যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব ৮৫
সন্ধ্যাবেলা স্বপ্না এসেছিল, বাবলির জন্য বালুচরি শাড়ি, জারার জন্য সুকুমার সমগ্র ও চকলেট, দীপের জন্য পেন আর দু’বাক্স মিষ্টি নিয়ে। সবাই মিলে অনেকক্ষণ গল্প হল। স্বপ্নার তো যেতে ইচ্ছে করছিল না। আমাদের রাতে ধোসা খাওয়ার প্ল্যান ছিল। স্বপ্নার সঙ্গে বাবলি দীপও বেরিয়ে গেল। ফিরে আসতে শুনলাম, ধোসা স্বপ্না কিনে দিয়েছে, বাবলিরা ওকে বিরিয়ানি কিনে দিয়েছে। স্বপ্নার আফসোস বাবলিদের সময়াভাবে একদিন খাওয়াতে পারল না। আমাকে বলছিল,দিদি চলুন না, ৪৫ মিনিটে রান্না করে নেব।
আজ সন্ধ্যায় সুতপা আর চন্দ্রিমা এসেছিল। তারপর এলো সুদীপ সৌনক। এরা দুজন আমার সুখে দুঃখে সব সময়ই হাজির থাকে। এঁরা তিনজনই জারার জন্য ইংরেজি গল্পের বই এনেছে। কী এনেছে সেটা বড় কথা নয়, দেখা করতে এসেছে, এটাই আনন্দের। আপন বলতে তো এরাই। সকালে ভাইবউ জয়নাবও এসেছিল, বিকেলে ফিরে গেছে। আগামীকাল বাবলিরা চলে যাবে। আবার কবে দেখা হবে জানি না। যেখানেই থাক, যতদূরেই থাক, যেন সুস্থ থাকে, ভাল থাকে। আমাদের কষ্ট যাওয়ার নয়, তারই মাঝে এটুকুই চাওয়ার।
বাবলিরা আজ চলে গেল। এবার নানির সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারেনি বলে ফোনে কথা বলল। যাওয়ার সময় বলে গেল, ছুটি পেলে ফেব্রুয়ারিতে আবার আসবে। ওদের ফ্লাইট আগামিকাল সকালে। আজ কলকাতায় থাকবে। মনটা খুব খারাপ, জীবনটা বৃথা মনে হচ্ছে। এত কষ্ট জীবনে ছিল ভাবিনি। আরও কত কষ্ট অপেক্ষা করছে জানিনা। আফসোস, না নিজের জন্যে না অপরের জন্যে, কারো জন্যেই কিছু করে উঠতে পারলাম না।
🍂
বাবলিরা ভালভাবে নটিংহাম পৌঁছে গেছে। আমাদের জীবনও একই ছকে চলতে শুরু করেছে। আজ আবার ওনার হাঁটাচলা, কথাবার্তা অস্বাভাবিক। কিছু মনে রাখতে পারছেন না। ভোরে উঠে বাথরুম গিয়ে সব নোংরা করে ফেলেছে। কী অসহায় দেখাচ্ছিল তখন। গরম জল করে আগে ওনাকে পরিস্কার করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ওর কাপড়জামা কেচে, বাথরুম পরিস্কার করে স্নান করলাম। তারপর চা বানিয়ে ওনাকে দিলাম, নিজেও খেলাম। আমাদের দৈনন্দিন জীবন এবাবেই চলছে।
এরমধ্যে একদিন মিলি তার বৌমাকে নিয়ে এসে ওর মেসোকে দেখিয়ে নিয়ে গেছে। আজ ‘আলোট্রাস্ট’ এর আমন্ত্রনে কলকাতা গেছেলাম, যাওয়ার সময় মাননীয় বিচারপতি অশোক গাঙ্গুলি স্যারকেও নিয়ে গেলাম। স্যারের হাত দিয়ে আমাকে ‘মানব রত্ন’ পুরস্কার দেওয়া হল। সত্যি কথা বলতে কী গাড়ির খরচ না দিলে আমি এই পুরস্কার নিতে আসতাম না। তবে না আসাটাই ঠিক ছিল, কেন? সেটা পরে বলব। যাই হোক, আমরা দুজনে অনেকের হাতে পুরস্কার তুলে দিলাম, কিন্তু সবার হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া সম্ভব ছিল না। বাধ্য হয়ে মঞ্চ থেকে নেমে বাইরে বেরিয়ে এলাম। স্যারকে একা রেখে চলে আসতে খারাপ লাগলেও আমার উপায় ছিল না। বার বার বাড়ি থেকে ওনার ফোন আসছে। পরে ওনার সঙ্গে কথা বলে দুঃখ প্রকাশ করেছি।
