সবুজ দ্বীপ আন্দামান
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
সপ্তদশ পর্ব
পূর্ব প্রকাশিতের পরবর্তী অংশ
পরের দিন সকালে যেয়ে ডাক্তার রতন চন্দ্র কর জারোয়াদের সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য আমাকে যা যা বলেছিলেন সেটি এখন পাঠকের অবগতির জন্য লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করছি।
ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পরে উপনিবেশবাদের যুগ শেষ হয়ে শুরু হলো উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের। স্বাধীনতার জন্মলগ্নেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের উপরে অকথ্য অত্যাচারের ফলে তারা পূর্বপুরুষদের ভিটেমাটি ছেড়ে একবস্ত্রে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে আসেন। তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও নব রূপকার ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় এই সমস্ত মানুষদের পুনর্বাসনের জন্য প্রথমে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং পরবর্তীতে ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং ছত্রিশগড় রাজ্যের সীমানায় দণ্ডকারণ্যে উপনিবেশ স্থাপন করে সেখানে এই সমস্ত মানুষদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। দণ্ডকারণ্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি, কিন্তু আন্দামানে ফলপ্রসূ হয়েছে। উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের প্রারম্ভিক অবস্থায় অরণ্যচারী জারোয়াদের সাথে প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ হত পুলিশ এবং পুনর্বাসন প্রাপ্ত মানুষদের, কারণ জারোয়ারা তাদের অরণ্যে সভ্য মানুষদের বসবাস সন্দেহের চোখে দেখত। উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে আন্দামানের আদিম অরণ্যচারী মানুষদের স্বার্থ রক্ষার কথা সকলেই ভুলে গেছলেন। দক্ষিণ আন্দামানের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে মধ্য আন্দামানের উত্তর দিগন্ত পর্যন্ত যে গভীর অরণ্য ছিল তাদের ঠিকানা উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের যুগে এবং আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড স্থাপনের ফলে জারোয়াদের স্থায়ী ঠিকানা পাল্টে গেল। তারা পিছু হটতে দক্ষিণ ও মধ্য আন্দামানের পশ্চিম সমুদ্র তটসংলগ্ন অরণ্যে যেয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হল। আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড যে অঞ্চল দিয়ে গেছে সেই অঞ্চলের গভীর অরণ্য সুদূর অতীতে গ্রেট আন্দামানিজদের দখলে ছিল। জারোয়াদের চিরশত্রু গ্রেট আন্দামানিজদের সাথে প্রায়ই তুমুল লড়াই হত জারোয়াদের। লড়াই করেই তারা টিকে ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের সময় থেকে সরকারি প্রশাসনের আগ্নেয়াস্ত্রের কাছে নতি স্বীকার করে এলাকা ছেড়ে তারা চলে যেতে বাধ্য হয়।
