বাগদি চরিত ( একবিংশ পর্ব)
শ্রীজিৎ জানা
আজকাল মাধুও মাঝেমাঝে একটা ঘোরের মধ্যে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। খগেন স্কুলে না এলে আনমনা হয়ে ওঠে। কালিতলায় গিয়ে কায়দা করে তার খোঁজ নেয়। যত হোক সে আর আগের ছোটটি নেই। মা- বাপকে তার বড় ভয়।তার উপরে বাখুল ঘরের লোকজন! অন্য পাড়ার ছেলের সঙ্গে এত হলায়গলায ভালো চোখে দেখবে না কেউ। তবু সেই ছোটবেলা থেকে তারা একসাথে থাকে। কেমন একটা টান অনুভব করে মাধবী। খগেনের উপর তার ভীষণ মায়া। সেই মায়াকে কি বলে, সেই টানকে কি বলে খালবিল নদীজলার সাদাসিধা মেয়ে মাধু বুঝতে পারে না। শুধু মনে হয় আর সবার চেয়ে খগেন যেন তার খুব কাছের। বড্ড আপন।খগেনের কথা সে এড়াতে পারবে না। কিন্তু মনের ভিতর চাপা একটা ভয় তাকে জাপ্টে ধরে। পাড়ার অনেকে থাকলে তেমন কোন ভাবনাই ছিল না। কিন্তু তাকে একা ডেকেছে খগেন। মাধু জানে, সে না গেলে হয়তো দু'দিন কথা বলবেনা খগেন। এড়িয়ে এড়িয়ে চলবে। এর ওর গায়ে ফেলে কথা বলবে। কথা দিয়েই চিমটি কাটবে। রাগাবে তাকে। তারপর ধীরে ধীরে স্বভাবিক হবে। মিটমাটের শেষ মুহুর্তে একপ্রস্ত বাকবিতন্ডা হবেই। শরতের মেঘের বৃষ্টির মতো। যেই মেঘ ঘনালো, অম্নি ঝমঝমিয়ে ধারাপাত। পরক্ষণেই রোদ ঝলমলে আকাশ। কিন্তু মাধু নিজের মনকেও স্থির রাখতে পারে না।
সূর্য তখন শিলাইয়ের পশ্চিম বাঁধের হিজল গাছের আড়ালে লুকিয়ে আছে। রোদ্দুরের আভায় সারাদিনের ক্লান্তির কোন চিহ্ন নেই। শিলাইয়ের ঘোলাটে জলের স্রোতে যেন ঢেলে দিচ্ছে হলুদ গোলা জল। মাধু দ্রুত পায়ে পৌঁছায় সব্বেশ্বর দাদুর ঘাটে। পৌঁছে দেখে পানসিটার উপরে হাল ধরে বসে আছে খগেন। তাকে দেখামাত্রই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে। মোয়ানে লাফা জালের উপর শোল ল্যাঠা,গোড়ই যেমন করে আনন্দে লেজ বাঁকিয়ে লাফ দেয়,ঠিক তেমন পারা।
— কিরে তোর এই এসার সময় হল? কখন থিকে বসে আছি। অনেক পটিয়ে পাটিয়ে দাদুর কাছ থিকে লৌকাটা লিয়েছি। আদ ঘন্টার মধ্যেই দিতে হবে। দাদু জেলা ঘাটের কাছে হালুক বসাতে যাবে। চোলায় তাড়াতাড়ি।
— তুই কি বুজু! এসবো বল্লেই এসা যাইনি। তাই কেউ যেদি বলে দেয মাকে…
— ছাড় ত। মোর জন্নে নাইলে দু'ঘা মার সোজ্জ করে লিবি। তাবাদে তুই লৌকায় চেপে ঘুরতে চেইছিলু,তাই ভাবলম তোর ইচ্ছাটা একটু পুন্ন করে দিই।
— কি ভাগ্য মোর! থাইলে যা ইচ্ছা কোরব তা পুন্ন কোরদিবি ত ?
