জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প— গাম্বিয়া (পশ্চিম আফ্রিকা)ছাতুর জন্মকথা /চিন্ময় দাশ

চিত্র - শুভম দাস 

দূরদেশের লোকগল্প— গাম্বিয়া (পশ্চিম আফ্রিকা)
ছাতুর জন্মকথা

চিন্ময় দাশ

এক গ্রামে দুটো ছেলে ছিল। যমজ ভাই তারা দুটিতে। যত রকমের বদ গুণ হতে পারে মানুষের, সবই ছিল দুজনের। সেসবের ফলে খুব ধার-দেনা হয়ে গেল দুজনের। গাঁয়ের লোকেরা আর একটি কানাকড়িও দেওয়া বন্ধ করে দিল তাদের।
এর পর এক ঝামেলা শুরু হোল ছেলে দুটোর। যারা ধার দিয়েছিল, তাদের তাগাদা শুরু হোল। তাদের কিছু দোষ নাই। ধার দেওয়া টাকা, কত দিন ফেলে রাখবে লোকে?
তাগাদার চোটে ঘরে টেকাই দায় হয়ে উঠল দুজনের। একদিন দু’ভাই ঠিক করল—এখানে বাস করা তো দুরুহ হয়ে উঠল রে। চল, আমরা ঘর ছেড়ে পালাই। 
কিন্তু পালাই বললেই তো আর পালানো হোল না। যেখানেই যাক, কারও না কারও চোখে পড়ে যাবেই। বড়জন বলল—চল ভাই, বনে পালাই। কেউ টেরটিও পাবে না। 
বনে এসে ঢুকে পড়েছে দুটিতে। এবার ভাবতে বসল, এভাবে কত দিন পালিয়ে বেড়ানো যাবে? এদিকে দেনা শোধ করবে, কানাকড়িটিও নাই তাদের। 
অনেক ভাবনা-চিন্তা, আলোচনার পর দুজনেই একমত হোল, এখানে অনেক জমিজমা। চাষবাস শুরু করলে কেমন হয়? যা ফসল ফলবে, বিক্রি করে হাতে দু’পয়সা আসবে। দুজনের পেটও চলে যাবে। 
দু,ভাই বেদম খুশি। দেনা শোধ করে দিতে পারলে, আবার গ্রামে ফিরে যাওয়া যাবে। লুকিয়ে বেড়াতে হবে না আর। 
সকাল হলেই কাজে লেগে যায় দুটিতে। দেখতে দেখতে সুন্দর একটা খেত গড়ে উঠল। বনের ভেতরের জমি। কতদিনের অনাবাদী মাটি। ভারি উর্বর।  
চিনা বাদামের চাষ করবে ঠিক হোল। এ দেশে চিনাবাদাম চাষ হয়। নামডাকও খুব। দেখতে দেখতে খেত ভরে উঠল সবুজে। আনন্দ ধরে না দুজনের। নিশ্চয় সব দেনা শোধ হয়ে যাবে বাদাম বেচে। 
ফসল তোলার সময় এসে গেল এবার। একদিন দুজনে দুটো থলে নিয়ে খেতে এসেছে বাদাম তুলবে বলে। যা দেখল, আকাশের বাজ এসে পড়ল মাথায়। খেতের বেশির ভাগটাই লণ্ডভণ্ড। মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করা। মরে আসা গাছ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারদিকে।      
কে করল তাদের এমন সর্বনাশ? দেনা শোধ হবে কী করে। দেনা শোধ করে, ভালো মানুষ হবে বলে ঘর ছেড়ে বনে এসেছিল দুজনে। আবার কি আগের জীবনেই ফিরতে হবে তাদের? ভারি চিন্তায় পড়ে গেল দুজনে। 