রহিমা হঠাৎ না বলে চলে যাওয়ার পর আজরা(মাসতুতো বোন)একটা কাজের লোক ঠিক না করে দিলে খুব ঝামেলাই পড়তাম। আজ শিক্ষক দিবস, রানী কলেজ গেছে। ওর বোন তানি আজ বাড়ি গেল। এদের পড়া শোনা নিয়ে কিছু বলা হয় নি। একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করেছি, যার ভাল করেছি বা ভাল করার চেষ্টা করেছি, সেই আমাকে ভুল বুঝেছে। আগে বলেছি মনে হয়, রানী তানি ১ বছর ৯ মাসের বড় ছোট হওয়ার জন্য রানী ছোট থেকেই মামাবাড়িতে থাকত আমার মায়ের কাছে। এখানেই স্কুলে ভর্তি হয়। ১০০/১৫০ টাকা দিয়ে গ্রুপে টিউশন পড়ত। তানির স্কুল ছিল বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে। কো এড স্কুল, ছেলেরা পড়াশোনার থেকে দুষ্টুমি বেশি করে। প্রায়দিনই সাইকেলের পাম্প খুলে দেয়। ওর মায়ের ভয় হয় ক্যানেলের পাড় দিয়ে আসে, কেউ যদি ধাক্কা দিয়ে জলে ফেলে দেয়? এদিকে এই বয়সেও মাকে সংসারের রান্না খেতে দেওয়া, সব করতে হয়। মনির বৌ খড়গপুরের অবাঙ্গালি পরিবারের মেয়ে। ওদের ছেলে রানীর থেকে প্রায় এক বছরের বড়। গ্রামে পড়াশোনা ভাল হবে না, আই অজুহাতে মনির শ্বশুরমশাই মেয়েকে খড়গপুর নিয়ে চলে গেছেন। আমি দাদা ও ভাইয়েদের বললাম, তোমাদের বৌরা তো কেউ গ্রামে থাকল না, মা কি চিরকাল সংসার ঠেলে যাবেন? সফিক (রানীর বাবা) তো বাড়িই থাকে না, তানিকে এখানের স্কুলে ভর্তি করলে ছবিও এখানে এসে থাকত। মায়ের ও আরাম হত। সেটাই করা হয়েছিল। মায়ের সেটা পছন্দ হয়নি, মনির বৌ ভাবত, তার স্বামী সব টাকা ওদের পেছনে খরচ করে দিচ্ছে। আমার ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ভাইপো ভাইঝিদের গৃহ শিক্ষকদের হাজার হাজার টাকা দিতে হয়। রানী তানিদের সে জায়গায় মাসে ৪/৫শ টাকা লাগে। ওদের পড়া শোনার কোনও গুরুত্ব ছিল না। মাধ্যমিক পাশ করার পর রানীর বিয়ের আলোচনা চলতে লাগল। মামাদের যুক্তি বেশি লেখাপড়া শিখলে যেখানে সেখানে বিয়ে করতে রাজি হবে না। ওদের বাবাও মেয়েদের পড়াশোনা বা বিয়ের দায়িত্ব নিতে নারাজ। তার যুক্তি,মামাদের বাড়িতে আছে,মামারা সবখরচ করবেন। ওদের পড়াশোনার খরচের বেশির ভাগটাই আমার ছেলে মেয়ে দেয়। রানী প্রথম বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর আমার কাছে নিয়ে আসি। আমার সঙ্গে যেটা হয়েছিল আমি চাইনি ওদের সঙ্গে সেটা হোক। আজ রানী বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রী করছে।তানিও প্রথম বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাশকরে ইংরেজি সাহিত্যে নিয়ে গড়বেতা কলেজে পড়ছে। আজ কচ্ছপ আর খরগোশ দৌড়ে কচ্ছপরা এগিয়ে গেছে।