—- তা বলে সগ্গের চাঁদ চাওসুনি যেন! উটা পারবোনি। এরকম ছোটখাটো গুলান পারব,যাতে তুই খুম খুশি হও। ধূর,তুই যাবি নাকি বলত? সুদু বকাচ্চু মোকে।আর আমিও লাউঝাড় পুইঝাড় বোকিঠি।
—- কিন্তু তুই পারবি ত? ভালই টান আছে দেখিঠি।
— তুই বোস দেখি হালের সামনে। বেশি লড়বিনি। আমি ত ধার ধরে যাব। তুই হালটা সজা করে ধরে রাখবি,বুইলু। তাবাদে তুই ত সাঁতার জানু। লৌকা ভেসে গেলে ঝাঁপ দিবি। তারপর ভেসে ভেসে উঠে পড়বি তোদের ঘাটে।
— সে ত পারব। কিন্তু হাল ধোরব কি করে! ধূর মোর দ্বারায় হবে নি। যখন তখন বাঁকি দিই যেদি।
— দেউ দিবি। এবার বোস ত।
খগেন লগি বাঁশ ঠেলতে থাকে। শক্ত করে হাল ধরে বসে থাকে মাধু। সব্বেশ্বরের পানসি উজান ভেঙে তরতরিয়ে এগিয়ে যায় গঙ্গাতলার ঘাটের দিকে। সানা ঘাট পেরিয়ে বুড়াই হানা। বুড়াই হানা উজিয়ে তালহিঁড়। তারপর গঙ্গাতলার ঘাট। স্রোতের উত্তর - পশ্চিমে রাধাচক,জয়কৃষ্ণপুর,রাধাবল্লভপুর,সিমুলিয়া,আয়মা, প্রসাদচক পরপর সাজানো শিলাইপাড়ের গ্রাম। বাঁধ থেকে নদীর দুরত্ব প্রায় বিঘা দুই জমি। সেই জমিতে এখন কোমর ডোবা জল। কোথাও আবার জমি নেই। বাঁধের গা ঘেঁষে নদী। করঞ্জ,হিজল,অর্জুন, বাবলার ডাল ঝুঁকে পড়েছে নদীর জলে। কোথাও বাঁশ ঝাড় এক্কেবারে জলের উপর শুয়ে ডিগবাজি খাচ্ছে।মাধুর মনের ভিতর একদিকে খুশির ঢেউ পানসির গায়ে আছড়ে পড়া শিলাইয়ের ঢেউয়ের ছলাৎ শব্দের মতো বোল তুলছে। অন্যদিকে শিলাবতীর ঘূর্নিস্রোতের ভয়,লোকজন দেখে ফেলার ভয়,মা-বাবার ভয় তিরতির করে বুকে কাঁপন ধরাচ্ছে।
বিকেলের রোদ আগে থেকেই উধাও ছিল। হাল্কা মেঘ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল পশ্চিমে। এক দু'ফোঁটা জল মাধুর গালের উপর পড়ে। তারপর হাতে,কপালে। নদীর জলের দিকে চোখ পাতে মাধু। ঢেউয়ের ওঠাপড়ায় বৃষ্টি পতনের রেখা স্পষ্ট চোখে পড়ে না। খগেনকে সজাগ করে মাধু। তার স্বরে খানিকটা আগত দুর্যোগের ভয় মিশে থাকে,
— আর কদ্দূর যাবি বল দিখি! বিষ্টি এসবে এখুনি। কেমন মেঘ ধচ্চে দেকচু?
— তুই চুপ করে বোেস দিখি। তোর সবেতেই ভয়।
— বিষ্টি এলে কি করবি তখন। ভিজে ত একসা হই যাব দুজনে। তারপর ঘরকে ভিজা গায়ে জিয়ে কি বলব মাকে?
—- থাইলে কেন এলি বল দিখি। না এলেই পাত্তু। ভাবতম তোর ইচ্ছা নাই মোর সঙে লৌকায় চেপে ঘুত্তে।
—- অই ত তোর রাগ হই গেল। তরা ছেনারা পচুর আনাড়ি হউ। কিছু বুজতে চাউনু। মেইছেনা হলে বুজতু কত কিছু মেদের সজ্জ কত্তে হয়।
—- থাইলে কি বোলচু বল দিখি?
