পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৮২
শিয়াল শকুনি
ভাস্করব্রত পতি
জিতাষ্টমী পরবকে বাঁকুড়া জেলার কোথাও কোথাও বলে 'শিয়াল শুকনি' বা 'শিয়াল শকুনি' পরব। আসলে এটি জীমূতবাহনের পূজো। মানভূমে একে 'বড়ষাট' বা 'জীতাষষ্ঠী'ও বলে। এটি রাঢ়বঙ্গের একটি প্রাচীন লোকাচার। সন্তান সন্ততির সুস্থতা এবং দীর্ঘায়ু কামনা করে উপবাসে থেকে এই ব্রত পালিত হয় শ্রদ্ধাশীল হয়ে।
'সন্তানের মঙ্গল কর
শিয়াল শকুন মিতা।
জীমূতবাহন বাঁচাই রাখ
তুমিই মাতা পিতা।'
একটি নতুন মাটির হাঁড়িতে মাটির তৈরি শিয়াল ও শকুনির মূর্তি রাখা হয়। তাতে প্রসাদ হিসেবে রাখা হয় শশা, কলা, বোঁটা সমেত আতা, ভেজানো কলাই এবং মটর। এছাড়া পুজোতে প্রয়োজন হয় শালুক ফুল। জীতাষ্টমীর দিন সন্ধ্যা থেকে রাতের চার প্রহরের প্রতিটি প্রহরে চার বার করে পুজো করা হয়। পুজোর স্থানে রাখা হয় ধান, হলুদ গাছ, কালোকচু, বটের ডাল এবং মানকচু। এই চার প্রহর ধরে গৃহিণীরা তাঁদের সন্তানদের মঙ্গল কামনার জন্য জেগে থাকেন।
জীমূতবাহনের পূজোর শেষে ব্রতীনীরা শোভাযাত্রা সহকারে নদীতে, পুকুর ঘাটে যায়। যাওয়ার সময় বলতে থাকে --
'শিয়াল গেল খালে
শুকনি গেল ডালে
ও শিয়াল মরিস না
লোক হাসাহাসি করিস না'।
পুকুর বা নদীর ঘাটে গিয়ে মাটির তৈরি শেয়াল শকুনিকে রেখে পূজো করে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
'শিয়াল গেল খালকে
শসা ডুবা কালকে,
এ শিয়াল যাস্ না
ছেলেগুলাক কাঁদাস না।'
এই ভাসানের কাজে পুরুষদের অংশগ্রহণ করতে দেখা যায় না। জলে ভাসানোর সময় ছড়া কেটে বলে --
'জিৎবাহন শিয়াল শুকনি
বছর বছর ফিরো
চিড়া দই গুড় দেবো
পেট পুরে খেও।'
এরপর ব্রতীনীরা ডুব দেওয়ার সময় শসায় আড়াই কামড় দেয়।
'শসা ডুবা আড়াই কামড়
ব্রতীরা সব হাকড় মাকড়,
ব্রতীনীরা ডুব দেয়
উপর থেকে জীবিতবান
মহান বর দেয়।'
এছাড়াও এই সময় ছড়া কেটে বলা হয় ---
'শিয়াল শুকনি পরম মিতা
শসা কামড় গোটা গোটা,
শিয়াল শুকনি রুষ্ট হলে
ব্রত হয় না উপাস দিলে।
আচার বিচার করলে পর
জীবিতবান দিবেক বর।
পুত্র পৌত্রে ভরে ঘর
আর থামে যমের ডর।'
সেইসাথে নদীর পাড়ে বসে মটর কলাই, মুড়ি, শসা খেয়ে ব্রত ভঙ্গ করে সবাই।
'ন’পুয়া কলাই ভিজা
ন'টি শসা গোটা।
এসবগুলা পালতে হবে
জীবিতবানের লেঠা।'
এই লৌকিক উৎসবে দুই ইতর অবলা প্রাণী শিয়াল এবং শকুন পুজো পায়। যা বেশ চিত্তাকর্ষক। শিয়ালের বিজ্ঞানসম্মত নাম Canis aureus। আর শকুনের বিজ্ঞানসম্মত নাম Gyps indicus। এই মুহূর্তে এই দুটি প্রাণীই লুপ্তপ্রায় হতে চলেছে। কিন্তু হিন্দু সংস্কৃতিতে এঁরা রীতিমতো পূজা পায়। তবে মাটি দিয়ে তৈরি করা হয় উৎসবের শিয়াল শকুনি। গবেষক মেঘদূত ভুঁইয়ের মন্তব্য এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখেছেন, "সন্তানের দীর্ঘায়ু কামনায় পশুপাখির পূজা করা অনার্য যুগ থেকে প্রবাহিত হয়ে আসছে। সন্তান বা মানুষের মৃতদেহ ওই দুই পশুপাখি খায় অর্থাৎ যাতে তাঁরা সন্তানের দেহ না ভক্ষণ করে, মানে — যাতে তাঁদের মৃত্যু না হয়, তার জন্য তাঁদের পূজা দিয়ে সন্তুষ্ট রাখা হয়।" প্রচ্ছন্নভাবে এই দুই প্রাণীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় এই উৎসবে। তবে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, প্রাচীন মিশরীয়রা শকুনের দেবী হিসেবে 'নেখেরেৎ'কে পূজা করতো। এখানকার হিয়েরকোন পোলিশকে নিয়ে যে রাজ্য গড়ে উঠেছিল তার প্রধান দেবী ছিলেন এই 'নেখেরেৎ'। তিনি নাকি পিরামিডকে রক্ষা করতেন। এছাড়াও মিশরের শিয়াল দেবতার নাম 'অনুবিস'। তিনি ছিলেন মিশরীয়দের পরলোকের দেবতা। কেরালার কোল্লামে মায়ামকোট্টু মালাঞ্চরুভু মালানাদ মন্দিরে মহাভারত খ্যাত শকুনির পূজো হয়।
শিয়াল শকুনি লৌকিক উৎসবের সূচনার কাহিনী লুকিয়ে আছে দুই চরিত্র অপর্ণা ও অঞ্জনাকে কেন্দ্র করে। ছড়ায় পাই --
'অপর্ণা আর অঞ্জনা
দুই সতীনের ঘর,
ব্ৰত ভ্ৰষ্টে শিয়াল শুকনি
দু'জন হল পর।'
মথুরানগর এলাকায় অপর্ণা ও অঞ্জনা নামে দুজন সতীনের বসবাস ছিল। তাঁরা শুদ্ধাচারে এবং উপবাসে থেকে ব্রত পালন না করে গোপনে খাবার খেয়ে নেয়। তাঁদের এই নিয়মবহির্ভূত কাজে অভিশাপগ্রস্ত হয়। ফলে তাঁদের শিয়ালিনী ও শকুনি রূপে জন্মগ্রহণ করতে হয়। শকুনির জন্য নির্ধারিত হয় বটবৃক্ষের শাখা আর শিয়ালিনীর জন্য এই বৃক্ষতলের খাল।
'শিয়াল গেল খালকে
শুকনি গেল ডালকে,
শসা ডুবা কালকে
ঘুরে ফিরে দেখা হবেক,
কদম গাছের তলকে।'
একদিন এই বটবৃক্ষতলে জিতাষ্টমীর ব্রত পালন হচ্ছিল। তা দেখে তাঁদের মনে তা পালনের সাধ জাগে। দিনের বেলা দু'জনেই উপবাসে ছিল। কিছুই খায়নি। কিন্তু রাতের বেলা শিয়ালিনীর খিদের জ্বালা সহ্য করা মুশকিল ছিল। সে তখন প্রথম প্রহরে মাছ, দ্বিতীয় প্রহরে কীটপতঙ্গ খেয়ে নেয়। তৃতীয় প্রহরে শিয়ালিনীকে শকুনি জিজ্ঞেস করলে সে মিথ্যাভাবে জানায় যে সে নির্জলা ব্রত পালন করছে। উপবাসেই আছে। কিন্তু শিয়ালিনীর এই ছলচাতুরি ধরে ফেলে শকুনি।
এদিকে নিয়ম না মেনে ব্রত করার কারণে শিয়ালিনীর ঘোর দুর্দিন এলো। তাঁর বাচ্চাগুলি জন্মের সাথে সাথেই মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ল। এদিকে শকুনির বাচ্চাগুলো বহাল তবিয়তে খেলছে, ঘুরছে। তা দেখে শিয়ালিনীর মাথা খারাপ। শকুনি জানায় যে জিতাষ্টমী ব্রত শুদ্ধাচারে পালন না করার জন্য শিয়ালিনীর এই দশা। তখন দু'জনের মধ্যে শুরু হল তুলকালাম ঝগড়াঝাঁটি। ঝগড়া করতে করতে তাঁরা দুজনেই ধোপার কাপড় কাচা গরম কড়াই ভর্তি জলে পড়ে মারা যায়। ধোপা তখন দুজনের দেহ নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়।
