জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত (বিংশতি পর্ব)/শ্রীজিৎ জানা

শিল্পী -আরাধ্যা জানা

বাগদি চরিত ( বিংশতি পর্ব)
শ্রীজিৎ জানা


সুবল আজকাল ঢোলের একজন কর্তাব্যক্তি লোক। তাবাদে পার্টির হোমরাচোমরা নেতা। পেছনে যদিও তাকে পচলাপচলি করে অনেকেই।
— বুইলু নি ভাঙা গেরামের শিয়াল রাজা। মুখে দুটি ছাঁটের কথা শিকে লিচে,ব্যাস্,আর ধরে কে! 
— তা যা বলেচু। চাগরিটা পেইছিল বলে! নাইলে কত ফাঁট দেখানা বেরি যেত। 
—- উ ত তবু কম,অর বউকে দেখু! তিন ছেনার মায়ের সাজ দেকলে নি, তোর চোক ধাঁদি যাবে। তার উপরে ত গা ঢলানির অস্তাদ।
—- তবে তোর আমার দিকে ঢলবেনি। তার ঢলাঢলির লোগ থরাই আছে।
—-- মোকে শিকাচ্চু! জানিনি মনে কচ্চু! বঙ্কাটার ভাগ্য বলতে হবে, মাইরি! সুবলা আর কতটুকু পায়,সবটাই ত বঙ্কা চুষে লেয়।
—- শুনি ত অর বেটাটা আসলে বঙ্কার। তারই মতো আড়নগড়ন, দেখুনু।
—- গইল বদলিয়ে বেটাছেনা পেইচে। তা হউ। সুবলার মা' টা একটু নিশ্চিন্তে মরেচে যা হোক। নাইলে ত লাতি লাতি করে হাউড়ির মতো বকে বেড়াত।
— দিগার বাখুলের লোগরাই বলে শুনি,বুড়িও নাকি জানত, লাতিটা অর বেটার নয়, ওইপারের বঙ্কার।
— বোলু কিরে!
—-মাল পাড়ার ম্যানেজারের কাছে লুকিয়ে গনাতে গেইল বুড়ি। ম্যানেজার বলে তমার বেটার ঔরসে বেটাছেনা নাই। শুনে ত বুড়ির মাথায় চড়কা পড়ে যায়। তারপর থিকেই ত অদ্ধেক দিন ইচ্ছা করে ঘরে থাকত নি বুড়ি। সেই সুযোগে দিন দুবেলা বঙ্কা এসে পড়ে থাকত সুবলার ঘরে। সুবলা ত সেদিকে চিঠিয়ে ট্যাম মাত্তে ব্যস্ত আর এদিকে বঙ্কা…।
—মেইয়াও মাইরি সেইরকম!  মুখে কথার খই উতরাচ্ছে। টেম্পার দেকলে মাথা ঘুরি যাবে। 
— তা হউ পাল্লে,তবে জানু সুবলার পথম পক্ষের মেইছেনাটাকে মেইয়াটা দুচক্ষে দেখতে পারেনি। ঘরের অদ্ধেক কাজ তাকে দিয়েই করায়। আর নিজের পেটের ছেনা দুটাকে তুলা কাপড় করে রেখেছে।
—-যাই বল সুবলার পথম পক্ষের ঝিটা খুবই সুন্দর। যেমন মাধয্য তেমন গুণের।

