জ্বলদর্চি

সিংহপুরের সুসীমা /পর্ব - ৩/গৌতম বাড়ই


সিংহপুরের সুসীমা -৩

গৌতম বাড়ই 

বঙ্গেশ্বরের স্ত্রী, পিতা ও কন্যার  মাঝে দাঁড়িয়ে দুজনের চরম বাকবিতণ্ডার মধ্যে সে যথাযথভাবে স্বামীর পক্ষ অর্থাৎ কিনা বঙ্গেশ্বরের পক্ষ নিলেন। 

বঙ্গরাণী গর্জিয়ে উঠলেন- " সুসীমা তুমি তোমার সীমা লঙ্ঘন করে চলেছো! ভুলে গিয়েছ তুমি বঙ্গরাজের কন্যা। তোমার মাতাও পাশ্ববর্তী দেশ কলিঙ্গ রাজার কন্যা। এখন রাজরাণীও বটে। একদিন আমি তোমার মতন রাজকন্যাও ছিলাম তাহলে। তবে এ রকম ধৃষ্টতা, এ রকম নিকৃষ্ট দুঃসাহস কোনোদিন আমার ছিল না। কারণ, আমি মনে- প্রাণে বিশ্বাস করতাম আমি রাজকন্যা। আমার আচার আচরণ একজন সাধারন মানুষের মতন হবে না। আমার জীবন- যাপন ও সেরকম অনুসরণ করে চলবে। রাজবংশের মর্যাদা অক্ষুন্ন রেখে আমি আমার কুমারী জীবন কাটিয়েছি। তোমার স্বেচ্ছাচারী জীবন, যেখানে পিতা-মাতার সম্মান, রাজবংশের মর্যাদা সব ভূলুন্ঠিত হয় প্রতি মুহূর্তে। তোমার আস্পর্ধা দেখে শুধু চমক লাগছে না, অবাক হচ্ছি। আমি তোমার প্রতি ক্রুদ্ধ হচ্ছি এখন প্রতি মুহূর্তে তোমার আচরণে। শুধু পিতা নয়, তুমি রাজাকেও অসম্মান করছো। হুঁশে এসো সুসীমা। আমি তোমার গর্ভধারিণী মা বলছি।"

সুসীমা মায়ের প্রতিটি বাক্য মন দিয়ে শুনলো, তারপরে বলল- " এ আর নতুন কথা কী! তোমাদের নীলরক্তের অহমিকা রন্ধ্রে- রন্ধ্রে। আমার মূল বক্তব্য তো ওখানে, সব মানুষ কেন একই চিন্তা ভাবনা নিয়ে এগোবে। তাহলে তো পৃথিবীতে মানুষ বলতে একটি সম-মনের একই সাঁচের গতানুগতিক প্রজাতি থাকত। এত বিভিন্নতা এত বিরোধ থাকতই না। তুমি যুগ যুগান্তের সংস্কার বহন করে চলতে পারো, আমি পারব না। তাতে যদি আমাকে এই কৃত্রিম রাজকীয় সুখ ছেড়ে গৃহত্যাগ করতে হয় , সেটাও ভালো। চাই না আমি এ রাজপ্রাসাদের ঐশ্বর্য। "

রাণী-মা বললেন - " তুমি তাহলে  নিজের গড়া এবড়ো- খেবড়ো পথেই চলবে? এই মনস্থির করে ফেলেছো? 

- " হ্যাঁ, আমার জীবন আমারই, শুধুমাত্র আমার। অন্যকারোর বিন্দুমাত্র অধিকার নাই। তোমার মতন পুরুষ জাতের কাছে সারাটা জীবন মাথা নত করে থাকবার ঝি আমি নই। সে সম্পর্কে আমার পিতা, ভ্রাতা, স্বামী যা হোক না কেন!" মায়ের দিকে মুখ তুলে বলে সুসীমা। 

রাণী চেঁচিয়ে উঠলেন - " মুখ সামলে কথা বলো সুসীমা। তুমি নিজেকে যতই বড় হয়েছ বলে মনে করো না কেন,  আমাদের কাছে একরত্তি একটা বাচ্চা মেয়ে। সন্তানেরা চিরটাকাল পিতা-মাতার কাছে ঐ ছোট্টটি থাকে। "

সুসীমাও এবারে বেশ গলা চড়িয়ে বলে- " মা, তুমি আমায় এর দ্বারা কী বোঝাতে চাইছো? সন্তান নিশ্চয়
তার পিতা-মাতার কাছে ছোট থাকবে, কারণ বয়সে সে তো আর তার জনক- জননীকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে না। সে ছাড়িয়ে যেতে পারবে তার সুগঠিত মনকে উর্দ্ধলোকে নিয়ে যেতে আর তার চেতনা, অনুভব,  শিক্ষায়, দীক্ষায় তাদের ছাড়িয়ে বহুদূর এগিয়ে যেতে। কিন্তু তা পিতা-মাতার কাছে গর্বের। এতে তোমাদের এত  ভয়- ভীতি, সম্মানবোধ কেন? তোমরা যুগ যুগ ধরে একটা বিষয় মনে পোষণ করে চলেছো, শুধু নীলরক্তের চাষ। আমার রক্ত কিন্তু সাধারণ মানুষের মতন লাল। অথচ কী অসাধারণ চিন্তা আমার! যার জন্য বিপাকে পড়েছো তোমরা।"  এই কথা বলেই বঙ্গেশ্বরের মুখের দিকে তাকালেন সুসীমা। 
🍂

