জ্বলদর্চি

কালের অতল তলে কলোরাডো ১৬ পর্ব চিত্রা ভট্টাচার্য্য

Paharer pothe

কালের অতল তলে কলোরাডো 
১৬ পর্ব
চিত্রা ভট্টাচার্য্য

গোধূলির গেরুয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে ব্রতীন গাইছিল   '' মধুর তোমার শেষ যে না পাই প্রহর হলো শেষ ---অতনু ও তার সাথে গলা মিলিয়েছে --''এই গোধূলির ধূসরিমায় শ্যামল ছড়ায় সীমায় সীমায়,,, ওরা ডুয়েট গাইছে। বিদেশে এতো কাজ এতো ব্যস্ততা এতো হুল্লোড়, তেমনি লাগাম ছাড়া প্রলোভনের মাঝে  নিজেদের সংস্কৃতি ও গানের চর্চা ওরা নিয়মিত করে বলে বেশ আনন্দ লাগে। ব্রতীনের হাতে স্টীয়ারিং পেছনের সীটে আমরা বিভোর হয়ে কান পেতে আছি। পারভীনের ঠান্ডা শক্ত হাত আমার হাতের মুঠোর উষ্ণতায় শিথিল হয়ে আছে। প্রকৃতির পথ পরিক্রমা শেষে প্রায় দুই সপ্তাহ বাদে ,মনে এখন ঘরে ফেরার তাড়া।  গুরু গম্ভীর আওয়াজে তাকিয়ে  দেখি  ঈশান কোণ থেকে স্লেট রঙ্গের উড়ো মেঘ মুঠো মুঠো  বিষন্নতা নিয়ে ভেসেএসে ঢেকে দিচ্ছে গৈরিক ধূসরিমাকে। তারই মাঝে শ্বেত বলাকার দল পাখা মেলে উড়ছে গভীর শঙ্কায়। তাদের শ্রান্ত ডানায় এক ফালি সোনালী রোদের পরশে আলোর ঝিক মিক।   কালো মেঘের দল মত্ত হস্তিনীর পালের মত শুঁড় দুলিয়ে--উন্মত্ত আবেগে রৈ রৈ রব তুলে দিগবিদ্বিগ কাঁপিয়ে  নিরুদ্দেশে পাড়ি দিচ্ছে। 

 ইয়াম  ভীরু সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে এই রে ! মাটি হয়ে যাবে সব প্রোগ্রাম। অসময়ে ঈশান কোণের মেঘে-- চমকে উঠে ভাবছি আর দেরী নেই ,এই বুঝি উদ্দাম ঝড় উঠবে পাহাড় থেকে নামার আগেই মুষলধারা বৃষ্টির কবলে পরবো। রক্তাভ পাহাড়ের গোলাপী মায়া কাটিয়ে দুই পাহাড়ের সবুজের ঢালের মধ্য দিয়ে নগর মাঠ প্রান্তর উপত্যকার পথ পেরিয়ে তড়িঘড়ি  এসে পৌঁছলাম কলোরাডোর ব্ল্যাক ক্যানিয়নে। ততক্ষণে মেঘেরাও দিক পরিবর্তন করেছে ; হয়তো কোন অচিন পুরে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে। বিকেল সাড়ে পাঁচটা। এখোনো সন্ধ্যের অন্ধকার নামতে প্রায় সাড়ে চার ঘন্টা দেরী ,অনেকটা সময়। এসে দাঁড়ালাম হুভার ড্যামের প্রাঙ্গনে নেভাদা এবং আরিজোনা রাজ্যের সীমান্তে। সাইনবোর্ডে নজর দিয়ে দেখি এ অঞ্চল টি নেভাদার বেল্ডার শহর, যেখানে এই অত্যাশ্চর্য্য হুভার ড্যাম টি নির্মিত হয়েছে ।
Hoovar Dam

 পার্কিং জোনে যথারীতি গাড়ি পার্ক করে বেশ খুশিতে শান বাঁধানো কংক্রিটের রাস্তা ধরে একসঙ্গে হেঁটে এগিয়ে এসেছি বিশাল ড্যামের সামনের প্রশস্ত আঙিনায়। অঝোর ধারায় প্রবাহিত হয়ে আসছে প্রবল বারিধির তর্জন গর্জন। সাদা ধোঁয়ার মত জলোচ্ছাসের সাথে যান্ত্রিক শব্দের আর জলের গতির বেগের শো শো আওয়াজ চতুর্দিক কাঁপিয়ে নিরবধি বইছে। যেন দূর থেকে বাতাস বয়ে আনছে প্রলয়ঙ্কর ঘূর্ণি ঝড়ের বার্তা। ড্যামের পাশ দিয়ে হাঁটছি যখন ভিজে হাওয়ার মিঠে সুবাস গায়ে মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। গোধূলির মেঘমালার প্রতিচ্ছবি পড়েছে উন্মত্ত বাঁধের জলে। অতনু ব্রতীন কৌতূহলী চোখ মেলে উদ্ভ্রান্তের মত এক চক্কর লাগিয়ে এলো।পারভীন নির্বাক, ড্যামের জলের উন্মত্ত অঝোর ধারার দিকে উদাসীনীর চোখে চেয়ে আছে। বেশ বুঝতে পারছি ওর মনের মাঝে বয়ে চলেছে যে অজস্র চিন্তার ঝড়, যতক্ষণ না লেক -টা হো ছাড়িয়ে ওদের ভিলেজে মার কাছে পৌঁছচ্ছে ততক্ষণ ওর মনের এ ঝড় কিছুতেই থামবে না।  

