সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ৬
গৌতম বাড়ই
"সুসীমার প্রসঙ্গ এলেই, কেমন করে যেন রাঢ় অঞ্চল এসে যাবেই আর রাঢ়ের সেই জনপদের ইতিহাস ভালো করে কিছুই জানা যায় না। ইতিহাসের বড় বিচিত্র বিষয় এই, কত শত জনপদ ছিল , আছেও তারা, আবার নতুন কোনো নামে বর্তমানে টিকেও আছে। এরমধ্যে কোনও রাজার বা রাজবংশের নাম চিরন্তন ধারায় গেঁথে আছে, আবার কতশত হারিয়ে গিয়েছে। "- এটুকু বলে সুশোভনবাবু তার মেয়ের মুখের দিকে তাকায়। বসন্তসেনাও তন্ময় হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে সব শুনছে। সুশোভন আবার বলতে শুরু করলেন-
" ভারত যুদ্ধ বা কুরুক্ষেত্রের সেই মহাযুদ্ধের পর ভারতের রাষ্ট্রীয় জীবন বহুকাল পর্যন্ত বিপর্য্যস্ত আর বিশৃঙ্খল হয়ে ছিল। অর্জুন পৌত্র পরীক্ষিত প্রতিষ্ঠিত পৌরবংশ এবং বৃহদ্বল প্রতিষ্ঠিত ইক্ষাকুবংশ দীর্ঘ দিন ধরে উত্তর ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল শাসন করে গিয়েছেন। ইতিহাসের পাতায় এ সংবাদ অজানা। বহু রাজবংশের উত্থান ও পতন হয়েছে। জনপদ ভেঙেছে আবার নতুন করে গড়েছেও সেই সময়ে। সেইসবের বিস্তারিত বিবরণ বিশদে কোথাও বলা নেই, সেই বিবরণ জানবার উপায়ও নেই। অনেকগুলো শতাব্দীর ঘটনাপ্রবাহ অন্ধকারের আবরণে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। সে আবরণ যখন উন্মোচিত হয়, তখন আমরা ছাড়িয়ে এসেছি পৌরাণিক যুগ, উপনীত হয়েছি ঐতিহাসিক যুগে। প্রাচীন জনপদের অনেকগুলি লোপ পেয়েছে যেমন, তেমনি আবার নতুন কোনও জনপদসমূহ ইতিহাসের পাতায় ভেসে উঠেছে। এই রাঢ় তাদের অন্যতম একটি জনপদ। কেউ-কেউ বলেন নামটি গঙ্গারব্দ্ধ শব্দ থেকে উদ্ভূত, আবার কেউ-কেউ বলেন সাংস্কৃত রাষ্ট্র শব্দের অপভ্রংশ - বৈশিষ্ট্যসূচক কোন সংজ্ঞা নয়। " এই বলে তিনি একটু থামলেন। এবার বসন্তসেনা বাবার দিকে জলের বোতল এগিয়ে দিলেন। সুশোভনবাবুর সত্যি গলা শুকিয়ে এসেছিল।
🍂
এরপর সুশোভনবাবু বললেন- " বুঝলি মা, এই ইতিহাস ভীষণ এক খামখেয়ালি ব্যাপার। কে লিখে? কেন লেখে? তবে শাসকের অভিসন্ধি-তে বারবার পাল্টানো হয় এই ইতিহাস। আসল হারিয়ে যায় বা ভালোমতন বললে, ভুলিয়ে দেওয়া হয়, আর নকল কিছু ঘটনা, চরিত্র ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায়। ইতিহাস পড়তে গেলে শুধু গল্প নয়, তার পেছনের ভাবনাগুলো, সময়কে নিয়ে চিন্তাও করতে হবে। সেই সময়ের শাসকের উদ্দেশ্য ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হয়। এই যে ইতিহাস বই পড়ি আমরা সাধারণত, এ তাহলে এক গভীর ষড়যন্ত্র! ঠিক রাজবংশগুলোর মতন। প্রতিটি রাজবংশ আর শাসকের ইতিহাস তো আসলে ষড়যন্ত্রের ইতিহাস। সাধারণ মানুষের ভালো থাকবার বা মানবকল্যাণের জন্য কেউ-কেউ ভালো কাজ করে গিয়েছেন, তবে তাদের দুঃখ - দুর্দশার মূল জায়গাটার আজও সমাধান হয়নি। কেউ মানবদরদী সেজেছে, কেউ ধর্মের ভেক ধরে এসে কোটি-কোটি লোকের চোখের মণি আর পরম আরাধ্য ব্যাক্তি বা দেব হয়ে উঠেছেন, কিন্তু আজ থেকে চারহাজার বছর আগেও আসলে তারা ছিলেন আদতে রাজনীতিবিদ, এখনও সরাসরি তাই। তারা ছিলেন নিজের নামের প্রতি মোহগ্রস্ত। সেই ধার করা কথা বলতেই হয়- সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে। মোদ্দাকথা