🍂

পাড়ার অনেকের মতো মাধবী হেঁটেই স্কুলে যায়। গ্রাম থেকে তাদের হাইস্কুল অনেকটাই দূরে। বাপ তাকে সাইকেল কিনে দিতে চেয়েছিল। মা আপত্তি করে। মাধু জানে তার বাপ ভয় করে মা'কে। সাইকেল নেই বলে তার মনে কোন আক্ষেপ নেই। তাদের গ্রামের যে কজন মেয়ে হাইস্কুল যায় তারা সবাই হাঁটাতেই অভ্যস্ত। নিজের সাইকেল না থাকলেও মাধু সাইকেল জানে। খগেনের সাইকেল নিয়ে সে শিখে নিয়েছিল। তাদের দিগার পাড়া থেকে খগেনদের পাড়াটা একটু দূরে। তাতে আর কি! রোজ বিকেলে গ্রামের অদ্ধেক ছোটরা কালিতলায় জড়ো হয়। তাদের ছোটবেলাটা ওখানেই কেটেছে। সামনেই মাধ্যমিক দেবে মাধু। খগেনও বসবে।গ্রামের মধ্যে খগেনের সঙ্গে তার বেশি মিল। দুজনের ছোটবেলার কত স্মৃতি তাদের চোখের সামরে ভেসে ওঠে। তখন গ্রামে টিউশন পড়াতে আসত দুলাল স্যার। বিকেলে টিউশন হত। রোজ তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকত খগেন। পেয়ারার দিনে পেয়ারা, জামের দিনে জাম পেড়ে এনে দিত।  মাধুও খগেনের জন্য নিয়ে যেত আম ছিঁচকি,বেগুন তুপতুপি। মাধু যেদিন কাজের জন্য মা'র কাছে গাল খেত। ঝাঁটার দু'চারটা ঘা পড়ত পিঠে,মুখ ভার থাকত সেদিন। কেউ না বুঝুক খগেন ঠিক বুঝতে পারত। ছুটির পরে কালিতলার কাছে এলে বলত,
— কি রে! আজগেও ঝাঁটার বড্ডান খেইচু?  বাদ দে ত সতল মা গুলান এরকমই রাক্কসি হয়। জানু, মাজেমদ্দে ইচ্ছা যায় রাস্তা থিকে লুকিয়ে ঢিল মেরে তোর মায়ের মাথাটা কানা করে দিই।
— কেনে? তুই মোর মোকে মারবি কেনে?
— এই লে! তোর জন্যেই ত মারব বল্লম।
—- মোর জন্যে তোখে অত কত্তে হবে নি।
বলেই টংটং করে বাড়ির দিকে হাঁটা দিত। খগেন বহুবার তার ছোটবেলার কথা বলেছে লোখাকে। মাধুর সাথে তার সম্পর্কের কথা। কালিতলায় তখন বিকেল মানেই জমজমাট ব্যাপার। বড়রা একদিকে তাস খেলত। কোন দল আটচালায় খেলত মোগলপাঠান। মেয়েরা পাঁচগুটি,কিতকিত নয়তো অষ্টা। কুকলুকানি আর বৌবসন্ত ছিল খগেনের প্রিয় খেলা। কুকলাকানি খেলায় লুকাতে হত আড়ালে কোথাও। তাদের পছন্দের জায়গা ছিল স্কুল ঘরটার পাশে জবা গাছের ঝোপের আড়াল। সেখান থেকেই দৌড়ে এসে ধাপ্পা দিত চোরকে। ঝোপে গুটিসুটি মেরে বসে থাকলে কেউ দেখতে পেত না। খগেনের গাঁ ঘেষে বসত মাধু। মাধুর নিঃশ্বাসের বাতাস গায়ে পড়ত। চুলের কেওকারপিন তেলের গন্ধ আসত নাকে। ভারি মিষ্টি সেই গন্ধ। রাত অব্দি খগেনের গায়ে লেপ্টে থাকত সেই সুবাস। জবা গাছের ঝোপে গায়ে গা ঠেসে বসে থাকার সময় খগেন ফিসফিস করে মাধুকে জিগ্যেস করত তার গা-মাথার সুবাসের কথা।
— তুই কি তেল মাখু বল দিখি? হেবি সুন্দর সেন্ট! পাউটারও ত মাখু গায়ে।
— মোর বাবো কিনে আনে। মায়ের ঘরে থাকে পাউটার। সেখিন থিকে লিয়ে মাখি