     সামনে বেশ দর্শনার্থীর ভীড় ,বেশীর ভাগ দূরের যাত্রীর বেড়ানো শেষে ঘরে ফেরার পালা। বিরাট লম্বা ড্যামের গার্ডওয়াল রেলিংয়ে ভর দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। অপর প্রান্তে সারিসারি পর্বত মালার শ্রেণী যেন যক্ষপুরীর রক্ষকের ভূমিকায় সদা সতর্ক চক্ষু মেলে প্রহরারত। এতোদিন ঘুরে বেড়িয়েছি প্রকৃতির অবারিত আনন্দ যজ্ঞে। কখনো সে তাপ প্রবাহে প্রখর জ্বালাময়ী।কখনো বা  ধূলি ঝড়ে ধূসরিত ,কখনো সে বৃষ্টি স্নাতা লাজুক সুন্দরী  অথবা শ্বেত শুভ্র   তুষারের পুরু আস্তরনে ঢাকা সুউচ্চ পাহাড় শ্রেণীর ধ্যান গম্ভীর রূপ। দেখেছি ধুধু ঊষর পাথুরে রুক্ষ মরুভুমি , নদ নদী উপত্যকা গিরিখাত। কোথাও বা অবগুন্ঠনে ঢাকা নিবিড় বনরাজি।কোথাও শ্যামল সবুজ আবার কোথাও মাইলের পর মাইল শুষ্ক মাঠ প্রান্তর।  কিন্তু আজ সামনে এসে দাঁড়ালাম মানুষের ধী শক্তিতে স্বহস্তে নির্মিত আর এক সুন্দর অনন্য কীর্তির সামনে। এই প্রকৃতিকে ব্যবহার করে আধুনিক বিজ্ঞান চেতনার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত এই বাঁধ প্রকল্প টিতে মিলেমিশে এক অপরূপ ব্যবহারিক শিল্প চেতনার প্রকাশ ঘটেছে যা বারবার দেখে ও এর গভীর রহস্যের জট উদ্ঘাটন হয় না।
Hoovar Dam

       ব্রতীন ও অতনু দুটো মাথা একত্রিত হয়ে বেশ কিছুটা সময় ধরে গুরুত্ব পূর্ণ পর্যবেক্ষণে মগ্ন। আমি মুগ্ধ হয়ে ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলিয়ে যাচ্ছি। এর আয়তন বা জল ধারণের ক্ষমতা আমেরিকার বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ 115মাইল প্রসারিত লেক মিডের থেকে ও বিশালতর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেট ডিপ্রেশনের সময় 1931সাল থেকে 1936 সালের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল এই হুভার ড্যাম ও  বিখ্যাত জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। আমেরিকার সর্বোচ্চ কংক্রিট আর্ক্--গ্রাভিটি বাঁধ। এই বিখ্যাত বাঁধটির প্রথমে বোল্ডার ড্যাম নাম দেওয়া হয়েছিল। 1947 সালে অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩১ তম রাষ্ট্রপতি হার্বার্ট হুভারের নামে এই ড্যাম টি নাম পরিবর্তিত হয়। গঠনগত দিক দিয়ে ও এটি বিশ্বের সর্বাধিক অভিনব বাঁধ। বাঁধ নির্মাণের আগে কলোরাডো নদীকে ব্ল্যাক ক্যানিয়ন থেকে সরিয়ে নিতে হয়েছিল। নেভাদা ও আরিজোনা কে 1931 সালে উভয় দিকেই ক্যানিয়নের দেওয়ালে চারটি টানেল খনন করে টানেল গুলো কংক্রিট দিয়ে সারিবদ্ধ করা হয়েছিল এবং 1932 সালের নভেম্বরে নেভাদার টানেল গুলোর সাথে নদীটিকে আরিজোনা টানেলের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।   
Hoover Dam