এদিকে ঐ দু'টি দেহ দেবতার কৃপায় দুটি নীল রঙের শালুক হয়ে ভাসতে ভাসতে পৌঁছে যায় কর্ণাট রাজ্যে। তখন কর্ণাট রাজ্যের রাণী কুম্ভবতী এবং পাত্রপত্নী প্রভাবতী নদীতে স্নান করছিলেন। তাঁরা দুজনেই দুটি ফুলকে জল থেকে তুলে খেয়ে নেয়। অবশেষে দুজনেই গর্ভবতী হয়ে পড়ে। প্রত্যেকের একটি করে কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে যথা সময়ে। কুম্ভবতী মেয়ের নাম রাখে চম্পকমালিনী। আর পাত্রপত্নী প্রভাবতী মেয়ের নাম রাখে মনোরমা।
বেশ কয়েক বছর পরে তাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাঁদের বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়। চম্পকমালিনীর বিয়ে হয় কর্ণিকাপুরীর রাজার সঙ্গে। আর মনোরমার বিয়ে হয় রাজার ছেলের সঙ্গে। কিন্তু দেখা যায় মনোরমার সন্তানেরা বেঁচে থাকলেও চম্পকমালিনীর সন্তানদের মৃত্যু ঘটে। প্রচণ্ড রাগ, ক্ষোভ এবং ঈর্যায় চম্পকমালিনী গোপনে মনোরমার সন্তানদের নাক কান হাত কেটে দেয়।
কিন্তু জীমূতবাহন সহায় ছিল মনোরমার। তাঁর দয়ায় মনোরমার সন্তানদের কোনো ক্ষতি হলো না। নিজের অপকর্মের কথা ভেবে অনুশোচনায় চম্পকমালিনী ঠিক করল যে সে আত্মহত্যা করবে। কিন্তু যথাযথ সময়ে দেবী দুর্গার অনুরোধে শিব চম্পকমালিনীকে আত্মহত্যা থেকে বিরত করে জিতাষ্টমী ব্রত পালনের মাধ্যমে নিজের পাপ স্খলনের কথা জানায়। তখন চম্পকমালিনী মনের যাবতীয় হিংসা দ্বেষ ছেড়ে পরম ভক্তি সহকারে জীমূতবাহনের ব্রত পালনে রত হয়। ফলশ্রুতিতে তাঁর সন্তানরা প্রাণ ফিরে পেল এবং দীর্ঘায়ু লাভ করল। আর ধীরে ধীরে মর্ত্যলোকে জীমূতবাহনের সঙ্গে শিয়াল শকুনির পূজা প্রচলন হল।
গবেষক মানিকলাল সিংহ এই 'শিয়াল শুকনি' বা 'শিয়াল শকুনি' উৎসব সম্পর্কে লিখেছেন, "বিষ্ণুপুরের শিয়াল শকুনি ব্রতের মধ্যে এমনই একটি সুন্দর ধর্মীয় লোকসংস্কার রহিয়াছে। রাঢ়বঙ্গের মেয়েদের ব্রতপালন একদিকে যেমন কষ্টদায়ক আর একদিকে তেমনই আত্মসুখবর্জিত ত্যাগ ভক্তি আর নিষ্ঠার পরিচায়ক। আত্মসুখ বিসর্জন দিয়া নিষ্ঠা, ভক্তির সহিত দেবতার পূজা করিলে যে সর্বসুখ লাভ হয় ইহাই বাঙালি মেয়েদের ব্রতের মূলকথা। শুধু নরনারী কেন, ইতর শিয়াল শকুনির মত নিকৃষ্ট জীবজন্তুও ব্রত পালন করিয়া ফুল হইয়া ফুটিতে পারে — জন্মান্তরে রাজকন্যা, মন্ত্রীকন্যা, রাজরাণী হইয়া পরমসুখে থাকিতে পারে, শিয়াল শকুনির ব্রতের মধ্যে তাহারই ইঙ্গিত রহিয়াছে। মল্লরাজা বীরহাম্বীর, রঘুনাথসিংহ, বীরসিংহ, দুর্জনসিংহ, গোপালসিংহকে কাল হরণ করিয়াছে। মল্লরাজ্য কবে বিনষ্ট হইয়াছে, কিন্তু মল্লরাজাদের মানবিক আদর্শ মল্লভূমের নরনারী ব্রতপালনের ভক্তি, নিষ্ঠা তেমনি রহিয়াছে।"
0 Comments