জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক প্রিয়দারঞ্জন রায় /নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক প্রিয়দারঞ্জন রায়
নির্মল বর্মন

বৈজ্ঞানিক ,দার্শনিক, অধ্যাপক প্রিয়দারঞ্জন রায় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার নয়াপাড়া গ্রামে, ১৮৮৮ সালের ১৬ই জানুয়ারি পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন। পিতা জমিদার কালীচরণ রায় চট্টগ্ৰামের রাঙামাটির সাব ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন,মাতা শ্যামাসুন্দরী দেবী।ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবাংলার হুগলীর ত্রিবণীতে পৈত্রিক বাসস্থান ত্যাগ করে পূর্বপুরুষেরা ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। সামাজিক অস্থিরতা ত্রিপুরা'তেও ছড়িয়ে পড়ার ফলে পরিবারের বয়োজ্যোষ্ঠরা চট্টগ্রামের নয়াপাড়া কে'ই বেছে নিলেন। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল ও কলেজে উচ্চ শিক্ষার প্রাথমিক পাঠ চুকিয়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় সাম্মানিক স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সৌজন্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে গোল্ড মেডেল লাভ করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন।প্রিয়দা তৎকালীন সময়ে রসায়ন শাস্ত্রে এম.এ পাশ করার ফলে বাংলার সারস্বত সামাজিক সাড়া পড়ে গেছিল। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক প্রিয়দা রঞ্জন রায় পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা ,শারীরবিদ্যা প্রভৃতি বিজ্ঞানের শাখা-প্রশাখায় তাঁর পান্ডিত্য চিরস্মরণীয়। পরম পূজনীয় শিক্ষক আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের গবেষণাগারে গবেষণা শুরু করেছিলেন ১৯১১ তে। হঠাৎই ছন্দপতন। আকস্মিক দুর্ঘটনায় গবেষণাগারে তার দুটো চোখের বেশিরভাগটি ক্ষতি হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও  মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করে মেধাব্রতকে পাথেয় করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোষ ট্রাভেলিং ফেলোশিপ নিয়ে ১৯২৯ সালের বিদেশ যাত্রা শুরু করেন। প্রথমে সুইজারল্যান্ডের বার্ণে বিখ্যাত রসায়নবিদ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ফ্রিৎস  ও অস্ট্রিয়ার গ্রাজে মাইক্রোকেমিস্ট অধ্যাপক ফেডারিক এমিটের গবেষণাগারে গবেষণা করে সসম্মানে দেশে ফিরে আসেন। ভারতের রুবিয়ানিক অ্যাসিড আবিষ্কর্তা অধ্যাপক প্রিয়দারঞ্জন রায় ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে ১১ই ডিসেম্বর ৯৪ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
অধ্যাপক প্রিয়দারঞ্জন রায় প্রাচীন ভারতের আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ক গ্রন্থ সম্পাদনা করেছিলেন। প্রিয়দারঞ্জন রায়ের দেশ, নব্যভারত , প্রবাসী ও ভারতবর্ষ, পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি প্রকাশিত হয়েছিল । বাংলা ভাষায় রচিত তার পুস্তকাদি হলো--
     "অতিকায় অণুর অভিনব কাহিনি", "বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি", "বিজ্ঞান ও বিশ্বজগৎ" , "রসায়ন ও সভ্যতা" ও "বিজ্ঞান দর্শন ও ধর্ম"  ইত্যাদি  অভিনব গ্রন্থ রচনা করেছেন।
বৈজ্ঞানিক প্রিয়দারঞ্জন রায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের খয়রা ও পালিত অধ্যাপক পদ অলংকৃত করেছিলেন। ১৯৩২ এ ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের রসায়ন শাখার সভাপতি মনোনীত হয়েছিলেন। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন ।ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটির সভাপতি তিনি। অধ্যাপক প্রিয়দারঞ্জন "ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দা কাল্টিভেসন অফ সায়েন্স" এর  অবৈতনিক অধ্যাপক, এশিয়াটিক সোসাইটির সহ-সভাপতি ও "সায়েন্স এন্ড কালচার" পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক হিসেবে সুযশ অর্জন করেছিলেন।
দার্শনিক প্রিয়দারঞ্জন রায়ের "বিজ্ঞান দর্শন ও ধর্ম"গ্রন্থের সংকলিত "মানবসভ্যতা ও বিজ্ঞান" প্রবন্ধে সম্মানীয় অধ্যাপক মানবসভ্যতা ও বিজ্ঞানের নানা দিক আলোচনা করে , বিচারবিশ্লেষণ করে, মানব কল্যাণের অগ্রগতিতে বিপুল সাফল্যে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।
🍂