ক্ষমতা, আর ক্ষমতায় থাকতে হলে শাসকের মতন নীচ আর হীন আর কেউ হতে পারে না। মানুষের রক্তে আর মৃত্যুতে তাদের সিংহাসনে টিকে থাকবার উদযাপন চলে। হাসনু- মা, আমি রাঢ় থেকে বেরিয়ে গিয়ে ইতিহাস আর রাজনীতির অন্য দৃষ্টিকোণের কিছু বলতে শুরু করেছি। আসলে ইতিহাস আর রাজনীতি তো একই মুদ্রার এ পিঠ- আর ও পিঠ। একই ধাতুতে গড়া।" -- এই বলে কিছুক্ষণ থামলেন। বাবা আর মেয়ে নয়, শিক্ষক আর ছাত্রের একান্ত এই নিবিড় অনুশীলন ইতিহাস নিয়ে। এতক্ষণ পর বসন্তসেনা এবার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে অনর্গল কিছু কথা বলে গেল তাকে -
"রাজনীতি আর শাসনের রাষ্ট্রযন্ত্র শুধু আমজনতাকে খই আর মুড়কি ছিটিয়ে নিষ্পেষণ করে গিয়েছে। আমরা জনগণ ওতেই ধেই- ধেই করে নাচছি। অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। আমরা গনতন্ত্র বা সমাজতান্ত্রিক পথে মানুষের কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা এই দুঃখ, দারিদ্রতা, বিভিন্ন কষ্টের থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলাম। সভ্যতা নিয়ে বড়াই করি আমরা, কিসের সভ্যতা? এখনও ধর্ম , হানাহানি, বিভেদ, রাজনীতির বর্ণ নিয়ে আমরা উত্তাল হই, উদ্বেলিত হই। সেই রাজাও নেই, আর রাজাশাসিত দেশও নেই। কিন্তু এক দেশের অন্য দেশের প্রতি আগ্রাসন আছে, দখলদারি মানসিকতা বহুল পরিমাণে টিকে আছে। যুদ্ধাস্ত্রের জন্য খরচ বিপুল পরিমাণে, অথচ তার সামান্য পরিমাণও যদি গরীব দেশগুলি শিক্ষা আর স্বাস্থ্যখাতে খরচ করত, আজ পৃথিবীর চেহারা অনেক পাল্টে যেত। সারা পৃথিবী কেন মানুষের কল্যাণকামী হয়ে উঠলো না? তোমার মুখ থেকেই প্রথম শুনি, মানুষ যে কত হিংস্র আর নিষ্ঠুর হতে পারে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে লাখো- লাখো নিরীহ নারী, পুরুষ, শিশুকে এক লহমায় মেরে ফেলা। পশুরাও তাদের স্বজাতির ওপর এমন বর্বরোচিত আক্রমণ করে না!
ঠিক কিনা বাবা? "
সুশোভন মজুমদার হাসনুমায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে এবার অবাক হয়ে যায় ও ভীষণ সন্তান গর্ব অনুভব করেন ভেতরে। কবে কি করে এতটা বড় হয়ে উঠল সে। এই তো সেদিন! দীপশিখার শোক এখনও তারা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মা মরা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আবেগ অনুভূতি হলে বুকটি তখন ফেটে যায়। এজন্য তাকে এক কঠিন বর্মজাল পরিয়ে রাখতে হয়। তার মেয়ের শরীরের কোষে কোষে এক সঠিক বিশ্লেষণের ক্ষমতা জন্মেছে। তবে আজ এসব নিয়ে বিশেষ কিছুই বললেন না। তিনি আবার ফিরে আসেন রাঢ়ের ইতিহাসে।
সুশোভন বাবু তার নোটবুক নিয়ে এবারে তার থেকে বললেন- "একদম সঠিক কথা হাসনু- মা, আর সঠিক প্রশ্নগুলো রেখেছিস। তবে আজ তোকে রাঢ়ের জনপদ নিয়েই আগে আরও কিছুটা বলেনি। প্রথম সৃষ্টির পর থেকে রাঢ় নামের এই জনপদটির অবয়ব নিয়ত পরিবর্তিত হওয়ায় তাকে বরাবর অনামা থাকতে হয়েছে। নিজস্ব নামে বহুল পরিচিত হবার তার কোন দিন সুযোগ হয়নি। ঠিক যেন পৃথিবীর এক ঐশ্বর্য আর সমৃদ্ধশালী বিখ্যাত দেশ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মতন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে তেরটি স্বতন্ত্র উপনিবেশ নিয়ে এই দেশটি গঠিত হয়েছিল, এখন স্টেটসের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে পঞ্চাশে পৌঁছে গেলেও , আজও বৈশিষ্ট্যসূচক কোন নাম নেই। অথচ আধুনিক সভ্যতার ধারাকে এই দেশ যেমন প্রভাবিত করেছে, আর কেউ করেনি। মার্কিনীদের স্টেটসের ন্যায় আমাদের রাঢ়ও চিরদিন এক নামগোত্রহীন ভূখণ্ড। পৌরাণিক যুগের সুহ্ম যেখানে অবস্থিত ছিল, রাঢ়ের অভ্যুদয় হয় সেখানে। অনেকদিন পরে লিখিত দিগ্বিজয়প্রকাশ গ্রন্থে রাঢ়ের সীমানা দেওয়া আছে -
গৌড়স্য পশ্চিমে ভাগে বীরদেশস্য পূর্ব্বতঃ।
দামোদরোত্তরে ভাগে রাঢ়দেশঃ প্রকীর্ত্তিতঃ।।
এই বর্ণনায় , গৌড় নগরীর পশ্চিম দিকে, বীরভূমের পূর্বে এবং দামোদর নদের উত্তরে অবস্থিত এক সংকীর্ণ ভূভাগ রাঢ় দেশ নামে পরিচিত। অর্থাৎ এখনকার বীরভূম, বর্ধমান, হুগলী ও তার আশপাশের অঞ্চলগুলি এই ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। তবে আরও কিছু মতামত পাওয়া যায় বিভিন্ন গ্রন্থে, রাঢ় ও অঙ্গ একই জনপদ বলে। বিভিন্ন মতামত বিভিন্ন কথা বললেও, রাঢ়ের মূল ভূভাগ যে ভাগীরথীর পশ্চিমদিকে অবস্থিত সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই ভূভাগটি কিন্তু নিজের বৈশিষ্ট্যৈ স্বতন্ত্র। এখানকার মাটি কঠিন ও পাথুরে। এতে চুন ও অনেক খনিজ দ্রব্যের মিশ্রণ আছে। কয়লা ও লৌহ আকরিকে এই ভূখণ্ডের সমৃদ্ধতা সবার জানা। জনপদটি উত্তরে রাজমহল পাহাড় থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। ভাগীরথীর পূর্ব দিকের বেশ কিছু দূরের অধিবাসীরা রাঢ়ী নামে পরিচিত। আবার ভাগলপুরের অঞ্চলেও যথেষ্ট রাঢ়ীর বাস। তাদের ভাষা না বাংলা, না হিন্দী, না মৈথিলী। মানভূম অঞ্চলের রাঢ়ীবোলি এর চেয়ে বেশি শুদ্ধ। রাঢ়ী অধ্যুষিত এই অঞ্চলটি পূর্বে যশোর - খুলনার পশ্চিম দিক থেকে শুরু করে ঝাড়খণ্ডের রাঁচি পাহাড়ের সানুদেশে ঝালদা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই হল মোটামুটি ভাবে রাঢ়ের ইতিহাস- ভূগোল সবকিছু। এই হল রাঢ়ীদের বাসভূমি- রাঢ়। আজ তবে এটুকু জেনে রাখ। রাত হয়েছে, এবারে চল পান্নার সেই কোন সকালের তৈরী করা খাবার ঝটপট খেয়েনি। "
সুশোভনবাবু থামলেন এবার।
বসন্তসেনার সন্মুখে ভেসে ওঠে রাঢ়ের জঙ্গল, লালমাটির দেশ, টিলা পাহাড়, নদী, হিংস্র প্রাণীকূলের চেহারা। বন্য উপজাতিরা, যাদের পূর্ণ অধিকার এই জল- জঙ্গল- মাটির ওপর, ওদের হাজার- হাজার বছরের বাসস্থান এই আদিভূমিতে। এই ভূমি খনিজে সমৃদ্ধ অথচ তাদের সেই অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে রাঢ়ের বহির্ভূত মানুষেরা। তারা গরীব,তাদের কাঁধে তীর ধনুক। বসন্তসেনা ধীরে - ধীরে তার মনের গভীর থেকে সুসীমা হয়ে ওঠে। এখন রাত অনেক হলো, বনের ভেতর থেকে এক ভয়ানক আওয়াজ যেন ভেসে এলো। এই পৃথিবীতে কেউ বোধহয় আর জেগে নেই। বসন্তসেনা ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। সামনে যেন এক তিরতির বইছে রাঢ়ের জনপদের নদী। সে কী ভুল দেখছে? এ চোখে কোন আলো এসে হঠাৎ করে ধরা পড়ল। সেই নদী তীরে একাকী এক অশ্বারোহী দাঁড়িয়ে আছে মনে হল, স্থির তার চোখ। এদিকে হাততুলে কাউকে ডাকছে যেন সেই হালকা আলোয়। কাকে? বসন্তসেনা- কে? না, সুসীমাকেই ডাকছে মনে হলো।
ক্রমশ
0 Comments