জ্বলদর্চি

ভাদুর উৎস সন্ধানে(শেষ অংশ)সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব - ৮১
ভাদুর উৎস সন্ধানে(শেষ অংশ)
সূর্যকান্ত মাহাতো

একদিকে বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত, সুধীর কুমার করণ এবং 'বিশ্বকোষ' এর লেখক নগেন্দ্রনাথ বসু রাজ-পরিবারের কাহিনীকে 'প্রবাদ', 'কিংবদন্তি', 'কাহিনী' রূপে হলেও একরকম মান্যতা দিয়েছেন। আনন্দবাজার তো জোর দিয়েই বলেছেন, কাশীপুরের রাজবাড়িই ভাদু উৎসবের উৎস। অন্যদিকে কিন্তু আশুতোষ ভট্টাচার্য, তরুণদেব ভট্টাচার্য এবং রামশংকর চৌধুরীর মতো লেখকেরা রাজকন্যার কাহিনীকে একরকম অস্বীকার করেছেন। এবং রাজকন্যা 'ভদ্রেশ্বরী' থেকে যে 'ভাদু' নামের উৎপত্তি হয়েছে তাতেও তাঁরা দ্বিমত প্রকাশ করেছেন।

এখন প্রশ্ন হল, রাজ পরিবারে যদি 'ভদ্রেশ্বরী' নামে কোন রাজকন্যা ছিলই না, তাহলে এমন একটা কাহিনীর জন্ম হল কীভাবে? আনন্দবাজার পত্রিকায় বা কেন লেখা হল, "শুরুর গল্প যাই হোক না কেন ভাদু উৎসবের উৎস কিন্তু সেই কাশীপুরের রাজবাড়িই।"(আনন্দ বাজার পত্রিকা, ২৬/১২/২০১৭)

এ বিষয়ে লেখক 'তরুণদেব ভট্টাচার্য' এর একটা উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। 'ভদ্রেশ্বরী' নামে রাজকন্যাই যে 'ভাদু' এমন কিংবদন্তিটির প্রচলিত হওয়া কিংবা তার উৎসের পিছনে মূল কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, এই কাহিনী গড়ে ওঠার পিছনে মূল কারিগর নাকি ছিলেন 'রিজলে' সাহেব। "The Tribes and Caste of Bengal" (1891), page- 41 গ্রন্থে 'ভাদু উৎসবের' কথা 'রিজলে' সাহেব উল্লেখ করেছেন। রিজলে সাহেব মানভূম ও বাঁকুড়া জেলায় 'ভাদু' নামে এক মূর্তি নিয়ে স্থানীয় মানুষদেরকে নাচ-গান সহ শোভাযাত্রা করতে দেখেছিলেন। ওই মূর্তি নাকি পঞ্চকোট রাজ্যের প্রিয় কন্যা, এমনটাই 'কথিত' বলে তিনি মনে করেছিলেন। সেই কন্যার নাকি কুমারী অবস্থায় মৃত্যু ঘটেছিল। এবং এই উৎসবটি তারই স্মৃতিরক্ষায় সংঘটিত হচ্ছিল, এরকমটাই তিনি অনুমান করেছিলেন। এখন প্রশ্ন হল, তাহলে কি পরবর্তীকালে লেখকেরা রিজলে সাহেবের বই থেকেই এই তথ্য গ্রহণ করেছিলেন? নাকি রাজপরিবারের সঙ্গে সত্যিই কিছু যোগসূত্র আছে? নয় তো পরবর্তীকালে এমন গান রচিতই বা হয়েছিল কেন?
"কাশীপুরের রাজার বিটি বাগদি ঘরে কি কর
হাতের জালি কাঁখে লয়ে সুখ সায়রে মাছ ধর।
মাছ ধরনে গেলে ভাদু ধানের গুছি ভাঙ্গিও না
একটি গুছি ভাঙলে পরে পাঁচসিকা জরিমানা।"
কিংবা---
'কাশিপুরের রাজার বিটি সোনার খাটে বসন
রপার খাটে চরণ দিয়া হীরায় দাঁত ঘষণ।'
এ দুটো গানই কি তাহলে স্রেফ জনশ্রুতির উপর নির্ভর করেই রচিত হয়েছিল? তবে গান দুটি প্রসঙ্গে অনেকেই বলেছেন এগুলো নাকি পরবর্তীকালে রচিত হয়েছিল। কারণ তরুণদেব ভট্টাচার্যও পরিষ্কার বলেছেন, "রিজলে সাহেবের অনুমান উপযুক্ত তথ্য ও প্রমাণের উপর ভিত্তি করে গ্রথিত হয়েছিল বলে মনে হয় না" (পুরুলিয়া, পৃষ্ঠা- ২৫৯) সত্যিই তো, রিজলে সাহেব যদি একটু অনুসন্ধান করতেন তাহলে রাজকন্যা 'ভদ্রেশ্বরী'ই যে 'ভাদু' এমন কাহিনী বা কিংবদন্তির জন্ম হয়তো বা হতো না।

তাহলে রাজ পরিবারের সঙ্গে যোগসূত্র কি? যোগসূত্র তো অবশ্যই আছে। কারণ ভাদু পূজা বা এই উৎসব প্রচলনে রাজ পরিবারের এক বিরাট অবদানের কথা সকলেই স্বীকার করে নিয়েছেন। রাজ- পরিবার ছাড়া যা সম্ভব হত না। তাইতো প্রজারা গেয়ে থাকেন,
"কাশিপুরের মহারাজা
সে করে ভাদু পূজা।
হাতেতে মা জিলিপি খাজা
পায়েতে ফুল বাসাতা।"

যাই হোক কীভাবে পালিত হয় এই উৎসব? সারা ভাদ্র মাসই হল এই উৎসবের সময়কাল। কোথাও ভাদ্র মাসের প্রথম দিনই ভাদুর মূর্তি এনে বাড়িতে স্থাপন করা হয়। কোথাও বা ভাদ্র সংক্রান্তির আগের দিন। তবে বেশি জাঁকজমক হয় মূলত সংক্রান্তির দিন ও তার আগের দিন। সংক্রান্তির তিথির আগের রাতটি হল মূল উৎসবের রাত। ওই রাতকে 'ভাদু জাগরণ' বা শুধু জাগরণও  বলে। সকলেই ঐদিন গানে গানে ভাদুকে আবাহন করে থাকেন--"আদরিনী ভাদুরানি এলো আজি ঘরকে।"
মেরাপ বেঁধে বা সাজিয়ে ভাদু মূর্তিকে স্থাপন করা হয়। ফল মিষ্টি ও অন্যান্য খাদ্য সামগ্রী থালায় সাজিয়ে ভাদুর চারপাশে সুসজ্জিত ভাবে রাখা হয়। এরপর বিবাহিতা অবিবাহিতা সর্বস্তরের মহিলারা সমবেত হয়ে বসে পড়েন সংগীতের আসরে। তাদের মুখ নিঃসৃত সংগীতে গোটাপাড়া মুখরিত হয়ে ওঠে। গানে গানে ভাদুকে আবাহন করা হয়। 

"ভাদুর আগমনে
কি আনন্দ হয় গো মোদের প্রাণে
ভাদু আজি ঘরে এলো গো এলো গো শুভদিনে।
মোরা সাজি ভর্তি ফুল তুলেছি যত সব সঙ্গীগনে।"

তবে এই গানে কোন ধরণের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয় না।

'সঙ্গীত' যেহেতু এই উৎসবের মূল প্রাণ তাই সংগীতের বিষয়ও বেশ উল্লেখযোগ্য। সমকালীন যে কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনাই ভাদু গানের বিষয় হয়ে ওঠে। ভাদু গানের বিষয় কোনো সুনির্দিষ্ট সীমারেখায় সীমাবদ্ধ নয়। আগমনী থেকে শুরু করে রামায়ণের বনবাসের কথা, সীতার দুঃখের কথা যেমন আছে তেমনি গোপালদের সঙ্গে কৃষ্ণের প্রেম খেলাও স্থান পেয়েছে। তবে ভাদু যেহেতু ঘরের মেয়ে তাই গানে গানে 'গার্হস্থ্য' জীবনের সুখ-দুঃখের কথায় বেশি বেশি করে প্রতিফলিত। শুধু তাই নয় ঐতিহাসিক ঘটনাও স্থান পেয়েছে ভাদু গানে। যেমন ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের 'সিপাহী বিদ্রোহ' থেকে 'দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ' সবই গানে গানে গীত হয়েছে। আবার রেলপথ বিস্তারের কথাও টুসু গানে প্রতিফলিত---
"ভাদু মা আসিবেন বৈল্যে
রেল বঁসাইছি দুয়ারে
যখন খুশি তখন আসেন
ভাবনা কিসের অন্তরে।"

অন্যান্য গানের সঙ্গে ভাদু গানের কি কোথাও মিল রয়েছে? নাকি ভাদু গানেরও একটি নিজস্ব ধারা আছে? এ প্রশ্নের উত্তরে রামশঙ্কর চৌধুরী জানাচ্ছেন, "ভাদু গানেরও একটি নিজস্ব কাঠামো আছে যা অন্যান্য লোকসঙ্গীতের কাঠামো থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।" (ভাদু ও টুসু, পৃষ্ঠা- ১৫) গানের রচনা পদ্ধতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে উনি বলেছেন, ভাদুগান দু- রকমের। একটি হল, দুই চরণের ধুয়া দিয়ে গানের শুরু হয়, পরে চার চরণের সম্পূর্ণ গান। অন্যটি হলো এর বিপরীত। আগে চার চরণের গান, তারপর দুই চরণের ধুয়া ( ভাদু ও টুসু, পৃষ্ঠা- ১৫) তবে ভাদুগানে তিনি রামপ্রসাদী গানের সুরের সঙ্গে কিছুটা মিলের কথা উল্লেখ করেছেন। এদিকে 'বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত' আবার 'ভাদু' গানে 'টুসু' গানের সুরের প্রভাবের কথা বলেছেন (ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য, পৃষ্ঠা ১০১) টুসু গানের মতো ভাদু গানেও নাকি প্রতিদ্বন্দ্বিতার লড়াই বিশেষভাবে দেখা যায়। যেমন---
"তদের ভাদু অনামুখী লো ভেবে দেখ মনে মনে
তপড়াগালি চেপটাবুকি পান্তাখাকি তার সনে
আমার ভাদুর স্বর্গশোভা লো তোদের পাতাল ভুবনে
সত্য মিথ্যা দেখ না চেয়ে চোখ থাকতে অন্ধ কেনে।"
🍂

কিংবা---
"ও পাড়াতে দেখে এলাম চিপসে ভাদু গড়েছে
লড়ে না চড়ে না ভাদু সন্নিপাতে ধরেছে।"

মেয়েদের মতো পুরুলিয়া জেলায় পুরুষেরাও কিছু কিছু জায়গায় ভাদুর অনুকরণে এক রকমের উৎসব পালন করে থাকে। তরুণদেব ভট্টাচার্য তাঁর 'পুরুলিয়া' গ্রন্থে ওই উৎসবকে 'ভাদা' উৎসব বলে উল্লেখ করেছেন। (পুরুলিয়া, পৃষ্ঠা- ২৬০) সেই সঙ্গে বীরভূম, বাঁকুড়া জেলাতেও কিছু কিছু জায়গায় 'ভাদু' মূর্তি নিয়ে পুরুষেরাও যে নাচ গান করে থাকেন, সে কথা রামশঙ্কর চৌধুরীও বলেছেন "ভাদু ও টুসু" গ্রন্থে।( পৃষ্ঠা-২৩)

'ভাদু' না 'টুসু' কোনটি বেশি প্রাচীন? এ প্রশ্নের উত্তরে প্রায় সকলেই একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন টুসুই বেশি প্রাচীন। 'ভাদু' অনেক পরবর্তীকালের। উনবিংশ শতাব্দীর কাছাকাছি। তাই 'ভাদু' যে টুসুর অনুকরণেই গড়ে উঠেছে এ নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। টুসু বিসর্জনের মতো ভাদ্র সংক্রান্তিতে ভাদুর বিসর্জন ঘটে। তাই ওই দিন একটা বিরহ ও বিষণ্নতার আবহ ঘিরে থাকে মন ও প্রাণ জুড়ে। ভাদুকে বিদায় দিতে মন যেন কিছুতেই চাইছে না। তাই গানে গানে সেই মনোবাঞ্ছাই যেন প্রকাশ পাচ্ছে---
"ভাদু বিদায় দিতে
প্রাণ আমাদের চাইছে না কোনমতে"

এই বিষণ্নতার মাঝেও কোথাও যেন উৎসবের খুশিটাই বড় হয়ে উঠে। এবং সেটাই সব থেকে বেশি আনন্দের। সেটাই বা কম কী!

তথ্যসূত্র: ১) পুরুলিয়া/ তরুণদেব ভট্টাচার্য
২) বাংলার লোকসাহিত্য, ৩য় খণ্ড/ আশুতোষ ভট্টাচার্য
৩) ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য/ বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত
৪)সীমান্ত বাংলার লোকযান/ সুধীর কুমার করণ
৫) ভাদু ও টুসু/ রামশঙ্কর চৌধুরী
৬) আনন্দবাজার পত্রিকা
৭) বিশ্বকোষ/ নগেন্দ্রনাথ বসু

Post a Comment

0 Comments