নিশ্চয় এটা বনমোরগের কীর্তি। এই ভেবে একটা ফাঁদ পেতে রাখা হোল খেতে। যেমনটি ভেবেছিল তারা। ফাঁদে ধরা পড়ে গেল পাখিটা। সামনে দু’ভাইকে উদয় হতে দেখে, কী হতে যাচ্ছে, বুঝতে বাকি রইল না তার।
দু’ভাই নিজেদের ক্ষতির কথা খুলে বলল পাখিকে—তোমাকে মেরে ফেলতেই পারি আমরা। কিন্তু সেটা আমরা করব না। তার দুটো কারণ। একটা হোল, খুব খারাপ ছিলাম আমরা দুজন। এবার আমরা ভালো হব বলে ঠিক করেছি। কাউকে প্রাণে মেরে ফেলাটা ভালো কথা নয়। এজন্যই তোমাকে মারব না আমরা। 
পাখির তো ধড়ে প্রাণ এল শুনে। সে বলল—দ্বিতীয় কারণটা কী, শুনি তাহলে। 
--তোমাকে মেরে ফেলে আমাদের কোন লাভ নাই। আমাদের সমস্যা হোল দেনা শোধ করা। তুমি ফসল নষ্ট করেছে। এবার তোমার দায়িত্ব হোল, আমাদের দেনা শোধ করে দেওয়া। দেনার কোন দায় আর আমাদের নাই। কীভাবে করবে, সেটা তোমার ব্যাপার।
পাখিটা কিন্তু দমে গেল না। ডেরায় গিয়ে তার বউকে ডেকে আনল। খেতের গায়েই একটা শিমূল গাছের তলায় বাসা করে থাকতে লাগল। প্রতিদিন ডিম জড়ো হচ্ছে গাছের গোড়ায়। সেই ডিম থেকে দেনা শোধ হবে, এমনটাই ভাবনা মোরগ আর মুরগির।   
অনেকগুলো ডিম জমা হতে, ছেলেরা বলল—যাও, এবার ডিম বেচে এসো। টাকা দাও আমাদের।
মোরগ বলল—আর ক’টা দিন সবুর কর। ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোলে, দাম বেশি পাওয়া যাবে। তাতে দেনা শোধ হয়ে যাবে তোমাদের। 
কী দুর্ভাগ্য! সেদিন রাতেই সর্বনাশ। ভয়াণক ঝড়ে ডাল ভাঙল গাছটার। আর পড়বি তো পড়, ডিমগুলোর ওপরে। সব ডিম ভেঙে চুরে একাকার। 
মোরগ গাছকে বলল—এবার বাপু, দেনার সব দায় তোমাকেই নিতে হবে। যা ক্ষতি হয়েছে, সে তোমারই জন্য।
গাছ তো পড়ল মহা ফাঁপরে। দেনার অতো টাকা জোগাড় করবে কোত্থেকে? গাছটা ছিল শিমূল। সে ভাবল—এবার বেশি ফুল-ফল ফলাতে হবে আমাকে। তুলো বেচে টাকা শোধ দিয়ে দেব আমি। 
যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। প্রচুর ফুল এলো গাছে। ফলের ভারে গাছের তো ডাল ভেঙে পড়বার জোগাড়। সবাই খুশি তা দেখে। এতো তুলো পাওয়া যাবে, টাকা শোধ দিতে অসুবিধা হবে না।
শিমূল গাছটার তো বোঝা নেমে গেল মাথা থেকে। ফল পেকে উঠলেই দেনা শোধ হয়ে যাবে। 
কিন্তু ভাবলেই কি আর হয় সব কিছু? হোল না। হাতি যাচ্ছিল সেই পথ দিয়ে। শিমূলের তলায় এসে, সে তো আহ্লাদে আটখানা। 
🍂