বর্তমানে আন্দামানে যে সমস্ত জারোয়ারা আছে তাদেরকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। ক) দক্ষিণ আন্দামানের তীরুর জঙ্গল ও আশেপাশের সমুদ্রতট যেখানে ভইয়াব্ অঙ্গ জারোয়ারা থাকে। খ) দক্ষিণ আন্দামানের আর,কে, নালা, মিডলস্ট্রেট সংলগ্ন জঙ্গল এবং পশ্চিম সমুদ্রতট যেখানে থিডং অঙ্গ জারোয়ার বাস করে। গ) মধ্য আন্দামানের পশ্চিম সমুদ্র তটসংলগ্ন জঙ্গল যেখানে তানমাড অঙ্গ জারোয়ারা বাস করে।
🍂
এদের বাসস্থান গুলিকে চাড্ডা বলে। ভইয়াব্ অঙ্গ জারোয়াদের চাড্ডাগুলি ও তার আশেপাশে তিরুর ও ওয়ান্ডুরে পুনর্বাসন প্রাপ্ত মানুষজন অতীতে শিকারে গিয়ে অনেকেই তীরবিদ্ধ হয়ে জারোয়াদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে। শুধু লোকালয়ের শিকারী নয় বহিরাগত শিকারী যারা মায়ানমার ও থাইল্যান্ড থেকে আগত শিকারীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হত। এইসব এলাকা থেকে অতীতে জারোয়ারা প্রায়ই কাছাকাছি পুনর্বাসন প্রাপ্ত মানুষদের গ্রামগুলি আক্রমন করত। শেষবার আক্রমণ হয়েছিল ১৯৯৮ সালের মে মাসে যখন তারা এক বৃদ্ধাকে তীর বিদ্ধ করে মারে, যিনি প্রায়ই তাদের কুটিরগুলির নিকটে শিকার করতে যেতেন। ভইয়াব্ অঙ্গ জারোয়াদের এই এলাকায় এগারোটি চাড্ডা বা কুটির আছে। থিডং অঙ্গ জারোয়াদের এলাকায় আটটি চাড্ডা আছে। তন্মধ্যে পোর্ট ক্যাম্বেল এলাকায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানী সৈন্যরা সন্দেহ করেছিল ইংরেজ সৈন্যরা এই কুটির গুলিতে লুকিয়ে আছে। ফলে তারা এলোপাথাড়ি বোমাবর্ষণ করে কুটিরগুলি ধ্বংস করে এবং তাতে বেশকিছু জারোয়া প্রাণ হারায়। তানমাড্ অঙ্গ জারোয়াদের এলাকায় তাদের চব্বিশটি কুটির আছে। এছাড়াও আন্দামান ট্রাঙ্ক রোডের ধারে জারোয়ারা অনেক কুটির বানিয়ে এখন থাকছে এবং সেই কুটীরের সংখ্যা প্রায় বারো। সমগ্র আন্দামানে মোট ৫৫ টি জারোয়াদের কুটির স্থান বা চাড্ডা আছে। এই কুটিরগুলি তৈরি করার সময় তারা একটু উঁচু জায়গা পছন্দ করে। কুটিরগুলি সাধারণতঃ সমুদ্রের তীর থেকে একটু দূরে জঙ্গলের মধ্যে হয় যাতে বহিরাগতদের নজর সহজে না পড়ে এবং সমুদ্রের ঝড়ো হাওয়া কুটিরের কোন ক্ষতি করতে না পারে। কুটিরগুলি দুই ধরনের হয় - ব্যক্তিগত ও সম্প্রদায়গত। সম্প্রদায়গত কুটিরের সংখ্যা কিছুটা কম। এক-একটা সম্প্রদায়গত কুটিরে ৫০ থেকে ৬০ জন জারোয়া থাকে। আবার ব্যক্তিগত কুটিরে একটি পরিবার থাকে। তবে এই কুটিরগুলিও সব পাশাপাশি থাকে। জারোয়ারা অর্ধ যাযাবরের মতো জীবন যাপন করে। তাই তারা এক কুটিরে বেশিদিন থাকে না। সম্প্রদায়গত কুটির গুলির মধ্যে এক একটি পরিবারের জন্য এলাকা বা জায়গা ভাগ করা থাকে। কুটির গুলির উচ্চতা মাটি থেকে ৫-৬ ফুট উঁচু। কুটিরের ছাউনী গুলি পাতা দিয়ে তৈরি। জারোয়ারা এই পাতাকে বলে 'থুইয়া পাতা', আমাদের লোকালয়ের মানুষজন বলে ধানিপাতি। বোটানিক্যাল নাম Nipa frutican। ঘর