জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব- ৮৩
হড় মিতান সভ্যতা
সূর্যকান্ত মাহাতো
এক সময় জঙ্গলমহল জুড়ে একটি বেশ সুন্দর সভ্যতা ছিল। এক একটি গোষ্ঠী অন্যান্য গোষ্ঠীদের বিপদে-আপদে সবসময় বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়াত। এই যে সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে পাশে দাঁড়ানো, আজকের দিনে সেটা আর সেরকম ভাবে দেখাই যায় না। অথচ তখনকার দিনে এটাই ছিল রীতি রেওয়াজ। সেই সভ্যতার নাম হল "হড় মিতান"। এখানে 'হড়' শব্দের অর্থ হল 'মানুষ'। (ভারতের আদিবাসী ও দলিত সমাজ/ পশুপতি প্রসাদ মাহাতো, পৃষ্ঠা- ১৭২) আর 'মিতান' শব্দটি 'মিতা' বা মিত্রতা বা বন্ধু অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
এখানে দুটো প্রশ্ন উঠে আসে, কারা 'হড়' আর কারাই বা 'মিতান'? পশুপতি প্রসাদবাবু বলেছেন যে, 'সাঁওতাল, মুন্ডা, হো, বীরহড়, ভূমিজ, কোল প্রভৃতি গোষ্ঠী নিজেদের হড় বা হোর বলেন।'(ভারতের আদিবাসী ও দলিত সমাজ, পৃষ্ঠা- ১৭২) কুড়মিদেরও একটি বংশ প্রতীক হল 'হিন্দোয়ার'। পশুপতি প্রসাদ মাহাতো জানিয়েছেন, 'ভাষাতাত্ত্বিকরা বলেন যে শব্দটির ব্যুৎপত্তি গত তাৎপর্য হল হেন্দে= হিন্দো এবং হড় =য়ার অর্থাৎ হেন্দে অর্থে কালো এবং হড় শব্দের অর্থ মানুষ। অর্থাৎ কালো মানুষ।'(ঐ গ্রন্থের পৃষ্ঠা- ১৭২)
অন্যদিকে এই 'হড়'-রা যাদের 'মিতান' বলে মনে করেন, তারা হলেন জঙ্গলমহলেরই অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী--- কামার, কুমোর, মাল, মাঝি, করগা, ছুতার, ঘাসি, তাঁতী, পান, জোলহা, কিষান, পুরান, বাউরী, সহিস, হাড়ি, খড়িয়া, পাইক, ধোপা, বাগাল, ভূঁইয়া সহ আরো অন্যান্য জনজাতির মানুষজন।
ঠিক কোন সময় এই সুন্দর সভ্যতার জন্ম হয়েছিল? পশুপতিপ্রসাদ মাহাতোর মতে, বাংলা ভাষার আদিপর্ব তথা চর্যাপদের আগে এই সভ্যতার জন্ম ঘটেছিল।(ভারতের আদিবাসী ও দলিত সমাজ, পৃষ্ঠা- ১৬৬) তিনি এই সভ্যতার মূল বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেছেন, এই সভ্যতা হল---'পারস্পরিক ভাইচারা, পারস্পরিক সহনশীলতা, পারস্পরিক দায়বদ্ধতা এবং পারস্পরিক আপনাপন করার জাদুমন্ত্র।'(ঐ গ্রন্থের পৃষ্ঠা- ১৬৭) 'হড় মিতান' মানুষরা যেমন পরস্পরকে আপন করেছে, মর্যাদা দিয়েছে, তেমনি আবার 'বরতনী বা গাঁ-ঘর' বলে এক বাৎসরিক চুক্তির মধ্য দিয়ে তারা একে অপরকে মিত্রও করেছে।(ভারতের দলিত সমাজ, পৃষ্ঠা- ১৬৭)
