ভোলগা নদীর খোঁজে – ১৩
বিজন সাহা
উগলিচ
উগলিচ – রাশিয়ার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী এক প্রাচীন শহর। এখানে প্রথম আসি ১৯৮০ দশকে ছাত্রজীবনে। এরপর আসি ২০১৮ সালের ১১ আগস্ট একদিনের ভ্রমণে। ইয়ারোস্লাভল রেজিওনে অবস্থিত উগলিচ মস্কো থেকে ২০০ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে আর ইয়ারোস্লাভল থেকে ৯৭ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। উগলিচের নামকরণ নিয়ে বেশ কয়েকটি ভার্সন প্রচলিত আছে। খুব সম্ভবত এখানে ভোলগা ইয়ারোস্লাভের পথে কোণ সৃষ্টি করে তাই শহরের নাম উগলিচ। কারণ রুশ ভাষায় কোণকে বলা হয় উগল। অন্য এক ভার্সন অনুযায়ী উগলিচ নাম হয়েছে রুশ উগল বা কয়লা থেকে – কারণ এখানে প্রাচীন কালে কয়লা পুড়ানো হত। উল্লেখ করা যেতে পারে যে বাংলায় “উগল” লিখলেও রুশ ভাষায় কোণ ও কয়লার উগলের মধ্যে বানান ও উচ্চারণগত পার্থক্য আছে। আবার অনেকের ধারণা উগলিচ নাম এসেছে উগলিচি শব্দ থেকে। উগলিচি ছিল এক প্রাচীন স্লাভিয়ান উপজাতির নাম। তবে তারা বাস করত দনেস্টার ও দুনাই (দানিউব) নদীর তীরে যা ইউক্রেনের ওদেসা অঞ্চলে অবস্থিত।
প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য থেকে জানা যায় উগলিচের ক্রেমলিনের ওখানে খ্রিস্টীয় যুগের শুরু থেকেই জনপদ ছিল যা পঞ্চম – ষষ্ঠ শতকে সাময়িক ভাবে বিলোপ পায়। স্থানীয় দিনলিপি অনুযায়ী শহরের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সম্রাজ্ঞী ওলগার আত্মীয় ইয়ান প্লেস্কোভিতিচ বা প্সকোভিচ। সম্রাজ্ঞী ওলগার কথা আমরা আগে জেনেছি। তিনি ছিলেন রাজা আলেগের মা। তাঁর প্রচেষ্টাতেই রুশ দেশ অর্থোডক্স খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়। পরবর্তী বিভিন্ন উৎস থেকে উগলিচ প্রতিষ্ঠিত হবার বেশ কিছু তারিখ জানা যায় – যেমন ৯৩৭, ৯৪৭, ৯৫২ ইত্যাদি। তবে সাধারণত ৯৩৭ সালকেই উগলিচের প্রতিষ্ঠা বছর হিসেবে ধরা হয়। উনিশ শ শতক পর্যন্ত শহরে ইয়ানভা পোলে নামক এক জায়গা ছিল। এখান থেকেই ধারণা করা হয় যে শহরের প্রতিষ্ঠাতা ইয়ান প্সকোভিচ। খননকার্য থেকে আরও জানা যায় যে এখানে দশম শতকে স্ক্যান্ডিনাভিয়ার লোকজন বসবাস করত।
দিনপঞ্জিতে উগলিচের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১১৪৮ সালে। এখানে লেখক ১১৪৮ সালে কিয়েভের রাজা ইজিয়াস্লাভ মস্তিস্লাভিচের স্মলেনস্ক ও নভগোরাদের রাজাদের সাথে সুজদাল রাজ ইউরি দোলগোরুকির বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবার কথা লিখেছেন। ভ্লাদিমির কুচকিনের মতে এটা ঘটেছিল ১১৪৯ সালে আর এই যুদ্ধে মিত্র শক্তি সুজদাল রাজ্যের ভোলগা তীরবর্তী ছয়টি জনপদ দখল করে। এই ছয়টি শহরের তিনটি মালগু, উগলিচে পোলে, ক্সনিয়াতিন। অন্য তিনটি শহরের নাম উল্লেখ করা নেই – তবে মনে করা হয় এই তিনটি শহর হচ্ছে দুবনা, শশা ও তভের। উল্লেখ করা যেতে পারে যে এটাই দুবনার প্রথম উল্লেখ। এই দুবনা শহরেই আমি থাকি বিগত প্রায় ৩০ বছর ধরে। আর এই শহরের প্রতিষ্ঠা ধরা হয় ১৯৫৬ সাল যদিও সুদূর অতীত থেকেই এখানে জনবসতি ছিল। এ নিয়ে পরে কোন এক সময় আমরা বলব।
