধারা। ব্রতীন বলে ছোট ছোট নদী গুলোর জলে নানা রকম খনিজ পদার্থ  ভেসে আসে যেমন আয়রন অক্সাইড ক্যালসিয়াম কার্বনেট সিলিকা ইত্যাদি। পাহাড় ধোয়া পাথুরে বালি মাটি পরে সিমেন্টিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করে সঞ্চিত পদার্থ গুলোকে শিলায় পরিণত করেছে। পাহাড় কোথাও কালো অথবা ছাই কোথাও সবুজ ,সাদা মেরুন তামাটে ধূসর রঙের মিছিল।  এমন  অপরূপ দৃশ্য --এই মনোমুগ্ধ কর স্মৃতি গুলো কে চিরন্তন করে রাখার চেষ্টায় ক্যামেরায় ছবি তুলতে সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল।

সেখান থেকে বাস এলো পার্কের পূর্ব প্রান্তে। এখানে পর পর দেখলাম  চেকার বোর্ড মেসা , দ্য ইস্ট টেম্পল।  জায়ন ক্যানিয়নের উত্তর পশ্চিমে কোলোব টেরেস, ম্যাপে দেখেছিলাম  এই জায়গাটি দা সাবওয়ে নামে পরিচিত একটি স্লট ক্যানিয়ন।  লাভা পয়েন্ট থেকে পুরো এলাকায় এমন সুন্দর মনোরম দৃশ্য চোখ জুড়িয়ে যায়।  তবে এতো বিশাল পার্ক টি আরো অনেক জায়গা দেখা বাকী আছে যা একদিনে দেখা সম্ভব নয়।   শাটল বাস চলছে বলেই এমন দেখা সম্ভব হলো। হঠাৎ চোখে পড়লো পাহাড়ের কোলে জায়গা করে নিয়ে এক অল্প বয়সী যুবক চিত্র শিল্পী রঙ তুলি হাতে ধ্যানমগ্ন। তার নিবিড়তায় ক্যানভাসে নিঃসর্গের ছবি আঁকা চলছে।  

     বাস এসে দাঁড়ালো এবার ভার্জিন  নদী নাভাহো লেকের কাছে প্রায় ৯,২০০ ফুট উঁচু তে। এতো উঁচুর থেকে নীচে পাহাড়ের খাদের দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকি শেষ কোথায় ?,পাদুটো  অসাড়। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি  মনে হলো একটু অসতর্ক হয়ে এগোলেই ঐ বিশাল খাদের অতলে তলিয়ে যাবো।  এখানে সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে The Narrows... ,মিষ্টার আলভারো বললেন জায়ন ন্যাশানাল পার্ক এলাকায় ন্যারোস হল জায়ন ক্যানিয়নের সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশ। ভার্জিন নদীর উত্তর এবং কলোরাডো মালভূমিতে প্রিমিয়ার হাইক গুলো মধ্যে একটি অন্যতম। এই নদী টি প্রায় ১১মাইল উঁচু ভূমি আস্পেন বনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণে বয়ে গিয়েছে। তারপর পশ্চিমে মোড় নিয়ে দুই মাইলের মত একটি ঘাট তৈরী করেছে।নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে তরতর করে বয়ে চলেছে নদীটি , খুব গভীর নয় ,জলে হাত দিয়ে দেখি কী ভীষণ ঠান্ডা ! প্রায় ১০০ফুট উঁচু বেলেপাথরের খাড়া দেওয়াল  সোজা প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে আছে.আশেপাশের পাহাড়ের গা ঝর্ণার ঝর্ঝর শব্দে কান পেতে থাকি।  

দুদিকেই গভীর বন বিচিত্র ক্যাকটাসে ভরা ,অজস্র পাখির কলকাকলির তানের সাথে চঞ্চল পাখা ঝাপটানোর আওয়াজ পেলাম। কয়েকজন বার্ড ওয়াচার কাঁধে ক্যামেরা আর গলায় হাইলেন্সের দূরবীন ঝুলিয়ে চলেছে বনের পথে। আলাপী অতনু  ওদের সাথে গল্প জমিয়েছে ,ওরা চলেছে  ''ক্যালিফোর্নিয়া কনডরসের'' খোঁজে। যে পাখিটি বৃহত্তম শকুন জাতীয় প্রাণী যারা মৃত দেহ খেয়ে জীবন ধারণ করে। লুপ্ত প্রায় প্রজাতির এই পাখি টির বংশ বৃদ্ধির জন্য ওরা তৎপর হয়ে উঠেছে। চেষ্টা চলছে মেল ফিমেল দুটির ই খোঁজ। মেক্সিকান স্পটেড আউল ও ওরা খুঁজবে। দুই একটা  গোল্ডেন ঈগল চলতি পথের গাছের ডালে উড়ে এসে বসেছিল। মাথার ওপরে মটমট লম্বা লেজ ঝুলিয়ে পাখা ঝটপটিয়ে উড়ে সামনের বিশাল উইলো গাছের মগ ডাল  থেকে শঙ্কিত দৃষ্টিতে কটমট করে দেখছে । ইচ্ছে হতে লাগলো বনের পথে এগিয়ে পাখি দেখার। হয়তো এখানে সবুজ লেজ উঁচু করে গাছের ডালে দোল খাওয়া তীক্ষ্ণ গলার আওয়াজের ম্যাগপাই দেখা দেবে। ভয় ডর হীন পাহাড়ি ব্লু  জয় ,কিছু ঝুঁটি বাঁধা ধূসর কার্ডিনাল বা  বী ইটার বেশ মজায় ঘুরছে দেখবো । হ্যামিংবার্ড গুলো তো কানের সামনে দিয়ে উড়ে চলেছে। 

          আলভারো সাহেব বলেন বনের গভীরে  সাংঘাতিক সব  মাউন্টেন লায়নের দল  ঘুরে বেড়া য়।  সিওর বেঘোরে প্রাণ যাবে। তোমাদের ফেলে রেখে চলে যাবো।  তাছাড়া ও আছে নানা সরীসৃপ প্রাণী। আমি বলি কারোর তো দেখা পেলাম না। ব্রতীন বলে তাদের দেখার জন্য জঙ্গলে ঘুরে এক জায়গায় ধৈর্য্য ধরে বহুক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে হবে।  ওরা ও যে মানুষ কে সমান ভয় পায়।    

   মাউথ অফ দি ন্যারোস বা জায়ন থেকে এক মাইল দক্ষিণে রয়েছে সিনাওয়াভা মন্দির যেখানে নদীটি  প্রধান জায়ন নর্থ ফর্ক ন্যাশানাল পার্কে প্রবেশ করেছে। একটি সমতল , চতুর্ভাগ থেকে হাফ মাইল চওড়া প্রায় চারশ থেকে আটশো মিটার বেলেপাথরের পাহাড় সহ গিরিখাত। প্রতিটি দিকে তাদের চূড়া ২,৪০০ ফুট উপরে।  ব্রতীন বলে আট মাইল আরো দক্ষিণে এগিয়ে গেলে যেখানে গিরিখাত ক্রমশ  আরো প্রশস্ত হয়ে স্প্রিংডেল শহর ও জায়ন জাতীয় উদ্যানের দক্ষিণ সীমানায় বিস্তৃত রয়েছে। আমরা পার্কের বাসে   ঘুরছি বলেই এমন কাছে থেকে সব দেখা সম্ভব হচ্ছে। ক্যানিয়নের ৬মাইল দীর্ঘ সিনাওয়াভা মন্দিরে ,পাইউট ইন্ডিয়ান দের কোয়েট দেবতাদের মন্দিরের কাছে এসেছি। সরু হয়ে যাওয়া একটি হাইকিং ট্রেইল ধরে দা ন্যারোসের সামনে এলাম। মিষ্টার আলভারো বলেন , এই পথ টি ২০ফুট চওড়া এবং ২০০০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে পাথুরে পাহাড়ের পথে মিলিয়ে গিয়েছে। 