বঙ্গেশ্বর হাঁক দিলেন রাজাধিরাজ তুঙ্গ মেজাজে। যে হাঁকেই ভরা দরবার কেঁপে ওঠে। রাজসভার সভাসদদের পিলে চমকে ওঠে। এই বুঝি মাথার উপরে ঝোলানো ঝাড়বাতি খসে পড়ে ভরা সভায়। আস্তাবলে ঘোড়ারা সমবেতে চিঁহি করে ওঠে। অথচ রাজকন্যা সুসীমা ভয়ডর হীন, অনন্ত অসীম এক বিশাল জলরাশির মতন গভীরতা নিয়ে বেজায় শান্ত। বঙ্গেশ্বর তার তরুণ সেনাধ্যক্ষ, যার কর্মকুশলতা আর অস্ত্রের পারদর্শিতার জন্য, অল্প কয়েক বছর তার সেনাদলে নিযুক্ত হয়ে সেনাধ্যক্ষ পদে উন্নীত হয়েছেন। ডাকলেন হাঁক পেড়ে তাকে - " অনুর, অন্দরমহলে এসো।" যে হাঁকডাক দেহলীতে, প্রবেশ তোরণেও দাঁড়িয়ে শোনা যায়। 

অনুর রাজহুকুম কানে শোনামাত্রই অন্দরমহলে দ্রুত এসে হাজির হয়। সুসীমা আড়চোখে অনুরের দেহসৌষ্ঠবে চমকিত হয়। অনুরকে এই প্রথম দেখলো, অবশ্য এই সেনাধ্যক্ষের নাম শুনেছে দাসদাসীদের কাছে এক- দুবার।  এমন মনোমুগ্ধকর পুরুষালী চেহারা রাজার সৈন্যদলে এবং সান্ত্রীদের মাঝেও চোখে পড়ে না সচরাচর। সুসীমা ভাবে, একে আগে তার নজরে পড়লো না কেন? অনুরও ঠিক সুসীমার মতন আড়চোখে রাজকন্যাকে দেখে মোহিত হয়। একই অঙ্গে এত রূপ ঢেলে দিয়েছে শুধু একজনের ওপর! কে তুমি ঐ রূপদর্শী ঈশ্বর? চকিতে দুজনের চারচোখের মিলন হলো। রাজা অনুরকে অন্দরমহলের বাইরের ঘরে অপেক্ষা করতে বললেন। রাজকন্যাকে জলদগম্ভীর কন্ঠে বললেন- " আজ থেকে তোমার অন্তঃপুরের বাইরে প্রবেশ নিষেধ। স্বাধীনতা শব্দের মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়। তুমি বাগানের সদ্য ফোঁটা গোলাপ, কী করে জানবে সমস্ত বাতাসের গতিবেগ? বৃন্তচ্যূত হতে  সময় বেশি লাগে না সদ্য ফোঁটা গোলাপের !  তোমার ন্যায়- অন্যায় বোধ নেই। পিতা- মাতাকে যিনি সম্মান করেন না, তিনি আর যাই হোক সুস্থ ও ভালোমানুষ নয়। আমি পিতা হয়ে আর তোমার সাথে ঐ কু- তর্কে জড়াতে চাই না। তুমি রাজপ্রাসাদের ভিতর নিজের কক্ষে এখন প্রবেশ করো। আজ থেকে তুমি আমার সান্ত্রীদের এবং আমার সেনাপতি অনুরের কড়া নজরের ঘেরাটোপে থাকবে। এর অন্যথা হলে ভয়ানক বিপদ হবে। এইটুকু আমার শেষকথা। চললাম।" এই বলে রাজা অন্দরমহলের বাইরের কক্ষে চলে যেতে উদ্যত 
হলেন।

সুসীমা স্থির হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার চোখের মণি স্থির আর জ্বলছে,  ঠিকরানো লাল আলো হয়ে। বলে উঠলেন- " পিতা আপনি আমায় ঘুরিয়ে সেই বন্দী করলেন তো? কারাগারে বন্দী তো একেই বলে। শুধু স্বেচ্ছাচারী বলে আমায় দাগিয়ে যান সবসময়। আপনার স্বাধীনতা সম্বন্ধে কতটুকু জানা আছে? ভিন্ন মতামত যে মেনে নিতে পারে না, অতি নিকট বা দূরের কারোর থেকে, সে কীভাবে বোঝাবে স্বাধীনতার মানে ? আপনি পারবেন আমায় চিরজীবন অন্তঃপুরের ভিতর বন্দী করে রাখতে? আপনার বহু কথিত রাজরক্ত আমার ভিতরেও বইছে কিন্তু, এ কথা ভুলে যাবেন না। শুধুমাত্র স্মরণ করিয়ে দিলাম।"