অগুণতি ফল ঝুলছে গাছটার ডালে ডালে। আহা, কী নধর পুরুষ্টু ফলগুলো। থোকা থোকা ফলের ভারে, ঝুলে পড়েছে ডালগুলো। ফূর্তিতে লেজ নাড়তে লাগল হাতি।
হাতির পেট নয় তো, প্রকাণ্ড এক জালা। সে কি আর সহজে ভরে? যতক্ষনে থামল হাতি, গাছের ফল প্রায় সাবাড়।
খাওয়া শেষ করে, হাতি চলে যাচ্ছিল। গাছ তাকে ডেকে বলল—নাদুস পেটটি তো ভালোই ভরেছ। যাও এবার, ছেলে দুটোর দেনা কোথা থেকে শোধ করবে, সেটা ভেবে দ্যাখো। পুরো দেনার দায় এখন তোমার। 
হাতির তো মাথায় কিছু ঢুকছে না। দেনার টাকা জোটাবে কোথা থেকে? এমনটা জানলে, একটা ফলেও মুখ দিতাম না। 
কী করা যায়, কী করা যায়—ভাবতে ভাবতে তেষ্টা পেয়ে গেল হাতির। মনে ভাবল, আগে জল খেয়ে আসি। পেট ঠাণ্ডা হলে, মাথাও ঠাণ্ডা হবে। তখন কিছু একটা উপায় বার করা যাবে ভেবেচিন্তে। 
হাতি চলল নদীতে জল খেতে। নদীর পাড় থেকে নামতে যাবে, সামনে একটা লোক। সেও জল খেতে এসেছিল। এখন পাড়ে উঠে আসছে।
লোকটা হঠাৎ দেখে, সামনে সাক্ষাৎ যম। তার তো ভিরমি খাবার জোগাড়। সে বেচারা গরীব শিকারী। তীর-ধনুক নিয়ে শিকারে বেরিয়েছিল। বেলা শেষ হয়ে এল, বড় কিছু তো দূরের কতা, একটা কাঠবেড়ালিও জোটেনি আজ। 
হাতিকে সামনে দেখে, বেদম ভড়কে গেছে বেচারা। হিতাহিত বুদ্ধি উবে গেল। তীর-ধনুক ছিল হাতে। হাতিকেই একটা তীর গেঁথে দিল লোকটা। 
হাতির তো এটা মাথাতেই ছিল না। আচমকা তীর খেয়ে, মাথা ঘুরে গেল হাতির। ধপাস করে আছাড় খেয়ে পড়ে গেল বালিতে। 
যন্ত্রণায় ককাতে ককাতে হাতি বলল—আমি তো কখন উঠে দাঁড়াতে পারব, জানি না। এবার ছেলেদুটোর সব দেনা কিন্তু তোমাকেই শোধ দিতে হবে। এটা মাথায় রেখো। 
দেনা তো নয়, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল লোকটার। নিজের পেট চালাতেই হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে বেচারা। এখন পরের দেনা এসে মাথায় চাপল। ভিরমি লাগার অবস্থা বেচারার।
এদিকে সূজ্জিঠাকুরও ডুবে গেল। আঁধার ঘনিয়ে আসছে। লোকটা ভাবল, আগে তো নিজের ডেরায় ফিরে যাই। দেনার ভাবনা না হয় ঘরে পৌঁছে ভাবা যাবে। 
বাড়ির পথে হাঁটা লাগিয়েছে শিকারী। একে অন্ধকার। তার উপর মাথায় টাকার ভাবনা। হঠাৎ কিসে যেন হোঁচট লেগে, হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল লোকটা। শুধু পড়া নয়, একটা পা-ই ভেঙে গেল তার। 
হাতড়ে হাতড়ে দেখ, মোটাসোটা একটা গাছের গুঁড়ি পড়ে আছে রাস্তার উপর। পড়েও আছে একেবারে আড়াআড়ি। তাতেই হোঁচট খেতে হয়েছে তাকে। তাতেই পা-টা গিয়েছে ভেঙে। 
মেজাজ বিগড়ে গেল মানুষটার—দাঁত খিঁচিয়ে উঠে বলল—আক্কেল বলে কিছু নাই তোমার? এইভাবে রাস্তায় গড়াগড়ি যায় না কি কেউ। এখন আমার কী হবে? নিজের ভাঙা পায়ের চিকিচ্ছে করব, নাকি পরের দেনা শোধ করব? 
গাছের গুঁড়ি বলল—পা-টা ভেঙেছে তোমার, এটা মানছি। কিন্তু দেনার ব্যাপারটা কী? সেটা তো বুঝলাম না।   
লোকটা পায়ের ব্যাথায় কাতর। কোন রকমে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল গাছকে—তোমার জন্য আমার পায়ের এই দশা। এখন দেনা শোধ করার দায় তোমাকেই নিতে হবে। 
এই বলে লোকটা বাড়ি চলে গেল। গাছ ভাবতে লাগল—আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়লাম তো। আমি একটা মরা গাছের গুঁড়ি। আমি কী করে লোকের দেনা শোধ করব? 
গুঁড়িটার তলায় উইপোকাদের বাসা। গাছের গুঁড়ির মনমরা ভাব দেখে, তাদের রানি বলল—কী হোল, কর্তা? মন ভার কেন? 
--সাধে কি মন ভার হয়, দিদি। এমন উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে গেলাম, যে বলবার নয়। কাঠ কাটল কাঠুরিয়া। এভাবে পথের উপর ফেলে রেখে গেল। আর, তার ঠ্যালা আমাকে সামলাতে হবে। এখন কী করি আমি? 
পরিষ্কার করে পুরো ব্যাপারটা জেনে নিল উইরানি। গাছের গুঁড়ি কুরে কুরে খেয়ে, পেট ভরে তাদের। আজ গুঁড়িটা বিপদে পড়েছে। এ সময়ে তার পাশে থাকা দরকার। 
রানি একটা সভা ডাকল পোকাদের। সাপের লেজের মতো লম্বা কাহিনী। সবাই শুনল মন দিয়ে। বেরও করে ফেলল একটা উপায়। সবাই কাজে লেগে গেল সাথেসাথে।
উইপোকারা করলো কী, গাছের গুঁড়িটাকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলল সেদিন রাতেই। দু’দিন না যেতেই, স্যাঁতসেঁতে মাটিতে ছাতু গজিয়ে উঠল। 
খবর জেনে, বনমোরগ, শিমূল গাছ, হাতি, শিকারী সবাই এসে হাজির হোল সেখানে। সবাই বাহবা দিতে লাগল উইপোকাদের। দেনা শোধের হিল্লে হয়ে গিয়েছে।
বনমোরগ গিয়ে, সেই দুই ভাইকে ডেকে আনল । সব দেখেশুনে, ভাই দুটো তো ভারি খুশি। 
একদিন নয়, দু’দিন নয়। অনেক দিন ধরে ছাতু গজাতে লাগল মজা গুঁড়িতে। সকাল হলেই, ছেলে দুটো এসে হাজির হয়ে যায়। প্রতিদিন সকালে উঠে ছাতু তোলে, আর বাজারে গিয়ে বেচে আসে। ক’দিন বাদেই সব দেনা শোধ হয়ে গেল তাদের।

Post a Comment

0 Comments