তাকিয়ে আছি ভার্জিন নদীর ঘোলাটে জলের দিকে। শত শত পাহাড় ধুয়ে আসা ঘোলা জল কে কেন্দ্র করে প্রাচীন যুগে সেই ৮,০০০ বছর আগে যে মানুষ গুলো নদীর তীরে শিবির স্থাপন করে দলে দলে স্থায়ী বসবাস ও সংসার গড়ে তুলেছিল তাদের প্রাত্যহিক জীবন সংগ্রামের ধারা কেমন এগিয়ে চলেছিল ? প্রাকৃতিক ঝড়ঝঞ্ঝা , ভূমিকম্প অগ্নুৎপাত বন্যা ইত্যাদি ভূ বিপর্যয় তো ছিল ই তারসাথে ছিল বন্যপশুর আক্রমন।ক্রমশ সব প্রতিকূলতার মোকাবিলা করে সরু সরু শাখা নদী গুলোর পাড়ে  গড়ে তুলেছিল  চাষের ক্ষেত।  প্রায় ২০০০বছর আগে কিছু গোষ্ঠী ধীরে ধীরে ফসল উৎপাদন পশুপালন করে আদিবাসী সমাজ নতুন জীবন ধারার সন্ধান পেয়েছিল ।  পরবর্তী যুগে এই দল গুলো স্থায়ী গ্রাম গড়ে তোলে যার নাম পুয়েব্লোস।  পারভীন বলে ,---ভূতত্ত্ব বিদেরা এই যুগটাকে প্রত্নতাত্বিক যুগ বলে।  এখানে মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে ঝুড়ি কর্ডেজ জাল ইউকাফাইবার স্যান্ডেল ,যন্ত্রপাতি শিকারের অস্ত্র ইত্যাদি মর্মনদের ব্যাবহারিক জিনিসপত্র।                                                                                        
 হাইকার দের একটি দল  ছেলে মেয়ে মিলিয়ে জনা সাতেক নিশ্চিন্ত  মুখে প্রসন্ন হাসি টি নিয়ে হেঁটে চলেছে  সিনাওয়াভা মন্দির ন্যারোসের  মুখ ছাড়িয়ে আরো  দূর্গম পথ ধরে। সাধারণত  পাহাড়ের ঢাল বেয়ে যে যেমন খুশি উঠে যাচ্ছে তবে তার মাঝেও সহজ পথ চিনিয়ে দেবার জন্য পার্ক রেঞ্জাররা  পাথর সাজিয়ে ট্রেইল চিহ্নিত করে রেখেছে। অতনু বলে দেখ , সাইন বোর্ডের বদলে পাথরের স্তূপের কেয়ার্ন লাগিয়েছে। অযথা এক সাইন বোর্ড বসিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করতে  চায়নি। ওদের দেখে ,ইয়াম পারভীন দের ও ইচ্ছে করে অমনি  পিঠের ওপর রুকস্যাক  হাতে লাঠি নিয়ে হেঁটে যেতে। ঐ ওদের মত অচেনা পথের রহস্যের সন্ধানে। বলে পরেরবার  লম্বা ছুটি নিয়ে হাইকিং করতে বেরোলে বেশ হয়।  তখন পরনের বেশভূষা ধূলি ধূসরিত মলিন হবে ,এতো সুন্দর সোনালী চুল গুলো রুক্ষ হয়ে যাবে  , গায়ের চামড়া পুড়ে কালো হয়ে যাবে । রুক্ষ কঠিন কাঁকুড়ে পথে পা ফেঁটে রক্ত ঝরবে। তবুও  পিঠে  রুকস্যাক হাতে স্টিক নিয়ে দূর্গম পথে এগিয়ে যাবো। পথে অজস্র বিপদের সম্মুখীন হলেও ঠিক হাসি মুখে রুখে দাঁড়াবো । 
                                
