জ্বলদর্চি

আদর সিংহাসন /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৮৫
আদর সিংহাসন

ভাস্করব্রত পতি

"সকল ব্রতের সেরা ব্রত আদর সিংহাসন। 
সবার আদর পায় সে নারী যে করে পালন।।"

এই লৌকিক উপচার যে করবে সে সকলের আদরিণী হবে। বলা হয়ে থাকে যে, এটি মহিলাদের সবচেয়ে উপযোগী এবং সেরা ব্রত। এটি পালন করলে আদরের সিংহাসনে বসতে পারা যায়। অর্থাৎ চূড়ান্ত আদর মেলে স্বামী সহ পরিবারের সকলের কাছে। 

টানা চার বছর ধরে এই ব্রত করতে হয়। মহাবিষুব চৈত্রের সংক্রান্তি থেকে শুরু করে পুরো বৈশাখ মাস জুড়ে চলবে। সবশেষে বৈশাখী সংক্রান্তিতে (বিষ্ণুপদী) তা পালন করার নিয়ম। 

কিভাবে উদযাপন শুরু হল আদর সিংহাসন লৌকিক উৎসবটির? এ প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সন্ধান দিয়েছেন, "আদরসিংহাসন ব্রত, এটি সম্পূর্ণ মেয়েলি ব্রত। মহাবিষুব সংক্রান্তিতে এক স্বামীসোহাগিনী সধবা স্ত্রীকে যত্নপূর্বক নিজগৃহে ডাকিয়া আনিয়া পিঠালির দ্বারা বিচিত্র সিংহাসন রচনা করিয়া তাহাকে উপবেশন করাইবে। নাপিতাঙ্গনা দ্বারা হস্তপদের নখাদি ছেদন করাইয়া অলক্তকরাগে চরণদ্বয় রঞ্জিত করাইয়া দিবে এবং তৈল হরিদ্রা ও কবরীবন্ধনকরতঃ সীমন্তদেশ সিন্দুররাগে রঞ্জিত করিবে এবং পুষ্পমালা প্রদানপূর্বক সুগন্ধদ্রব্য গাত্রে লেপন করিবে, পরে মনোহর দ্রব্যজাত সমাদরপূর্বক ভোজন করাইয়া বিদায় করিবে। এইরূপে সমস্ত বৈশাখ মাস প্রতিদিবস এক এক জন অথবা একজনকেই আদর - অভ্যর্থনা ও অৰ্চনা ; বর্ষ-চতুষ্টয় পূর্ণ হইলে উদ্‌যাপন।— স্বামীর সোহাগ কামনা ক'রে এই মানুষ পূজা মেয়েদের মধ্যে খুব চলছে দেখে পূজারী ব্রাহ্মণদের লোভ হল। অমনি তাঁরা এক ব্রত সৃষ্টি করলেন ব্রাহ্মণাদর। মহাবিষুব সংক্রান্তিতে আরম্ভ করিয়া সমস্ত বৈশাখ মাস প্রতিদিন এক এক অথবা একই ব্রাহ্মণকে নানা উপকরণে ভোজন করাইয়া দক্ষিণা দিবে; চারি বৎসরে উদযাপন।"