আমাদের সংগঠন সারদা কল্যাণ ভাণ্ডার এ স্বপ্নার স্বারক বক্তৃতা ছিল। আমি যেতে পারবনা ভেবে ছিলাম, রানী টিউশন পড়তে গেলনা বলে আমি যেতে পেরেছিলাম। স্বপ্নার জন্যই আমার যাওয়া। অনেকদিন পর অনেকের সঙ্গে দেখা হল, নন্দিনীও এসেছিল। এখন খান সাহেব আগের তুলনায় একটু ভাল, তবে কতক্ষণ এই ভালটা থাকবেন, বলা মুশকিল। ঠিক মত খেতে পারলে শরীরে বল পেতেন।
এখন মহরম চলছে। শহরের ও আশপাশের গ্রামের সমস্ত তাজিয়া এই বড় আস্তানায় এসে মিলিত হয়। আগে ছাদে দাঁড়িয়ে ওদের কসরত ও লাঠিখেলা দেখতাম, এখন আর ওসব ভাল লাগে না। উঁচু উঁচু বাড়ি হয়ে যাওয়ার কারণে দ্যাখাও যায় না। মহরম চারদিন ধরে হলেও ছুটি থাকে একদিন, যেদিন মহরম শেষ। আগামিকাল মহরমের ছুটি। তাই আমি আর চন্দ্রিমা ঠিক করলাম, রজনী দলুইয়ের (বিধায়ক)বৃদ্ধাশ্রমে যাব কিছু ফল মিষ্টি নিয়ে। গিয়ে দেখলাম, এক এক জন, এক এক কারণে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিয়েছেন। এখানে এমন একজন মানুষের সঙ্গে কথা ও ব্যথা বিনিময় হল যে তাঁর এখানে থাকার কথা নয়। তাঁর পরিচয় না জেনে দুজনের একটি ব্যথাতুর মুহূর্তের ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করে ফেলি। সেই ছবি দেখে হুলুস্থুল পড়ে যায়। তাঁর পরিবারের কেউ কেউ ভাবেন আমি জেনে বুঝেই এই ছবি পোস্ট করেছি। শেষপর্যন্ত ছবিটি মুছে ফেলতে বাধ্য হই। তাই এখানেও পরিচয়টা দিতে পারলাম না।
খবর পেলাম, কুইজ কেন্দ্রের গৌতম বাবু(শিক্ষারত্ন পুরস্কারপ্রাপ্ত) অসুস্থ হয়ে স্পদনে ভর্তি আছেন। ওখানে গিয়ে দেখলাম উনি আইসিইউ তে আছেন। ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে গেছে। পরিচিতির সুবাদে একজন ভেতরে নিয়ে গেলেন। আমাকে দেখে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। মনটা খারাপ হয়ে গেল। বেরিয়ে এসে আলপনাকে সান্তনা দিলাম। খোঁজ নিয়ে জানলাম ওঁর ভাশুর এসেছেন উত্তরবঙ্গ থেকে। এখন স্নেহাশিস আছে(কুইজকেন্দ্রের সদস্য)। অনেকে সারারাত ছিল। আমারটা আমাকে একাকেই সামলাতে হয়। তবে জানতে পারলে ওরা ঠিকই আসত।
একটা কথা বলা হয়নি। আমার কলম ধরার আর একটা উদ্দেশ্য হল মুসলিমদের রীতি রেওয়াজ সমন্ধে অনেকের মনে যে ভুল ধারণা রয়েছে, সেগুলি দূর করা। হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও সে কাজ আমি করে চলেছি। আমার পক্ষে সরজমিনে কাজ করা সব সময় সম্ভব হয় না। কলম দিয়েই বেশিরভাগ কাজ করি। গতকাল আনন্দবাজার অনলাইনে মহরম নিয়ে আমার লেখা একটি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছে। যেটা পড়ে অনেক মুসলিমরাও ভুল ধারণা থেকে মুক্ত হবেন।