—- আজ ইখিন থিকে লৌকা ঘুরি লে। পরে একদিন এসব।
—- ওই যে দেকচু খিয়াঘাট,উটাকেই জেলাঘাট বলে। ওই যে বাঁদে ঘরগুলান অরা সব জাতে জেলা। জেলাঘাট পেরালেই দেখতু তালহিঁড়। নদীটা পিড়িস পাকানা সাপের মতো পাক খেইচে অখিনে। সেই পাক খাওয়া লদীর কোলে বিশাল উুচু চর। তাতে সুদু তালগাছ। দেখতে পেলুনু আজগে। তোর ভাগ্যে নাই,লে।
— আচ্ছা পরে এসব এগদিন। এখন লৌকা ঘুরা।
লগিটা নৌকার পাটাতনের উপর ফেলে রেখে এবার হাল ধরে খগেন। পাকা মাঝির মতো হাল ডাঁয়ে বাঁয়ে ঠেলে সামান্য দূর দিয়ে নৌকা ফেরার মুখো করে নেয়। মনে মনে নিশ্চিন্ত হয় মাধু। অন্যবারের মতো খগেন আজ জেদ ধরেনি। কিন্তু আকাশ তার জেদ ছাড়েনি তখনো। বৃষ্টি ফোঁটার ঝাঁক বাড়াতে থাকে। এদিকে স্রোতের টানে নৌকাও যাচ্ছে বেগে। মাধু অস্থির হয়ে উঠে।
— বিষ্টিটা জোরেই চলে এসবে বোধয! পুরা ভিজে যাব। কি যে হবে আজগে!
খগেন কোন উত্তর করে না। ঘন ঘন লগি ফেলে ঠেলতে থাকে। মনের ভিতরেও তার কালো মেঘের ঘনঘটা। সেই মেঘের হদিশ পাবে না মাধু। সেই মেঘেও বৃষ্টি নামবে গোপনে। সেই বৃষ্টির ছাঁট ভিজিয়ে দেবেনা মাধুকে। খগেন ভিতরে ভিতরে ফুঁসফুঁসিয়ে ওঠে। যুগ্গেশ্বরের দয়ের জলের মতো পাক খায় তার ভিতরে অভিমান। ইচ্ছে-পূরণ না হওয়ার রাগ। কতকিছু ভেবে রেখেছিল সে। তার মনের কথা মাধুকে আজ সব বলবে। জানতে চাইবে মাধুর মনও কি এমন আকুলিবিকুলি খায়! না দেখতে পেলে দম বন্ধ হয়ে যায়! আগে বহুবার বলার চেষ্টা করেছে খগেন। কিন্তু পারেনি। চিঠিও লিখতে পারেনি সাহস করে। যদি মাধুর মনে তাকে নিয়ে কোন টান না থাকে! যদি চিঠি দেখিয়ে দেয় বাড়িতে। সারা গাঁয়ে ছিছিক্কার পড়ে যাবে। সেই থেকে সে ভেবে রেখেছে মাধুকে তার মনের কথা সামনাসামনি বলবে। তাতে যা হবার হোক। অথচ আজকে এত কাছে পেয়েও খগেন নিরুপায়। ভয়-ভাবনা তাকেও অস্থির করে দিচ্ছে। আবার মনে মনে নিজেকে অপরাধী ভাবে। আজকে তার জন্য আবার মার খেতে হতে পারে মাধুকে। গায়ের জোরে লগি ঠেলতে থাকে। হঠাৎ বুড়াই হানার পাড়ের বনে চোখ পড়তেই নৌকাটার গতি কমায। লগি বেয়ে বনের কাছে নিয়ে যায়। একটা কদম গাছের সাথে নৌকাটাকে বেঁধে কোমর ডোবা জল নেমে পড়ে। মাধু চেঁচিয়ে ওঠে।
🍂
— হাই দ্যাখ! কেনে থামলি? জলে নামলি কেনে?