কেমন ছিল সেই ভাইচারা বা আপনাপন করার জাদুমন্ত্র? সেটা যে একেবারেই 'লোক দেখানো' মিত্রতা ছিল না সে কথা পশুপতিবাবুও বলেছেন। কারণ যখনই বিপদ এসেছে তখনই তারা পরস্পর এক হয়ে উঠেছে এবং লড়াই করেছে। যেমন, ঔপনিবেশিক শক্তি যতবারই আক্রমণ করেছে তারা জোটবদ্ধভাবেই সেই শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। তা সে 'চুয়াড়' বিদ্রোহই হোক আর কোল, ভূমিজ, সাঁওতাল কিংবা খারওয়ার বিদ্রোহই হোক। এই সব বিদ্রোহে সকলে যেভাবে পারস্পরিকভাবে হাতে হাত রেখে লড়াই করেছেন। এটাই তো 'হড় মিতান' সভ্যতার মূল বৈশিষ্ট্য।
আরো একটি আন্দোলনের কথা বলা যায়, যা সম্পর্কে আজ পর্যন্ত ইতিহাস ও ঐতিহাসিকেরা অদ্ভুত রকমের মৌনতা অবলম্বন করেছেন। ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকেই ঐ আন্দোলনের গুরুত্ব তাই একরকম হারিয়ে গেছে। ঐ আন্দোলনের নাম হল 'মেলি আন্দোলন'। ১৯১৭ থেকে ১৯১৯ পর্যন্ত এই আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। লেখক ও গবেষক পশুপতি প্রসাদ মাহাতো এই আন্দোলন সম্পর্কে তাই ঠিক কথাই বলেছেন, 'সাংস্কৃতিক নির্বাকায়ন(Cultural Silence) এবং স্মৃতিহরণ(Memocide) এর একটি অসাধারণ নমুনা হল মেলি আন্দোলন, যার সম্বন্ধে ভারতের প্রগতিবাদী ঐতিহাসিকরা সম্পূর্ণ নীরব।' (ভারতের আদিবাসী ও দলিত সমাজ, পৃষ্ঠা- ১৭৩) বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ডক্টর কুমার সুরেশ সিংহ তাই কি বলেছেন, এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই ভারতের সবথেকে বড় বিচার হয়েছিল!
কী এই 'মেলি' আন্দোলন? মেলি আন্দোলনের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ১৯৯২ সালের ১৬ ও ১৭ই মে কোলকাতার কলেজ স্কোয়ারের 'স্টুডেন্টস হলে' ঐ বিষয়ে একটি সভা ডাকা হয়েছিল। ঐ সভার বক্তব্য বিষয় ছিল, 'ঝাড়খন্ড অঞ্চলের অধিবাসীরা সেদিন কেমন ছিলেন--- আজ কেমন আছেন।' ঐ সভাতেই বলা হয়েছিল, মূলত জমি জীবিকা ও সম্মানের দাবি নিয়েই ১৯১৭ সালে এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল। কৃষকদেরকে জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। খাজনার বোঝা বাড়ানো হয়েছিল। সেই সঙ্গে 'জঙ্গল ও জল' ব্যবহারেও জমিদারেরা নানা রকম বিধি নিষেধ আরোপ করেছিলেন। ফলে কৃষক ও সাধারণ মানুষদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। তাই এর বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল যে আন্দোলন সেটাই ছিল 'মেলি' বা 'মেড়ি' আন্দোলন।(ভারতের আদিবাসী ও দলিত সমাজ/ পশুপতি প্রসাদ মাহাতো, পৃষ্ঠা- ১৭৩) শুধু তাই নয়, ঐ সময় জোর পূর্বক সৈন্য বাহিনীতে ঢোকানোর বিরুদ্ধেও ছিল এই আন্দোলন।