—- বকে নি তোকে?
—- বেশি লিলে বকে। তুই লিবি? কাগজে  মুড়ে তোর জন্যে লিয়ে এসব।
—- খবরদার আনিসিনি! তোর গতর ছিঁচে দিবে। তাবাদে উসব ছেনারা মাখে নি।
— মাখেনি বলেই তোর গা থিকে বটকানি গন্ধ ছাড়ে।
বলেই ঝরঝর করে হেসে ওঠে মাধু। রেগে লাল হয়ে যায় খগেরন।
— তুই চাগরিয়ালার ঝি, টাকার ত অভাব নাই। মোদের খেটে খাওয়া ঘর। উসব লটম্বরা চাল দেখালে মোদের চলবেনি। আর শুন মোটেই মোর গা থিকে বটকানি গন্ধ বেরায়নি।
—- বটকানি গন্ধ নয় ঠিক, তবে নারকেল তেলের গন্ধ। যা জবজবা করে গায়ে মাথায় মাখু তুই।
দু'জনের কাছে বৌবসন্ত খেলার মজা ছিল সবচেয়ে বেশি। খগেন কত রকম কায়দা করত। বেশিরভাগ দিন নিজে রাজা হত। তার আগে মাধুকে গোপনে বলে রাখত,
—দেখ,তুই কিন্তু মোর দলে খেলবি।
— কি করে খেলব। মোকে যদি অন্য রাজা ডাকে!
— কেনে নাম পাতিয়ে এসে যখন বলবি তখন মোখে এট্টু চোখ টিপে দিবি। থাইলে তোকেই ডাকব।
মাধু ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিত। তারপর নাম পাতিয়ে দু'দলের দুই রাজার কাছে এসে শুধাত,
—-রাজা রাজা কিসকো?
দুই রাজা সমস্বরে বলে উঠত– হামকো
—-কে লিবে জবাফুল? কে লিবে বেল ফুল?
বলামাত্রই চোখ ইশারা করত মাধু। এমন ঈঙ্গিত করত যাতে খগেন বুঝে যেত বেলফুল মাধু। খগেন তৎক্ষনাৎ বলে উঠত,
— আমি লুব বেলফুল।
এই করে সবদিন মাধু থাকত খগেনের দলে। বৌবসন্ত খেলায বৌ বসত মধু। খগেন ডাক চালাত। বহুক্ষণ নিঃশ্বাস ধরে রেখে ডাক চালাতে পারত। এক ডাকে একজনকে মোড় সে করতই। দশ ডাকের খেলা হলে সাত আট ডাকেই বৌ তুলে আনত খগেন। দু''তিনজনকে একটু ছুটিয়ে গোল দাগের ঘর থেকে ছোঁ মেরে মাধুর হাত ধরে নিয়ে আসত দানের ঘরে। কোন কোন দিন মাধু প্রচন্ড রেগে যেত খগেনের উপর,
— ওরকম এক হ্যাঁচকা দিয়ে টেনে আনু কেনে? মোর হাতে লাগেনি? হাতই বা ধরবি কেনে? আমি ছুটে এস্তে পারবোনি?
— ও! কি এমন হইচে! তুই ত আবার চাগরিয়ালার ঝি আল্লাদি! 
— ওরকম বোলছু ত,কালকে যদি তোর দলে খেলি তবে মোর নামই নয়।
— না খেলু না খেলবি। এট্টু হাত ধরে টেনেছি কি েগবারে লেগে অস্তির! আল্লাদে গদগদ ভাতারের নাম কালিপদ।
— তুই এরকম বাজে কথা বোলু। ভাতার মানে জানু?
— কেন জানবোনি! বরকেই ত ভাতার বলে। মোদের পাড়ায় ত শুনি।
—- ও মোর বর থাইলে কালিপদ! মোর বিয়া হয়ে গেছে!
— আচ্ছা লে কালিপদ নয়,খগেনপদ।
— ছ্যা! তোর মুখে কিছু আটকায় নি! যেদি কেউ মোর ঘরে জিয়ে বলে দেখবি কেমন ঝগড়া বাঁদে!
ভয় পেয়ে থমকে যায় খগেন। আর কিচ্ছুটি বলে না। কালিতলায় ক্রমে শেষ বিকেলের আলো ফিকে হয়ে আসে। কলরব ম্রিয়মান হতে থাকে। বাড়িমুখো হয় ছোট ছেনা মেইছেনার দল।