এটির উপচারে বৈশাখ মাসের প্রতিদিন সকালে একজন সধবা স্ত্রীলোক এবং একজন ব্রাহ্মণকে প্রথমে ফুলের মালা পরিয়ে দেয়। এরপর ব্রাম্ভণের কপালে চন্দনের ফোঁটা দেওয়া হয়। শেষে হাতে কিছু মিষ্টান্ন এবং কিছু দক্ষিণা দেবে। আর সধবা স্ত্রীলোকের মাথায় সুগন্ধি তেল মাখিয়ে দিতে হয়। এরপর ভাল করে চুল আঁচড়ে সিঁদুর পরিয়ে দিয়ে লালপেড়ে শাড়ি পরিয়ে দিতে হয়। দুই পায়ে লাল আলতা, হাতে কড় ও নোয়া পরিয়ে দেওয়া অন্যতম দায়িত্ব। এরপর সিঁদুর চুপড়ি, আয়না, চিরুণী, আলতা ও টাকা পয়সা দিয়ে মন ভরাতে হয়। আর ব্রাহ্মণকে দিতে হয় কাপড়, চাদর, খড়ম বা জুতো এবং ছাতা। তাঁকেও চন্দন ও ফুলের মালা পরিয়ে খুব যত্ন করতে হয়। সেইসাথে নানা ধরনের নিরামিষ রান্না রেঁধে তৃপ্তি করে খাওয়াতে হয় তাঁদের। বিকেলে তাঁদের হাতে নানা রকমের ফল ফুলারি, মিষ্টান্ন, ক্ষীর ইত্যাদি তুলে দেওয়া বাধ্যতামূলক। 

দ্বিতীয় বছরে বেছে নিতে হয় দু'জন সধবা ও দু'জন ব্রাহ্মণকে। তৃতীয় বছরে তিনজন সধবা ও তিনজন ব্রাহ্মণকে দরকার। সবশেষে চতুর্থ বছরে চারজন সধবা ও চারজন ব্রাহ্মণকে প্রয়োজন হয়। ঐ বছর চারজন সধবাকে একসাথে বসিয়ে তাঁদের পা ধুইয়ে দিতে হয় প্রথমে। পা মুছিয়ে আলতা পরিয়ে দিতে হয় সুচারু ভাবে। এর সাথে লালপেড়ে শাড়ি, সিঁদুর কৌটো, সিঁদুর চুপড়ি, হরিতকী, পাখা, গামছা, চিরুনি, আয়না, আলতা, মাথাঘষা ইত্যাদি দিয়ে পরিতৃপ্ত করানোর রেওয়াজ রয়েছে। কপালে চন্দনের টিপ এবং গলায় ফুলের মালা পরিয়ে উপাদেয় রান্না করে খুব তৃপ্তির সঙ্গে ভোজন করানোর ব্যবস্থা করা হয়। বিকেলে নানারকম ফল, মিষ্টান্ন, দুধ, ক্ষীর, ননি সহকারে দক্ষিণা দিতে হবেই। এক্ষেত্রে অবশ্য চারজন ব্রাহ্মণের পরিবর্তে একজন ব্রাহ্মণ হলেও চলবে। তবে সেই ব্রাহ্মণকেও পূর্বেকার মতো গন্ধদ্রব্য, মালা, কাপড়, চাদর, পাদুকা, ছাতা ও পৈতে দেওয়া বাধ্যতামূলক। এয়োস্ত্রীদের মতো এই ব্রাহ্মণকেও সকালে চব্য চোষ্য লেহ্য পেয় ধরনের খাওয়ার খাইয়ে বিকেলে ফল মূল, মিষ্টান্ন ও দক্ষিণা দিতে হয়। 

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, "আদর-সিংহাসন’ ব্রতে মানুষ আদর চেয়ে মিষ্টি কথা পাবার কামনা ক'রে তো শাস্ত্রীয় হরিচরণ-ব্রতের মতো তামার টাটে দেবতার পাদপদ্ম লিখে পূজা ক'রে বরপ্রার্থনা করছে না । সে যে আদরটি কামনা করছে সেটি একটি জীবন্ত প্রতিমার মধ্যে ধরে দেখবার আয়োজন করছে। সত্যি এক স্বামী সোহাগিনীকে সামনে বসিয়ে বসনভূষণে সাজিয়ে যেমন আদর সে নিজে কামনা করছে তেমনি আদর তাঁর মূর্তিমতী কামনাকে অর্পণ করছে এবং জানছে যে এতেই তাঁর আদর পাওয়ার কামনা চরিতার্থ হবে নিশ্চয়। এইখানে ব্রত আর পুজোতে তফাত।"
🍂

Post a Comment

0 Comments