তাঁরই কথাতেই বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে 'মানুষের জ্ঞানের প্রসার বেড়ে গেছে বিস্ময়কর ভাবে'। বিজ্ঞানের অবদান স্বরূপ --জ্যোতির্বিজ্ঞানে নক্ষত্রের বা তাদের দেহপিন্ডের ভগ্নাবশেষের আবিষ্কার , পদার্থ বিজ্ঞানের বিভিন্ন রশ্মির আবিষ্কার , রসায়ন বিজ্ঞানে কোয়ান্টাম তত্ত্ব আবিষ্কার, ভূ-বিজ্ঞানের শিলা স্তরের গঠন , জীব বিজ্ঞানের জীন ও জীবকোষ সম্পর্কিত আবিষ্কার মানুষের জ্ঞানের পরিধিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। আজ মানুষ তাই রাগিংকে শিল্পজ্ঞান হিসাবে বিবেচনা করছে । চিকিৎসা বিজ্ঞানেও আবিষ্কার হয়েছে বিজ্ঞানেরই জন্য। যেমন --"অন্তত পুষ্টি" ,"রোগ জীবাণু" ,"বিষ",  "টিকা" ইত্যাদি। তা সত্ত্বেও কম্পিউটারের আবিষ্কার গণিত শাস্ত্র কে সমৃদ্ধ করেছে। বৈজ্ঞানিক প্রিয়দারঞ্জনের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য " বিজ্ঞান চর্চার ফলে মানুষের হাতে এসেছে আজ অভাবনীয় ক্ষমতা ( দেবতার ক্ষমতা) ও কুবেরের ধনভাণ্ডার"।
দার্শনিক প্রিয়দারঞ্জন রায় বিজ্ঞানের অপব্যবহার সম্পর্কেও ব্যাপক আলোকপাত করেছেন। দুই বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক ও হাইড্রোজেন বোমার ব্যবহার বিজ্ঞান চায়নি। তাই সম্মানীয় বৈজ্ঞানিক, প্রাবন্ধিক প্রিয়দারঞ্জনের  মন্তব্য যেন  বিজ্ঞানেরই সিদ্ধান্ত--
          "পৃথিবীর বর্তমান সভ্যতা অপ্রতিহত গতিতে  এগিয়ে 
         চলেছে এক বিপুল সংকটসঙ্কুল অবস্থার অভিমুখে।
           আমাদের প্রাচীন সভ্যতা যাচ্ছে ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ 
            হয়ে এবং তার শাশ্বত মূল্যবোধ ওলটপাল ও 
           ধুলিস্যাৎ হচ্ছে"।
প্রাবন্ধিক প্রিয়দারঞ্জন রায় বৈজ্ঞানিক হওয়ার জন্য উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, বিজ্ঞানের আবিষ্কার কে মানব কল্যাণে নিয়োজিত করতে না পারলে বিজ্ঞানের অপব্যবহার সুনিশ্চিত। সেই জন্য দরকার নীতিবোধ ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও ধারণা---
"এরই প্রেরণায় মানুষ চায় তার অন্তর্জগতের মধ্যেই অসীম বিশ্বজগতের উপলব্ধি করতে বা অনন্তের সংগীত শুনতে সীমার মাঝে অসীমের সুর শুনতে"।
বৈজ্ঞানিক প্রিয়দারঞ্জন রায় আয়ুর্বেদ সম্বন্ধে আস্থাশীল ছিলেন। অজৈব রসায়নে পাণ্ডিত্যের জন্যই আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের প্রিয় ছাত্র প্রিয়দারঞ্জন এর সম্পর্কে গঠনশীল মননশীল মন্তব্য এ যুগের অধ্যাপকদের জানানোর জন্যই  প্রণিধানযোগ্য--
   "প্রিয়দারঞ্জন  রায়কে কমপ্লেক্স ও ভ্যালেন্সি এবং মাইক্রোকেমিস্ট্রি বিষয়ে এক স্বীকৃত কর্তৃপক্ষ হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। কেমিক্যাল সোসাইটিতে কোন লেখা পাঠানোর আগে আমার অভ্যাস হলো আগে তাকে দেখিয়ে তার সমালোচনা ও মতামত গ্রহণ করা। ১৯২৬ এবং ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটির বার্ষিক সবার জন্য আমার সভাপতি'র ভাষণ। মোটামুটি তার অভিমত ও পরামর্শে তৈরি হয়"।
         "

Post a Comment

0 Comments