১২১৮ সালে উগলিচ ছিল ছোট্ট একটা রাজ্যের প্রধান শহর। ১৯৫২ সালে উদ্ধারকৃত গাছের বাকলে ইয়ারোস্লাভলের সাথে উগলিচের নাম পাওয়া যায় যেখানে ত্রয়োদশ শতকের আশির দশকের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছিল। ১২৩৮ সালে তাতার-মঙ্গোলদের আক্রমণের সময় উগলিচ পুড়িয়ে দেয়া হয়, তবে জার রোমানের সময় ১২৬১ থেকে ১২৮৫ সাল পর্যন্ত এখানে পুরাদমে নির্মাণকার্য চলে। যুবরাজ ইভান দানিলোভিচ কালিতা ১৩২৮ সালে উগলিচ মস্কোর অধীনে নিয়ে আসেন। মস্কো ও তভেরের প্রচণ্ড শত্রুতার সময় তভের রাজ মিখাইল দুইবার উগলিচ অবরোধ করেন। ১৩৭১ সালে তভের রাজ্যের সেনারা উগলিচ লুট করে পুড়িয়ে দেয়। সে বছরই রুশ চার্চের মেট্রোপলিট আলক্সেই সেখানে উসপেনস্কি মনাস্তির স্থাপন করেন যা পরে আলেক্সেয়েভস্কি মনাস্তির নামে পরিচিত হয়। মস্কোর রাজা দ্মিত্রি দানস্কই ১৩৭৫ সালে উগলিচের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি ঘটান। ১৩৮০ সালে উগলিচের সেনারা বিখ্যাত কুলিকভ পোলে লড়াই করে। এই যুদ্ধ ছিল ভ্লাদিমির ও মস্কো – এই দুই রাজ্যের রাজাদের নেতৃত্বে সম্মিলিত রুশ বাহিনীর মামাইয়ের গোল্ডেন হোর্ডের বিরুদ্ধে বিখ্যাত লড়াই। ১৩৮০ সালে দন নদের পাশে কুলিকভ পোলের এই যুদ্ধ থেকেই শক্তিশালী মস্কো রাজ্যের উত্থান।
পঞ্চদশ শতকের গোঁড়ার দিকে উগলিচ রাজ্য মস্কোর কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। সে যুগে অধিকাংশ রাজা বা জারদের অনেক সন্তান থাকত। যেহেতু জ্যেষ্ঠ পুত্রসন্তান সিংহাসনের অধিকারী হত তাই আশেপাশের এসব ছোটখাটো রাজ্য কেনা হত কনিষ্ঠ সন্তানদের রাজ্যত্ব করার জন্য। মস্কো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঠিক এভাবেই। ভ্লাদিমির মনামাখের পুত্র ইউরি ছিলেন তাঁর অষ্টম পুত্র। আর সে কারণে তাঁর ভাগে পড়ে রোস্তভ ভেলিকি ও সুজদালের ভার। নিজের সন্তানদের কথা ভেবে তিনি বিভিন্ন জায়গায় দুর্গ তৈরি করেন যাদের একটা ছিল মস্কো। সে সময় মস্কোয় ছোট বড় চল্লিশটি নদী ছিল আর ছিল সাত পাহাড়। তাই মস্কোকে সাত পাহাড়ের শহরও বলা হয়। মস্কো ছিল তাঁর রাজ্যের দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্ত শহর যেখানে তিনি দুর্গ তৈরি করেন। পরবর্তীতে ভৌগলিক অবস্থানের কারণেই মস্কো হয়ে ওঠে রুশ সাম্রাজ্যের রাজধানী। যাহোক, উগলিচে তখন শাসন করত মস্কো রাজের কনিষ্ঠ সন্তানরা। ১৪৬৩ – ১৪৯২ সালে উগলিচের শাসক ছিলেন আন্দ্রেই বলশই। তাঁর আমলে শহর বৃদ্ধি পায়, গড়ে ওঠে পাথরের প্রাসাদ, গির্জা, পাক্রভস্কি মনাস্তির, রাজপ্রাসাদ। সোভিয়েত আমলে উগলিচ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির সময় পাক্রভস্কি মনাস্তির ধ্বংস করা হয়। ১৪৯২ সালে আন্দ্রেই বলশই দুই ছেলে সহ তাঁর ভাই জার তৃতীয় ইভানের হাতে বন্দী হন। আফানাসি নিকিতিন ১৪৬৮ সালে উগলিচ আসেন। তাঁর ভ্রমণ কাহিনী “পাল তুলে তিন সাগরের পরে” বইয়ে এর উল্লেখ আছে।
🍂
১৬৭৪ সালের দিনলিপি থেকে জানা যায় যে সে সময় উগলিচ তিনটি অংশে বিভক্ত ছিল। একেবারে কেন্দ্রে ছিল দুর্গ বা রাজন্যদের শহর। এরপরে ছিল সাধারণ মানুষের শহর যেখানে বিভিন্ন পেশার লোকজন বাস করত। এরাই ছিল শহরের শিল্প, বানিজ্যের চালিকা শক্তি। আর একেবারে বাইরের স্তরে ছিল তীরন্দাজদের শহর। স্বাভাবিক ভাবেই এরা ব্যস্ত ছিল শত্রুদের আক্রমণ থেকে শহর রক্ষা করার কাজে। ১৬৭৪ – ১৬৭৭ সালে এখানে ভস্ক্রেসেনস্কি মনাস্তির, ১৬৮১ সালে ছিন্ন মস্তক ইয়োয়ান প্রেদতেচি গির্জা আর ১৬৯০ সালে রঝদেস্তভো ইয়োয়ানা প্রেদচাতি গির্জা তৈরি হয়। এই গির্জার কারণে ২৫০ বছর পরে ১৯৪০ সালে উগলিচ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র অনেকটা দূরে স্থাপন করা হয়। একটা ধারণা বিদ্যমান আছে যে সোভিয়েত সরকার ঢালাও ভাবে সব ধর্মীয় স্থাপনা ধ্বংস করত। উগলিচ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিকল্পিত স্থান থেকে দূরে সরিয়ে নেবার ঘটনা প্রমাণ করে যে সবকিছু এত সরল ছিল না। এছাড়া ১৬৯২ সালে কাঠের রক্তের উপর দ্মিত্রি গির্জা পাথর দিয়ে নতুন করে তৈরি করা হয়। এসব গির্জা সম্পর্কে বিস্তারিত পরের পর্বে।
উগলিচের উপর ছবি পাওয়া যাবে এখানে
0 Comments