বঙ্গেশ্বর চকিতে ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন- " আমি এরকম দুর্বিনীত আত্মজার কাছ থেকে কোনও জ্ঞানপাঠের ভাষা শুনতে চাই না। তুমি যদি মনে করো আজ বৃহত্তর জগত থেকে এই ক্ষুদ্র পরিসরে বন্দী, তো বন্দী! স্বাধীনতা উপভোগ করতে জানতে হয়। স্বাধীনতার অপব্যবহার করতে নাই। তোমার সীমানা আমি এক ছোটো পরিসরেই করে দিলাম। তোমার নামটি সার্থক হবে এরপর,  জেনে রেখো, এই ক্ষুদ্র গন্ডী অচিরেই হবে তোমার নামের সাথে সঙ্গতি রেখে একদম উপযুক্ত , ঐটাই  তোমার সু- সীমা। "

- "একে অপব্যবহার বলে না । আমি আপনার প্রদেয় স্বাধীনতা অপব্যবহার করি নাই। আমি তো স্বাধীনতা উপভোগ করছিলাম সদ্যমাত্র। আমি আমাকে চিনি না এখনও, আপনি আমাকে চিনবেন? এতোই সোজা! নিজেকেই আপনি চেনেন কি? আপনার হুকুম আপনার বেতনভূক কর্মচারী আর পোষ্যভৃত্যরা পালন করবে। রক্তের  সম্পর্কে এই রাজবংশে আমারও কিছু অধিকার আছে। আমার সৃষ্টিতে আপনাদের  ভূমিকা থাকলেও , বয়সের সিঁড়ি বেয়ে একবার অন্তরের নিজস্বতা তৈরী হয়ে গেলে, সেখানে তাদের পূর্ণ অধিকার কিছু করবার,আর তাই হল জন্মগত অধিকার। দোহাই আপনারা রাজবংশের গরিমা আমার মনের ওপর সেঁটে দেবেন না।"

রাজা যারপরনাই রাগাম্বিত হয়ে রাণীমার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় কিছু বললেন। এরপরে সেনাপতির সাথে দেখা করতে অন্যকক্ষে গেলেন। রাণীমা সুসীমাকে নিয়ে অন্দরমহলের ভিতরে ঢুকে গেলেন। সুসীমা শান্ত স্থির হয়েই ভিতরে চললেন রাণীমার সাথে। সুসীমা শুধু বললে- " আমাকে গৃহবন্দী কেন? ইঙ্গিতে আর আকারে- প্রকারে তো বোঝা যাচ্ছে তোমরা আমায় ঘেরাটোপে বন্দী রাখতে  চাইছো? দোহাই মা!  আমায় তারচেয়ে ভালো খোলা প্রকৃতির কাছে ছেড়ে এসো। আমি একবস্ত্রে এই রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে গিয়ে মুক্তি চাই। আমি চাই না এই কৃত্রিম রাজকীয় ভোগবিলাস স্বাচ্ছন্দ্য। আমি পাখির মতন, আমি হরিণের মতন মুক্তি চাই। " রাণীমা দৃঢ় পদক্ষেপে সুসীমাকে নিয়ে অন্দর থেকে অন্দরমহলের আরও গভীরে মিলিয়ে যেতে থাকলেন। 

সেদিন মধ্যাহ্নে সূর্যালোকের সবিশেষ উজ্জ্বলতা ছিল না। কিন্তু বঙ্গেশ্বরের রাজপ্রাসাদে এই ম্লান আলোতেও সুন্দরী সুসীমার অঙ্গ থেকে ঠিকরে  পরা আলোর  ঝলকানিতে , অন্দরমহলের বিশ্বস্ত দাসদাসী আর কর্মচারীরা সেই রূপের ছটায় মুগ্ধ হলেন আরো একবার। ঈশ্বরের একদম নিজের হাতে সৃষ্টি যেন এই মানবী প্রতিমা। রূপের অহঙ্কার নেই, রাজবংশের গরিমা নেই, যেটুকু বিরোধ তা রাজা- রাণী আর তার মেয়ের একদম নিজস্ব। প্রতিটি কর্মচারী অন্তর থেকেই এই ষোড়শীকে গভীরভাবে ভালোবাসে। এরকম এক ভালোবাসার জনকে বঙ্গেশ্বর বজ্রকঠোর আদেশে চিরটাকাল বন্দী করে রাখতে পারবে অন্তঃপুরে? বাড়ির অন্দরমহলের প্রতিটি ইমারতি দ্রব্য তারাও বুঝি এতে সায় দেয় না। 

এই ঘটনাগুলো ঘটে চলেছে আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এই বঙ্গদেশে। তথাগতের আবির্ভাব হয়ে গিয়েছে। রচনা হয়ে গিয়েছে রামায়ণ আর মহাভারতের মতন অমর মহাকাব্যের। তারও অনেক অনেক আগে রচিত হয়েছিল বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ, গীতা। ইতিহাস তখনও সত্যমিথ্যা কাহিনী নিয়ে পুরোপুরি মানুষের জীবনে হাজির হয়নি। 

ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments