জ্বলদর্চি

মিষ্টু /শুভশ্রী রায়

ছোট গল্প
মিষ্টু
শুভশ্রী রায়

     মিষ্টুর কুড়ি বছরের জন্মদিন তিন দিন আগে হয়ে গেছে। সে দিন সব বন্ধু আসতে পারেনি। তাই বাগবাজারের বাড়ীতে ছোটখাটো জমায়েত রাখা হয়েছে আজ, রবিবার বিকেলে। কফি কেক, ডালমুট আর ছয় বন্ধু মিলে তুমুল আড্ডা হচ্ছে। বন্ধুদের ঘরোয়া আড্ডায় যা হয়, দুনিয়ার সব বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে। এক সময় ভূতের কথাও উঠল। 
    বন্ধুদের মধ্যে পিয়ালি একটু ভীতু। সে বলে উঠল- আজকের দিনে ভূতের কথা না বললেই নয়? এত বড় বাড়ী আমাদের, রাতে উঠে বাথরুম যাওয়ার সময় ভয় লাগবে। তখন তো তোরা পাশে থাকবি না। ছাড় না বাবা ভূতটূত!
   কথাটা মিষ্টুর মা'র কানে গেছিল। মেয়ের ঘরে ঢুকে পিয়ালির মাথায় হাত রাখলেন তিনি। বললেন- "ভয় পেয়ো না। প্রথম কথা, ভূতপ্রেত আছে কিনা সেটাই বিতর্কিত। তার ওপর, তারা যদি থাকেও, সব সময়ে ভয় দেখায় না, ক্ষতিও করে না।"
   মিষ্টুর বন্ধুরা মালিনীর কথা শুনছিল। উনি একটা স্কুলে পড়ান। তবে একটুও গম্ভীর নন। পিয়ালি, রাখী, সুমনা, চৈতালি আর পূর্বা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। রাখীই বলল- "মনে হচ্ছে মাসীমা কিছু জানেন!" মালিনী উত্তর না দিয়ে একটু হাসলেন। ব্যাস, ওরা গল্পের গন্ধ পেয়ে গেছে! সবাই বলতে লাগল- মাসীমা, বলুন, বলুন ভূতের গল্প বলুন। ছাড়া হ'বে না।
    মালিনী মিষ্টুর পাশে বসে পড়লেন। বললেন-" তোমরা এত করে বলছ যখন, বলি। তবে এটা ভৌতিক ব্যাপার কিনা তা নিয়ে এখনো আমার নিজেরই সন্দেহ যায়নি। ঘটনা আজকের নয়। মিষ্টুর জন্মের আগের। আমার বন্ধু অনীতার বাড়ী শ্যামবাজার এলাকায়। সদ্য বিয়ের পর ওদের বাড়ী যাওয়ার সময় হয়নি আমার। জুন মাসে বিয়ের চার মাস পরে অক্টোবর মাসের এক মঙ্গলবার দুপুরে অনীতাদের বাড়ীতে যাওয়া হ'ল। তাও তোমার মেসোমশাই সঙ্গে যাননি।
🍂

    অনীতাদের বাড়ীটা বেশ বড় আর পুরনো। অনেকবার সারালেও পুরনো ধাঁচটা বজায় রেখেছে ওরা। ভেতরে সব আধুনিক ব্যবস্থা থাকলেও বাড়ীটার গঠনে সাবেকিয়ানা রয়েছে যা আমার ভালো লাগত। বিয়ের পর এই আমার প্রথম যাওয়া। আমি কখন যাব ঠিক ছিল। রাস্তায় আমাকে দেখে অনীতা ওপর থেকে বলল, আয়। এক পরিচারিকা হাসিমুখে দরজা খুলে দিয় বলল- "আসুন দিদিমণি।" এমন সময়ে পরিচারিকাটিকে ভেতর দিক থেকে কে যেন ডাকল আর সে ব্যস্ত হয়ে চলে গেল। আমি একা একাই ওপরে যাব ঠিক করলাম। আগেও একবার এসেছি। 
    ওপরে ওঠার সিঁড়ি অবধি যাওয়ার আগে একটা হলঘর পড়ে। হলে দুচারটে পুরনো দিনের দামী আসবাব রয়েছে। দেখলাম মিষ্টি চেহারার একটি অল্প বয়সী বৌ দোলনায় একটি শিশুকে দোলাচ্ছে। বৌটার সাজগোজ পুরনো দিনের। চওড়া পাড় নীল তাঁতের শাড়ি, সাবেকি আমলের ব্লাউজ, গলায় বেশ ভারি সোনার হার, হাতে কানে মানানসই গয়না। বৌটার মুখটা বিষণ্ন তবে আমাকে দেখে নরম করে হাসল। আমিও হাসলাম যদিও তাকে চিনতে পারলাম না। কে জানে কে? আগে তো দেখিনি। শুনেছি ওর এক কাকার বাড়ী নদীয়ার প্রত্যন্ত গ্রামে। ওর কাকার শ্বশুরবাড়ীর দিকের কোনও আত্মীয় হবে হয় তো। মনে একটা খটকা নিয়ে ওপরে উঠলাম।
   কুঁড়ে অনীতা বন্ধুকে আনতে নিচে নামেনি বলে ওর মা ওকে একটু বকলেন। এ কথা সে কথার পর আমার জন্য অনেক মিষ্টি আর শরবত এল।

    মালিনী একটু থেমেছেন। অমনি মেয়ের বন্ধুরা হই হই করে বলে উঠল- তারপর, তারপর! তাদের আর তর সইছে না। বন্ধুদের এত আগ্রহ দেখে মিষ্টু মুচকি মুচকি হাসছে মানে গল্পটা তার জানা। 
মালিনী বলছেন- "শরবত খেতে খেতে আমি অনীতাকে বললাম, তোদের বাড়ীতে এত মিষ্টি একটা বৌ আছে বলিসনি তো! কিন্তু সাজগোজ পুরনো দিনের কেন? শুনে অনীতা অবাক হয়ে গেল, ওর মাও অবাক। "মিষ্টি বৌ? আমাদের বাড়ীতে এখন তো কোনও বৌ-ই নেই। জ্যাঠতুতো দাদার পাঁচ বছর আগে বিয়ে হয়েছে আর সেই বৌদি, ভাইপো এখন বাপের বাড়ী কানপুর। দাদা ওদের আনতে গেছে কাল। 

"অনীতার মা জানতে চাইলেন, ঠিক করে বল তো কী দেখেছ। আমি সব বললাম। তত ক্ষণে অনীতার কাকিমাও এ ঘরে এসে গেছেন। সব শুনে ওর মা আর কাকিমা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। অনীতা প্রথমে একটু কিন্তু কিন্তু করছিল। তারপরে শান্ত হয়ে গেল। একটু খুশি খুশি মনে হচ্ছে ওকে। তবে মুখ খুললেন ওর মা। জানালেন, এটা ওঁদের এই পুরনো বাড়ীর এমন একটা কথা যা তাঁরা কাউকে বলেন না। শুনলে লোকে ভয় পাবে তাই কথা ছড়ানো হয় না। কেউ নিজের থেকে জানতে চাইলে, বলে দেন।                  

অনীতার ঠাকুর্দার বাবার প্রথম পক্ষের স্ত্রী খুব সুন্দরী ছিলেন। পনেরো বছরে বৌ হয়ে এ বাড়ীতে এসেছিলেন, আঠেরো কী উনিশ বছরে একটি মেয়ের জন্ম দেন। মেয়ের জন্মের ঠিক এগারো মাস পরে উনি তিন দিনের জ্বরে মারা যান। ডাক্তার বুঝতেই পারেনি যে কেস সিরিয়াস। বাড়ীতে কেউ বোঝেনি। গায়ে একটু জোর পেয়ে এগারো মাসের মেয়েকে দোলনায় দোলাতে দোলাতে শেষ। তারপর থেকে উনি মাঝেমাঝে দেখা দেন। কখনো কাউকে ভয় দেখাননি, কারোর অনিষ্ট করেননি। তবে উনি খালি গর্ভবতী মেয়েদেরই দেখা দেন। 
মালিনী বলে চলেছেন, "শুনে আমি তো অবাক। এক সঙ্গে বিচিত্র সব অনুভূতি হচ্ছিল। কোনটাকে প্রাধান্য দেব বুঝতে না পেরে কোনও রকমে বললাম- কই আমি তো! অনীতার মা আর কাকিমা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে হাসলেন। আমার জন্য আবার ওই পাড়ার স্পেশাল মিষ্টি এল। অনেক ক্ষণ গল্প করে সাতটা নাগাৎ উঠলাম আমি। অনীতা, ওর মা আর কাকিমা তিনজনে আমার সঙ্গে বাসস্ট্যান্ড অবধি এলেন। ওর মা, কাকীমা আমাকে সাবধানে যেতে বললেন। সবাই মিলে আরো বললেন, গিয়ে যেন ফোন করি। 

বাড়ী ফিরলাম। অনীতাদের বাড়ীতে ফোন করে গা ধুয়ে শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গে কথাবার্তা বললাম। একটু পরে তোমাদের মেসো বাড়ী ঢুকলেন। অনীতাদের বাড়ীর অদ্ভুত ঘটনাটা তাকে বলতে গিয়েও বললাম না। তার দু' চার দিন পরেই নিজের ভেতরে আরেকটা প্রাণের অস্তিত্ব টের পেলাম। ফোন করে অনীতাকে সেটা জানাতেই ও আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল। যথা সময়ে মিষ্টু পৃথিবীতে এল।

   এবার উনি পিয়ালির মাথায় হাত রাখলেন। বললেন- "যে জগৎ আমাদের অজানা সেখানটা সম্পর্কে ভয় লাগে তা ঠিক। তবে যারা সেই জগতে চলে যায় তারা সবাই যে মানুষের ক্ষতি করে, এমন ধারণা রাখতে নেই।"
  গল্প শুনে সবাই খুশি। এবার মিষ্টুকে ধরে পড়ল ওরা। "তোর জন্মের আগে এ সব হয়েছিল এত দিন বলিসনি কেন?" নতুন একটা হুল্লোড় শুরু হল।

Post a Comment

0 Comments