তখন শ্রাবণ মাস। আধ ভরা শিলাই। নদীর গর্ভে খড়িঘাসের বন তখনো জলের তলায় তলিয়ে যায় নি। তার ডগা টুকু ঘোলা জলের উপর মাথা তোলবার আপ্রাণ চেষ চালাচ্ছে। জলের রেশ খড়িঘাসের বনকে দুমড়ে মুচড়ে বেগে বয়ে যাচ্ছে। প্রায় প্রত্যেক পাড়ার  ঘাটে ঘাটে ডোঙা নয়তো পানসি বাঁধা। কালসোবার মাঠের দিকে খালে অনেকদের  ঢোঙা প্রস্তুত। জষ্ঠির শুরুতেই সব্বেশ্বর সদ্দার তার নৌকা আলকাতরা দিয়ে পাট করে নিযেছে। অজ্জুন বাগ তার জোড়াডোঙায় মোটা করে আলকাতরা পাট করেছে। সামনেই জলযুদ্ধ। সব্বেশ্বর বলে, 
— ইগুলা মোর চাঁদ বেনার মধুকর। শিলাইয়ের উজান ঠিলে চোঁচা মেরে ছুুটবে। ই মোর খাটুনা লৌকা। বড় গুলানের বাবুয়ানি চাল বেশি। অদের পঁদে খচ্চা যেমন,তেমন এই ক'মাসে রোজগার দেয়ও তেমনি। কথায় বলে,হাতি পেটেও যত লাদেও তত।
অজ্জুন বলে,
— তা তমার লৌকা!  তমার সঙে তুলনা নাই। তবে ইটা মোর জলহাঁস। আমি হলম জলের পোকা। জলে মোর মরণ নাই গো খুড়া। মরণ মোদের মরাশুকায়। পেটের রাক্কসা খিদায়।
অজ্জুন জানে সব্বেশ্বরের পানসি এই ক'মাস নদী মাঠে রাতদিন চষে বেড়াবে। মাঠে জাল আড়া,জাল তোলা,ভেসে আসা কাঠ বাঁশ ধরা এসবেই রাতদিন এক করে দেবে।একটা নৌকা ঘাটে খেয়া দেবে। আর একটা বানবন্যা হলে পঞ্চায়েতের বরাত পাবে লোকজন পারাপারের কাজে। তবে সব্বেশ্বর তার পানসির হাল ছাড়বেনি কাউকে। বেটারা তার বড় নৌকা দুটো চালায়।অজ্জুনের বাপের আমলের একুটা ডোঙা। পরে অজ্জুন আরেকটা করে জোড়াডোঙা বানায়। বানের সময় এই ডোঙাই তার একমাত্র সম্বল। রুখাসুখার সময় খালের জলে ডুবিয়ে রাখে ডোঙা দুটাকে। বর্ষার আগে জল থেকে তুলে আলকাতরা মাখায়। কত যত্ন করে, আদর করে কালো তরল তাল কাঠের গতরে বুলাতে থাকে। তার বেটা ছোটকচার গায় যেমন করে তার বউ সরসার তেল মাখায় ঠিক সেভাবে। জল বাড়লে জড়াডোঙায় চড়ে লগি ঠেলে ছেনাদুটাকে ইস্কুল ঘরের ত্রাণ শিবিরে দিয়ে আসে সে। বড় বান না এলে ভিটায় থাকে। বাজার পাড়া থেকে খাবার জল আনে। আনাজপাতি কিনে আনে। কালসাবার মাঠে এই ডোঙায় চড়ে মাছ ধরে বেড়ায়। শুধু তাই নয়,পাড়ায় কারো অসুখবিসুখ হলে অজ্জুনের ডোঙাই তখন একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়ায়। জড়া ঢোঙা সহজে টিলটিল করে না। তালের ডোঙাদুটোকে বাঁশ দিয়ে কষে বাঁধা থাকে। পাটা ফেলে দুজন হাল্কা মানুষ বসারও ব্যবস্থা রাখে অজ্জুন। ডোঙা বাওয়া মুখের কথা নয়।অজ্জুন বলে,
— উ আজকের ছেনাছকরাদের কম্ম নয়,বুইলে। কলন জানতে হয়,নাইলে উল্টে ঢঙার পেটে ঢুকে যাবে। থির হয়ে দাঁড়িয়ে লগি ঠিলতে হয়,নাইলে কেরাল মেরে চালাতে হয়। 
খগেন পানসি বাইতে ওস্তাদ। এইটে পড়া খগেনের সবেমাত্র হাল্কা গোঁফের রেখা ফুটে উঠেছে। গলার স্বর ভাঙতে শুরু করেছে। মাধুর সাথে তার মেলামেশা সেই ছোটবেলার মতো। তবে আজকাল খগেন মাধুকে নিয়ে অন্যরকম ভাবে। বিছানায় একা শুয়ে থাকলে আপনা থেকেই ভাবনারা হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে তার মনের ভিতর। দিনে বহবার মাধুকে দেখার জন্য তার মনটা আকুলিবিকুলি খায়। কাউকে এসব কথা বলার সাহস পায় না খগেন।  এমন কি মাধুকেও না। 
আর এরই মাঝে একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে মাধুকে সে প্রস্তাব দেয়,
— গঙ্গাতলার ঘাট যাবি? নৌকায় করে লিয়ে যাব।
—- আমাকে! কেনে?
—- তোকে নয়তো কাকে? এম্নিই যাবি। সেদিনই ত বলছিলি তোর নাকি নৌকায় চাপতে ভাল লাগে।
—- কার নৌকা পাবি? তোকে কে দিবে? আর তুই পারবি বাইতে
— সে আমার ব্যাপার। তুই যাবি ত আজকে বিকালা সব্বেশ্বর দাদুদের ঘরের কাছকে চলে এসবি।

Post a Comment

0 Comments