ওদের স্বপ্ন ময় চোখের দিকে তাকিয়ে  ভাবছিলাম এই আমিও যদি আরো ত্রিশ টা বছর পিছিয়ে যেতাম তাহলে ওদের ই মত ভয় কে জয় করে ,ঝড় বৃষ্টি তে দৌড়ে যেতাম ঐ পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নিতে। কিম্বা কোনো রেড উডের গাছের বিরাট খোঁদলে বসে রাত ভোর হতে দেখতাম।  পিঠের বোচকা খুলে তাঁবু বার করে খাটিয়ে নিতাম দ্রূত হাতে । দুই পাহাড়ের মাঝের দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঝড় কে রুখতে  তৎপর হতাম। হয়তো পথ হারিয়ে ফেলে অতিথি হতাম পুয়েবেলাদের গ্রামে আদিবাসীদের আস্তানায়।যদিও ওরা এখন আর আগের মত বন্য নেই। তবুও  বরফ ঝরা শীতের রাতে কাঠ কুড়িয়ে এক সঙ্গে গোল হয়ে বসে ওদের মত আগুন জ্বালিয়ে ঝলসানো মাংস খেয়ে ,আগুনে হাত পা পিঠ সেকতাম।  ওদের নাচ গানের সঙ্গী হয়ে  দিন রাত কাটতো প্রকৃতির পথে পথে ঘুরে বেড়িয়ে রৌদ্রে বাদলেঝড় ঝঞ্ঝা মাথায় করে । হয়তো  হিম শীতল তুষারাবৃত পাহাড়ি পথের আস্তানায়। 

         বেলা কখন শেষ হয়ে গিয়েছে  ,অস্তগামী সূর্য আবার  রাঙিয়ে তুলেছে রক্তিম পাহাড় গুলোকে বাস নামিয়ে দিয়েছে পার্কের এক্সিট গেটে। অবাস্তব কল্পনায় এতক্ষণ তন্ময় হয়ে ছিলাম। ভবিষৎ প্রজন্ম কে যত দেখছি মনের মাঝে অদ্ভুত  চঞ্চলতা অনুভব করছি  । নিজের বয়স ,শারীরিক ক্ষমতা স্থান কাল সব ভুলে গিয়ে ওদের মাঝে কেমন করে হারিয়ে যাই বুঝে পাইনা। সম্বিৎ ফিরলো ব্রতীনের ডাকে। আবার ট্যাকোমা  পিকআপ ট্রাকে উঠে বসে পৌঁছলাম  সিলভার ইনের দরজায়। তখন হ্যারি গ্র্যান্ডপা 'র সিলভার ইনের শুভ উদ্ভোধনের  উৎসব  শুরু হয়ে সন্ধ্যে রাতে রীতিমত জমে উঠেছে।                                                                                                        আলোর মালায় সেজে উঠেছে নতুনের সাথে সব পুরোনো হোটেল বিল্ডিং গুলো। পাহাড়ি রানী  ঝলমল করছে আলোর রত্ন সাজে। ঘন সবুজ নরম কার্পেটে ঢাকা  বিশাল সভাকক্ষ থেকে খাওয়া দাওয়া নানা রকম পানীয়র সাথে সিগারেট ,চুরুটের গন্ধ  হাসি গান গল্প আড্ডায় হৈ হৈ ধ্বনি ভেসে আসছে। অতিথি বর্গ সবাই মশগুল আলাপ আলোচনায়। এদিকে মিউজিক রুম থেকে  বিউগলের আওয়াজ তাসা ড্রামের  বিভিন্ন  মিউজিকের শব্দ ভেসে আসছে। হ্যারি সাহেব এবং সিড অতিথি অভ্যাগত দের নিয়ে ভারী ব্যস্ত। আমরাও তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে নিয়ে চলেছি নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। ইয়াম সর্বপ্রথম রেডি হয়ে এগিয়ে গিয়েছে।ব্রতীন বলে ইয়াম আজ so first ready হয়ে গেল কি ব্যাপার ?    কোটের পকেটে মাউথর্গান টি দেখিয়ে ও বলে এখন এই পার্টিতে একটাই মিউজিক বাজবে ,তোরা গান গাইবি , মাউথর্গানে  Tagore 's song  বাজাবো  ''তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে '' ....

Post a Comment

0 Comments