🍂'মেলি' আন্দোলনে শহীদ হয়েছিলেন এমন কয়েকজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হলেন, কঁকা মাঝি, কালিয়া মাহাতো ও রামেশ্বর সিংহ প্রমূখ। এছাড়াও ৩৭ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ৯৭৭ জনকে আট বছরে জন্য জেলে পাঠানো হয়েছিল।(ভারতের আদিবাসী ও দলিত সমাজ, পৃষ্ঠা-১৭৪) এই আন্দোলন ঝাড়গ্রাম, শিলদা, কেশিয়াড়ি থেকে শুরু করে রায়পুর, খাতড়া হয়ে বান্দোয়ান সহ মানভূমের একাধিক জায়গা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কিন্তু সেই বিস্তৃত বিবরণ কেউ লিপিবদ্ধ করে যায়নি। কিন্তু হঠাৎ এই নীরবতা কেন সে প্রশ্ন আজও কেউ তোলেনি। একটা ইতিহাসের লড়াই সেই ঠান্ডা ঘরেই পড়ে রইল।
এই 'হড় মিতান' মানুষেরা 'সর্বপ্রাণবাদে'(Animism) বিশ্বাস করে। এবং এদের মূল ধর্ম সাধনা হল, 'প্রকৃতিগত ভারসাম্যের সত্যতা'। এমন একটা মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ সভ্যতাতেও বিভেদের চোরা স্রোত ঢুকে পড়েছিল। সেই চোরাস্রোতকে 'দিকু' বা 'এলিয়েন' বলে উল্লেখ করা হয়। কারা ওই 'দিকু'? পশুপতিবাবুর মতে, মূলত 'হড় মিতান' সংস্কৃতিতে যারা অনুপ্রবেশকারী তারাই ছিলেন 'দিকু'।(ভারতের দলিত সমাজ, পৃষ্ঠা- ১৭৪) আবার ধীরেন বাস্কেও 'দিকু' শব্দটিকে বেশ অর্থবহ বলেই উল্লেখ করেছেন। তিনি একটু অন্যভাবে বলেছেন, প্রাক বৈদিক খেরওয়াল সভ্যতার মানুষরা একদল আগ্রাসী মানুষদেরকে বলেছিলেন অনুপ্রবেশকারী বা Intruder। আবার সিনহা, সেন, পাঁচভাই বলেছেন, বহিরাগত অ-আদিবাসী মানুষদের চিহ্নিত করতেই 'দিকু' শব্দটি তারা ব্যবহার করেছেন।(ভারতের আদিবাসী ও দলিত সমাজ, পৃষ্ঠা - ১৭৭)
কিন্তু সকল অনুপ্রবেশকারীই কিন্তু 'দিকু' নয়। তাহলে ঠিক কারা 'দিকু'? এর উত্তর হিসাবে বলা হয়েছে, যারা 'শোষক' একমাত্র তাদেরকেই 'দিকু' বলা হয়েছে। শ্রীমতী জ্যোতি সেন আবার বলেছেন, "গঙ্গার অপর পার থেকে আসা উত্তর বিহারীদেরই মূলত 'দিকু' বলা হয়ে থাকে।" কিন্তু অরুণ চৌধুরী আবার ভিন্ন মত প্রকাশ করে বলেছেন বাঙালি ও বিহারীদের দিকু বলা এক চক্রান্ত। তিনি দিগম্বর চক্রবর্তীর 'হিস্ট্রি অফ দি সান্তাল হুল অফ ১৯৫৫' গ্রন্থের সম্পাদনায় বলেছেন, "It is altogether a motivated as well as fiendish distortion of facts to delineate the upsurge as a commotion against the Bengalees and the Binaries."
তবে প্রাকবৈদিক এই সভ্যতা একেবারেই যে বিলুপ্ত তা নয়। বিভেদের যাঁতাকলে কেবল পিষ্ট হয়ে আছে এই যা।
তথ্যসূত্র: ভারতের আদিবাসী ও দলিত সমাজ/ পশুপতি প্রসাদ মাহাতো
0 Comments