কিছু উত্তর না করে বড় একটা মানকচুর ডাঁটা সহ পাতা দাঁতে করে কেটে আনে সে। মাধুর দিকে এগিয়ে দেয়।
— লে,এইটা মাথায় দিয়ে বোস। ডান হাতে পাতটা ধর,আর বাঁ হাতে হালের মাথাটা। এখুনি পৌঁছি যাব।
মাধু লক্ষ্য করে খগেন তার দিকে না তাকিয়েই বলল কথাগুলো । সে বুঝতে পারে খগেন তার উপরে রাগ করেছে। মাধুর মনের ভিতরে হাজারটা কথা বুড়বুড়ি কাটে।
—- রাগ ত অর হবেই। মোর জন্যে ছেনাটা সব্বেশ্বর দাদুকে পটিয়ে লৌকাটা লিল। মোকে চাপিয়ে গঙ্গতলার ঘাট দেখাতে চেইছিল। আধ ভত্তি লদীতে সাহস করে লৌকা বেয়ে লিয়ে যাওয়া সজা নয়। তবু অকে মুখ দেখাইঠি। ইটা করা মোর ঠিক নয়। কিন্তু কি করব। বিষ্টিটার জন্নে মোর মাথাটা ঠিক কত্তে পারিঠিনি।
বৃষ্টি আরো জোরে নামতে থাকে। আর ত কিছুটা গেলেই খেয়া ঘাট। কিন্তু ততটা যেতেই পুরো ভিজে যাবে দুজনে। খগেনের কোন চিন্তা নেই। মাধুকে নিয়েই খগেনের যত ভাবনা। অগত্যা পাড়ের দিকে ঝুঁকে পড়া ঝাঁকড়া একটা হিজল গাছের ডালের নীচে নৌকা থামায়। ঘন পাতার আড়ে সেখানে বৃষ্টির বেগ তত নয়। তবু ওইটুকু আসতেই অনেকটা ভিজে গেছে মাধু। খগেন তো ভিজে একসা। নৌকাটাকে গাছের ডালে বাঁধতে বাঁধতে বলে,
— একটু দাঁড়ি যাই ইখিনে। চলেই ত এসচি। বিষ্টিটা এখুনি থেমে যাবে। থামলেই আবার ছেড়ে দুব লৌকা। ওই ত ঘাট দেখা যাইঠে।
— ঠিক আছে লে। তুই ত ভিজেই গেছু। চলায় মোর পাশটায়। ইখিনে জল তেমন পড়েনি। মোর মানপাতাটার ভিতরে দাঁড়াবি চলায়।
মন চায় না। অথচ যন্ত্রের মতো পা দুটো চলে যায় মাধুর দিকে। খগেন আড় চোখে মাধুর দিকে তাকায়। ফুল তোলা হাফহাতা হলুদ ফ্রক তার গায়ে। ভিতরে কোন টেপ জামা নেই। জলে ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে গেছে জামা। বুকে যেন দুটো কদমফুল লুকানো। খগেন কদমফুল কুড়িয়েছে কতবার। কি আশ্চর্য নরম সেই ফুল। কি সুগন্ধময়! মাধুর বুকের কদমফুলও কি পশমের মতো! ওই কদমের সৌরভ কি নেশা ধরিয়ে দেয়! ঘোরের মধ্যে গা ঘেঁষে দাঁড়ায় খগেন। চুলের সেই কেওকারপিন তেলের গন্ধ তাকে আবিষ্ট করে দেয়। বয়ে যাচ্ছে শিলায়ের স্রোত। মাথার উপর অঝোর শ্রাবণ। শিলায়ের আলতো ঢেউয়ের ধাক্কায় বারবার দুলে উঠছে পানসি। মানকচু পাতার নীচে দুই কিশোরকিশোরী। খগেন খপ করে মাধুর হাতটা ধরে ফেলে। হ্যাঁচকা একটা টানে আরো নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলে,
— তোখে মোর খুব ভাল লাগে,মাধু। তোখে খুব ভালবাসি। তুই কি কিছুই বুজতে পারুনু! এই শিলাইয়ের দিব্বি বোড়ো হয়ে তোখেই বিয়া কোরবো। তুই বল, তুই মোকে ভালবাসুনু?
— তোর কি মাথা খারাব হই গেছে! এক গেরাম,এক পাড়া আর তুই মোকে লিয়ে এসব ভেবেচু। তোর লজ্জা করেনি। ইসব বলতে তুই মোকে লিয়ে এসছিলু এখিনে। আগে জানতে পাল্লে কখনো এসতম নি তোর সঙে। আমি ভিজে যাই যাব।মার খাই খাব তুই এক্ষুনি লৌকা ছাড়।
হাতের মুঠো কখন আলগা হয়ে গেছে খেয়াল হয়নি খগেনের। থরথর করে কেঁপে উঠে সে। মাধুর চোখে চোখ রাখতে পারে না। হাতে তার আর জোর নেই। লগি ঠেলবে সে কি করে। দিশেহারার মতো দড়ি খুলে নৌকা ভাসিয়ে দেয় স্রোতে। কেউ কারো দিকে আর তাকায় না। কোন কথা নেই কারোর মুখে। ঘাটে পানসি ঠেকতেই মাধু লাফ দিয়ে নেমে পড়ে আড়ায়। আর হনহনিয়ে হাঁটা দেয় ঘরের দিকে।
0 Comments