জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব- ৮৪
গ্রামদেবতা: ভাশুর- বুয়াসিন ও ননদ- ভাজ
সূর্যকান্ত মাহাতো
গ্রামঠাকুরের নাম যখন "ভাশুর-বুয়াসিন", কিংবা "ননদ-জা" হয় তখন অবাক তো হওয়ারই কথা। কল্পিত বা লৌকিক যাই হোক না কেন দেব-দেবীদের একটা নির্দিষ্ট নাম থাকে। ওই নামেই তারা পূজিত হন। সেইসব নামের নানা বৈচিত্র্যও আছে। সরাসরি নামেও যেমন তারা পরিচিত, তেমনি আবার নামের শেষে 'বাবা' কিংবা 'ঠাকুর' যোগেও একাধিক দেবদেবীর নাম রয়েছে। কিন্তু কোন সম্পর্ক নিয়েও যে গড়ে উঠতে পারে কোনো দেব-দেবী তা জানলে অবাক না হয়ে পারা যায় না। তবে দেব-দেবী বলতে আমরা সচরাচর যা জানি এরা সেরকম 'দেব-দেবী' নন। এরা 'গ্রামঠাকুর'। মিহির চৌধুরী কামিল্যা বলেছেন,এরা 'রাঢ়ের পূর্বপুরুষ' রূপেই পূজিত হন। বাঁকুড়া জেলার দুটি ভিন্ন ভিন্ন গ্রামে এই 'সম্পর্ক' নামে পরিচিত 'মানুষ', 'দেব-দেবী' রূপে পূজিত হয়ে আসছেন। 'থুমপাথর' গ্রামে পূজিত হচ্ছেন 'ভাশুর-বুয়াসিন' এবং 'দেমুসনা' গ্রামে পূজিত হচ্ছেন 'ননদ-ভাজ'।
কিন্তু 'মানুষ' কীভাবে ঠাকুর হয়ে উঠলেন, সে প্রসঙ্গে মিহির চৌধুরী কামিল্যা বলেছেন, 'সব গ্রামঠাকুর কল্পিত নয়, কোন কোন কারণে মানুষও দেবতার মতো পূজা পেয়েছে। (রাঢ়ের পূর্বপুরুষ পূজা, পৃষ্ঠা ৬) তাই বলে একটি সম্পর্কে জড়ানো দুটো মানুষ কীভাবে একটি গ্রামের ঠাকুর হয়ে উঠতে পারে? কি এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল? এই দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরটা অনুসন্ধান করলেই অনেক কিছু সহজেই বোঝা যাবে। আসলে 'গ্রামদেবতা' ভাবনার মূলে ছিল প্রাক-আর্য বা প্রত্ন-মানুষের 'ভয়'। এবং সেই 'ভয়' থেকেই আত্মরক্ষার উপায় হিসেবে তাদের মধ্যে এমন ভাবনা গড়ে উঠেছিল। কিন্তু কেন? কারণ আদিম মানুষের 'অজ্ঞানতা' ছিল এর প্রধান একটা কারণ। তাদের প্রাকৃতিক শক্তিগুলো সম্পর্কে তখন কোন স্পষ্ট ধারণা ছিল না। আবার কোন কিছুর কার্যকারণ ব্যাখ্যা করার মতো বোধ বুদ্ধি বা ক্ষমতাও ছিল না। তাই তো মিহিরবাবু বলেছেন হিংস্র প্রাণী, প্রাকৃতিক রহস্য, পাহাড়, পর্বত, নদী, আকাশকে আদি মানুষেরা যেমন ভয় পেত, তেমনি মৃত মানুষকেও তারা ভীষণ ভয় পেত। (রাঢ়ের পূর্বপুরুষ পূজা, পৃষ্ঠা- ১০) আর এই মৃত ব্যক্তি থেকে ভয়টাই নাকি জন্ম দিয়েছিল ভূত-প্রেত, আত্মা, দানা, ডাইনী ইত্যাদির।
আর এখান থেকেই প্রথম প্রশ্নটার উত্তর পাওয়া যায়। সেটা হল 'ভয়'। কারণ দুটো সম্পর্কেই 'ভাশুর', 'বুয়াসিন' এবং 'জা'(ননদ বাদে)- এর অকাল মৃত্যু এবং তজ্জনিত ভয়ের কথা এখানকার জনশ্রুতি বা লোককাহিনীগুলিতে ছড়িয়ে রয়েছে। সেইসব কাহিনীতে ভাশুর, বুয়াসিন ও জা-কে পিটিয়ে মেরে ফেলার কথাই বলা হয়েছে। এবং তাদের অশরীরী আত্মা বা ভূতের দ্বারাই গ্রামের অনিষ্ঠ সাধন ঘটছিল বলে গ্রামবাসীদের ধারণা হয়েছিল। তাদের অশরীরী আত্মা গ্রামবাসীদের নানা রকম অনিষ্ট করছিলেন বলে গ্রামবাসীদের যে ধারণা সেই বিশ্বাস থেকেই গ্রামবাসীরা তাদের 'ঠাকুর' বলে পূজা করে চলেছেন। সুতরাং 'ভয়' থেকেই যে 'ভক্তি'র জন্ম হয়েছে সেটা বোঝাই যায়। তাদের বিশ্বাস ওই গ্রামঠাকুরের কৃপাতেই তারা সকলে ভালো আছেন।
শুশুনিয়া পাহাড়ের কোলে অবস্থিত 'থুমপাথর' গ্রাম। বাউরি সম্প্রদায়ের বসবাস। এ গ্রামেই পূজিত হয়ে চলেছেন গ্রামঠাকুর 'ভাশুর-বুয়াসিন'। গ্রামের উত্তর পূর্বে দুটি রহস্যময় মূর্তি আঁকা শিলা পোঁতা আছে। একটির উচ্চতা চার বাই আড়াই ফুট খাড়া, এবং অন্যটি ৪× ২ ফুট হেলানো। (রাঢ়ের পূর্বপুরুষ পূজা, পৃষ্ঠা- ৫০) এই খাড়া শিলাটি নাকি ভাশুরের। যার একটি হাতে ধরা আছে তরোয়াল এবং অন্য হাতে ধনুক। আর হেলানো শিলাটি বুয়াসিনের বলে লোকে কল্পনা করে আসছেন। যার একটি হাতে তীর এবং অন্য হাতে ধনুক রয়েছে।
কিন্তু 'ভাশুর' ও 'বুয়াসিন' কীভাবে একত্রিত অবস্থান করছেন? যেখানে এই সম্পর্কটাই সমাজে একটা জটিল সম্পর্ক। সর্বক্ষণ একটা লজ্জা সম্ভ্রম এবং ভয়ের ব্যবধান যেন ঘিরে থাকে সম্পর্কটিতে। তবে মিহিরবাবু এর একটা যুক্তিও খুঁজে পেয়েছেন। তিনি বলেছেন, এ অঞ্চলের লোককথায় নাকি ভাশুরের সঙ্গে বুয়াসিনের গ্রাম ছেড়ে যাওয়া কিংবা বুয়াসিনকে নিয়ে ভাসুর ভিনদেশে চলে গেছেন এমন 'লোকগল্প' প্রচলিত আছে। সে প্রসঙ্গে তিনি একটি টুসু গানের কথাও উল্লেখ করেছেন। (রাঢ়ের পূর্বপুরুষ পূজা, পৃষ্ঠা- ৫১)
'বাড়ি নাময় লাহেড় বুনলাম লাহেড় হল্য চমৎকার
কলের পুরুষ(স্বামী) চাকরি গেল, ভাসুর হল্য গলার হার।'
'ভাশুর- বুয়াসিন' গ্রামদেবতার গল্পটাও নাকি সে রকমই। গ্রামের মানুষেরা বলেন, অন্য গ্রাম থেকে একদিন এই দুই নারী পুরুষ এই 'থুমপাথর' গ্রামে এসেছিলেন। এখানে কুঁড়েও বেঁধেছিলেন। তারপর হঠাৎ একদিন কিছু লোক এসে তাদের উপর চড়াও হয়। এই নারী-পুরুষের সম্পর্কটা তারা মেনে নেয়নি। ঐ নারী পুরুষের সম্পর্কটা নাকি ছিল ভাশুর ও বুয়াসিনের। এবং তারা অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিল। আগত ঐ দলেই নাকি ছিল মেয়েটির স্বামী। তারা ভাশুরটিকে মেরে ফেলে এবং স্বামীটি তার স্ত্রীকে ওখানেই জ্যান্ত কবর দিয়ে চলে যান।
কিন্তু প্রশ্ন হল, তারা গ্রাম দেবতা হয়ে উঠলেন কীভাবে? ওই ঘটনার পরে নাকি গ্রামে ভূতের নানান উপদ্রব শুরু হয়েছিল। তখন গ্রামবাসীরা ভয় পেয়ে পরিত্রান পেতেই সেই কবরে গিয়ে ভাশুর ও বুয়াসিনকে পূজা করেন। তারপর সেই উপদ্রব বন্ধ হয়েছিল বলে গ্রামবাসীরা বিশ্বাস করেছিলেন। সে বছর নাকি ভালো শস্যও ফলেছিল। সেই থেকে এই পূজার প্রচলন শুরু।
লোককথাকে যদি একটু সরিয়ে রেখে বিষয়টা ভাবা হয়, তাহলে এমন শিলালেখ সম্পর্কে আর ঠিক কী কী জানা যায়, সেই প্রসঙ্গে মিহির চৌধুরী কামিল্যা বলেছেন, এমন শিলাস্তম্ভগুলো মৌজা জয় বা ছোট ছোট রাজ্য জয়ের 'বিজয়স্তম্ভ' রূপেও প্রতিভাত হত।(রাঢ়ের পূর্বপুরুষ পূজা, পৃষ্ঠা- ৫২) কোন কোন রাজা আবার নিজের রাজ্যেও এমন 'বিজয়স্তম্ভ' স্থাপন করতেন। 'বিনয় ঘোষ' এগুলোকে 'বীরস্তম্ভ' বা 'স্মৃতিস্তম্ভ' বলে ধারণা করেছিলেন। এই শিলাস্তম্ভগুলিকে তিনি আবার 'মেগালিথিক' সংস্কৃতির নিদর্শন বলেও উল্লেখ করেছিলেন।(পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, অখন্ড সংস্করন/ বিনয় ঘোষ, পৃষ্ঠা- ৬৪৯) ছাতনার 'জিড়রা' গ্রামেও একটি 'শিলাস্তম্ভ' আছে। তাকেও গ্রামবাসীরা গ্রামঠাকুর 'খুদ্যানাড়া' রূপে পূজা করেন। অন্য একটি মত এই শিলাস্তম্ভগুলোকে বলে, এগুলো নাকি মুন্ডা বা ভূমিজদের সমাধি প্রথার নিদর্শন। যদিও এই গ্রামে কোন ভূমিজদের বসবাস নেই। আবার অন্য একটি যুক্তিও উঠে আসে। এগুলো নাকি 'যজ্ঞস্তম্ভ'। অথচ যজ্ঞেরও কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে মিহির চৌধুরী কামিল্যা মহাশয়ও জানিয়েছেন। বরং শিলা দুটি যেভাবে গ্রাম সীমান্তে পোঁতা আছে, তাতে ওগুলো বিজয়স্তম্ভ হওয়াটাই বেশি যুক্তিযুক্ত।
এদিকে বাঁকুড়ার রাইপুর থানার মন্ডলকুলি গ্রাম থেকে একটু ভিতরে 'দেমুসনা' গ্রাম। গ্রামে একটি পুকুর আছে। নাম 'মুন্না পুকুর'। সেখানে গ্রামঠাকুর 'ননদ- ভাজের' থান রয়েছে এক বটগাছের তলায়। 'ননদ- ভাজের' প্রতীক রূপে দুটি শিলা আছে। তবে সেই শিলা দুটিতে খোদাই করা কোন মূর্তি নেই। মিহির চৌধুরী শিলা দুটি সম্পর্কে বলেছেন, ননদ ভাঁজের প্রতীক শিলা দুটির একটি আছে খাড়া হয়ে তার মাপ ৬× ৮ ফুট, অপরটি আছে পাড়ে, তার মাপ ৫×৭ ফুট।(রাঢ়ের পূর্বপুরুষ পূজা, পৃষ্ঠা- ৮৪) লোকে দু ধরনের কথাই বলেন যে, শুয়ে থাকা শিলাটি ভাজ বা বধুর এবং দাঁড়িয়ে থাকা শিলাটি ননদের। আবার উল্টোটাও বলেন। আগে যে নিত্য পূজা হত এখন সেটা কেবল বাৎসরিক পয়লা মাঘ মাসে পূজিত হন।
কিন্তু কীভাবে 'ননদ-ভাজ' গ্রামঠাকুর হয়ে উঠলেন সে নিয়েও নানান লোককথা বা জনশ্রুতি প্রচলিত রয়েছে। সেখানে যেমন 'ভয়' থেকেও তাদের দেবতা রূপে মানা হয়েছে তেমনি আবার তাদের প্রতি শ্রদ্ধা থেকেও পূজা করা হচ্ছে বলে মনে করা হয়। জনশ্রুতি হল, এক নববধু স্বামী ও শাশুড়ির অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ওই পুকুরে ডুবে আত্মহত্যা করেন। ননদ তাকে বাঁচাতে গিয়েও ব্যর্থ হন। বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টায় যখন তাকে জল থেকে তুলে আনেন ততক্ষণে তার মৃত্যু ঘটেছে। সেই শোকে ননদও পাথর হয়ে যান। এরপরে বধূর বাড়ি সহ গোটা গ্রামে ভূতের উপদ্রব ও নানান মহামারী দেখা যায়। গ্রামবাসীদের ধারণা 'ননদ-ভাজের' অকাল অপমৃত্যুই এর কারণ হতে পারে। সেই থেকে গ্রামবাসীরা তাদের পুজো করেন।
আরো একটি মত হল, এক নতুন বউকে তার শাশুড়ি পিটিয়ে মেরে ফেলে। ননদী তাকে কোনভাবে বাঁচাতে পারেননি, তাই সে বধূটির জন্য দুঃখে জলে ডুবে আত্মহত্যা করেন। ননদ ও ভাজের এই অকৃত্রিম ভালবাসাকে গ্রামবাসীরা অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। সেই শ্রদ্ধা থেকেই পূজার প্রচলন শুরু হয়েছে।
তবে ভাশুর- বুয়াসিন এবং ননদ-জা দুটো কাহিনীতেই নির্যাতনের নির্মম যে ছবি ফুটে উঠেছে তাতে কী সুদূর অতীতে গ্রামবাসীরাও যুক্ত ছিলেন বা সেই ভয় থেকেই নিজেদের বাঁচাতে পূজা প্রচলন শুরু করেছিলেন? সেটা হওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়। যাই হোক নীহাররঞ্জন রায় তো বলেছেন, এইসব গ্রামদেবতা প্রাক আর্য আদিম গ্রামগোষ্ঠীর ভয় ও ভক্তির দেবতা।(বাঙ্গালীর ইতিহাস, পৃষ্ঠা- ৬১৩)
তথ্যসূত্র: ১) রাঢ়ের পূর্বপুরুষ পূজা/ মিহির চৌধুরী কামিল্যা
২) বাঙ্গালীর ইতিহাস/ নীহাররঞ্জন রায়
৩) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, অখন্ড সংস্করণ/ বিনয় ঘোষ
0 Comments