পাহাড়িপুর গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা আজ ফোন করেছিলেন। ওনাদের স্কুলে ২৬ সেপ্টেম্বর বিদ্যাসাগরের জন্মদিন ও স্কুলের ২০০বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আমাকে অতিথি হিসেবে থাকার অনুরোধ জানান। আরও বলেন, নারী শিক্ষা বিস্তারে বিদ্যাসাগর ভুমিকা এই বিষয়ে ১ ঘণ্টা বক্তব্য রাখতে হবে। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য বিনোদ মণ্ডল আগেই আমার থেকে জেনেছেন, আমি যেতে পারব কিনা। শহরের মধ্যে আমার তেমন অসুবিধা নেই।তাই সম্মতি দিলাম।
ওনার কানের মেশিনের ব্যাটারির জন্য টাকা দিয়ে এসেছিলাম। আজকে নিলাম। এই ওষুধ দোকানে তপনের থেকে কম দাম নিল। আজ ভেবেছিলাম নার্সিংহোম থেকে ফিরে, সব গুছিয়ে লিখতে বসব। কিন্তু হল না। উনি ফিরে স্নান, খাওয়া করে খুব ঘুমিয়েছেন। ঘুম থেকে উঠে কিছুতাই বিশ্বাস করতে চাইছেন না, এটা সকাল নয় বিকেল! ব্রাশ করলেন, চা খেলেন, এরপর পেপার চাইছেন। আমি আর রানী কিছুতেই বোঝেতে পারছিনা, এখন বিকেল। তারপর রাতে শুরু হল উপদ্রব, বার বার টয়লেট যেতে চাইছেন, আর খেতে চাইছেন, ঘুমাচ্ছেন না। তারপর বলতে শুরু করলেন, আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। সবাইকে খবর দাও, আমি আর বাঁচব না। ভোর ৩ টের সময় ফোন করে রাজুকে ডেকে স্পন্দনে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করলাম। আমিনুর(মাসতুতো ভাই)এল, ওকে ফোন করেছিলাম। ওর সঙ্গে বাড়ি ফিরে পরবর্তী কাজের প্রস্তুতি নিয়ে সকালেই স্পন্দনে হাজির হলাম। এখন শান্ত আছেন। ডাক্তার বললেন, ইউরিনে ইনফেকশন হয়েছে, বিপি হাই। কিছু টেস্ট করতে দেওয়া হয়েছে।
ভোরে মনিকেও ফোন করেছিলাম। সকালেই ও এসেছে। চন্দ্রিমা, সৌনক, সুদীপও এসেছিল। বিকেলে বোনঝি জামাই ফয়েজ এসেছিল। আর দুজন এসেছিল, যাদের উপস্থিতি আমি চাই না। পরদিন সকালে দেখলাম উনি অনেকটাই স্বাভাবিক। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললাম, বিকেকে দেখে রিলিজ করে দেবেন। বললাম, আপনার বিকেল মানে তো রাত, -আপনার বাড়ি তো কাছেই।
বিকেলে চন্দ্রিমাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে টাকা তুললাম। কত বিল করে কে জানে? যাইহোক, আজ সকালে ডাক্তার আগেই এলেন। সবকিছু মিটতে ৯ টা বেজে গেল।১৯০০০ টাকা বিল হয়েছে। তা হোক, মানুষটাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারছি, এটাই অনেক। অহরহ এই জীবন মৃত্যুর সঙ্গে যুঝতে যুঝতে আমার ভিতরের ‘আমি’টা ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। সেই কল্পনাবিলাসী মন আর নেই। কঠোর বাস্তব আমার পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে। এক পা এগোতে দিচ্ছে না।
ক্রমশ
0 Comments