বানানোর জন্য গাছের ডাল ও লতাপাতা ব্যবহার করে, কোন রকম পাথরের ব্যবহার করে না এবং সমুদ্রের শেল বা সিপি ব্যবহার করে না। কুটিরগুলিতে শোয়ার জন্য জারোয়াদের বিছানা বলে কিছু নেই। সামান্য কিছু পাতা পেতে অথবা ঘরের মেঝেতে মাটির উপর শুয়ে থাকে। তবে ঘরের মেঝে যথাসম্ভব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখে। নবজাতক শিশু ও তার মা কাঠের পাটাতনের উপরে শোয়। এই পাটাতন সরু সরু কাঠ চিরে বানানো হয়। কাঠের পাটাতন মাটি থেকে বেশি উঁচুতে নয়। মাথার দিকে তারা বালিশের মত একটি শক্ত কাঠের টুকরো অথবা পাথরের টুকরো ব্যবহার করে। সম্প্রদায়গত কুটিরে এক একটি পরিবারের জন্য নির্দিষ্ট জায়গার মাঝখানে যে ফাঁকা জায়গা থাকে সেখানে তারা আগুন জ্বালিয়ে রাখে। এর ফলে তারা শীতের হাত থেকে রক্ষা পায় এবং আগুনের ধোঁয়া তাদেরকে খাঁড়ি অঞ্চলের মশার কামড়ের হাত থেকে বাঁচায়। অবশ্য মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য তারা কিছু লতার রস সর্বশরীরে মাখে। এইসব লতার রস মেখে তারা জঙ্গলে যেয়ে মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করে। এইসব লতাগুলিকে জারোয়ারা বলে ' থাঙ্কাবাজেটা', 'তিদাংওয়ে' এবং 'হুইয়া' যেগুলি আন্দামানের জঙ্গলে পাওয়া যায়। এই কুটিরে থাকার সময়ে বিছা ও সাপের কামড় হাত থেকে বাঁচার জন্য তারা নিজস্ব প্রথাগত চিকিৎসক দ্বারা সমাধান করে। জারোয়াদের এই কুটির গুলির চারিদিক খোলা থাকে। দেওয়াল, জানলা বা দরজার বালাই নেই। চারিদিক খোলা থাকায় কুটিরে হাওয়া চলাচলের কোন সমস্যা হয় না। ঘরের মধ্যে যে সমস্ত কাঠের খুঁটি বা বল্লী থাকে তাতে মধুর পাত্র, জলের পাত্র ও অন্যান্য গৃহস্থালি সামগ্রী ঝুলিয়ে রাখে। শিকার সামগ্রী বা আহরণ করা কলা, ফলমূলও তারা এই ভাবেই রাখে। কুটিরের মাঝখানে উনুন থেকে আগুন জ্বলে, তার উপরে শিকার করা মাংসের টুকরোগুলো ঝুলিয়ে রাখে। এতে মাংস ঝলসে 'রোস্ট' হয়ে যায়। পরে প্রয়োজনের সময় তা নামিয়ে এনে রান্না করে অথবা সরাসরিও তা খায়। জারোয়ারা অর্ধ যাযাবর হলেও যখন এক কুটির থেকে অন্য কুটিরে যায় তখন কিন্তু কুটিরগুলি তারা ভেঙে দেয় না। পরিবর্তনের ছোঁয়ায় অনেক কুটির আজ অবলুপ্ত হয়ে গেছে। শুধুমাত্র প্রধান কুটির গুলি যেগুলি আজও বিদ্যমান এবং জারোয়াদের দ্বারা ব্যবহৃত তাদের সংখ্যা উপরে দেওয়া হয়েছে। আদিম জনজাতি জারোয়ারা কুটিরের নামকরণ করে জায়গার বিশেষত্ব বা পূর্বপুরুষদের নাম দিয়ে। পূর্বপুরুষদের কথা স্মরণ করা, তাদের মর্যাদা ও শ্রদ্ধা জানানোর মধ্যে তাদের উন্নত মনের পরিচয় পাওয়া যায়। সম্প্রদায়গত কুটিরগুলি এক একজন জারোয়ার তত্ত্বাবধানে থাকে। যে কুটিরে জারোয়া শিশু তার মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয় তা তার কাছে জন্মভূমি। সেই কুটির তার কাছে খুবই প্রিয় এবং স্বর্গের সমান। তাদের এই জন্মভূমিকে জারোয়ারা বলে 'ওলকথে'।
পরবর্তী অংশ অষ্টাদশ পর্বে
0 Comments