  আজ থেকে প্রায় ৯২ বছরের ও  আগে 30th September,1935 তারিখে রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট জাতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে ছিলেন আমেরিকার গর্ব সর্বাধিক অভিনব প্রযুক্তিতে নির্মিত 1,244 ফুট  লম্বা ও 726 ফুট উঁচু এই ঐতিহাসিক হুভার ড্যাম টি।যখন বোল্ডার ক্যানিয়ন প্রকল্প টি অনুমোদিত হয়েছিল ,তখন বৈজ্ঞানিক রা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে এই বাঁধটি একটি একক খিলান -মাধ্যাকর্ষণ বাঁধ হবে যার প্রস্থ নীচের দিকে 660ফুট অর্থাৎ (200 মিটার ) কংক্রিটের এবং শীর্ষে 45 ফুট (14মিটার ) হবে।  নেভাদা ও আরিজোনাকে  শীর্ষে সংযুক্ত করার জন্য একটি হাইওয়ে ও থাকবে।  বাঁধটির ঐতিহাসিক কর্ম যজ্ঞের নির্মাণ কার্য্যের জন্য হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন দেশ থেকে শ্রমিক হয়ে দক্ষিণ নেভাদায় এসেছিলেন। শোনা যায় বাঁধটির নির্মাণের সময় দুর্ঘটনা গ্রস্থ হয়ে তাদের মধ্যে প্রায় একশ জনের ও বেশী শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছিল।  
🍂

      হুভার ড্যাম নিমিত হলে কলোরাডো ও তার শাখা নদী গুলোতে বন্যা ও পলি নিয়ন্ত্রণ ,জলবিদ্যুৎ ,কৃষি সেচ ও গৃহকার্য্যে নিত্য ব্যবহার্য্য জল সরবরাহের জন্য বেশ কয়েকটি শহর জল সঙ্কট থেকে মুক্ত হয়ে      ছিল। নব জল ধারায় সিক্ত হয়ে শহর বাসীর জীবন নব রূপে প্রাণোচ্ছল সুখের সাগরে ভেসেছিল।  কিন্তু পারভীন বলে ,ড্যাম নির্মাণের ফলে পরিবেশের ও যথেষ্ট ক্ষতি হওয়ায় নদীর তলদেশে স্থানীয় মাছের সংখ্যা ধ্বংস হয়ে যায়। সেদিন হ্যারিগ্র্যান্ডপা বিভিন্ন প্রকার মাছের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছিল ড্যামের নির্মাণের ফলে কলোরাডো নদীর মূল প্রজাতির মাছের চারটি প্রকার বনিটেল চাব ,কলোরাডো পাইকমিনো,হ্যাম্পব্যাক চাব এবং রেজারব্যাক চুষুক মাছের বংশ  ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া কৃষি জমি ও ক্ষতি গ্রস্থ হয়েছে এবং বহু প্রাণীকুলের অবাধ  বিচরণ ও এই বাঁধ টি তৈরীর ফলে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।    

  অতনু আমাদের  বোঝায়, এই বাঁধটি র নির্মাণ প্রকৌশলে কত ভাবনা চিন্তা ,কত বিজ্ঞান ভিত্তিক পরিকল্পনা করা হয়েছে। গঠনগত দিক দিয়ে ও এটি বিশ্বের সর্বাধিক অভিনব বাঁধ।বছরে প্রায় ৭মিলিয়ন পর্যটক এই ড্যাম টি তে বেড়াতে আসে। এর  নির্মাণে এখানে 4,400,000 কিউবিক ইয়ার্ড কংক্রিট রয়েছে। বাঁধের ওপরে অবস্থিত চারটি রিইনফোর্সড কংক্রিট টাওয়ার থাকায় জলাধার থেকে জল কে বিশাল স্টীলের পাইপ গুলো সরিয়ে দেয় পেনস্টক পাইপের মধ্য দিয়ে প্রায় 5০০ ফুট নীচে জল গড়িয়ে পড়লে বাঁধের গোড়ায় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে 17 টি ফ্রান্সিস টাইপ উল্লম্ব হাইড্রোলিক টারবাইন রয়েছে যা বৈদ্যুতিক জেনারেটার গুলির একটি সিরিজ ঘোরায়। যার মোট শক্তি ক্ষমতা 2,080 মেগাওয়াট।  বাঁধ নির্মাণের আগেই কলোরাডো নদীকে ব্ল্যাক ক্যানিয়ন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল ।  

       আমার মাথার ওপর দিয়ে সব বৈজ্ঞানিক তথ্য উড়ে চলে গেলেও ওদের মূল্যবান বক্তব্য নোট করে নিতে মোটেই ভুলিনি। ব্রতীন বলে উৎপন্ন বৈদ্যুতিক শক্তির প্রায় অর্দ্ধেক দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার মেট্রোপলি টন ওয়াটার ডিস্ট্রিক্ট ,লসএঞ্জেলস এবং দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার অন্যান্য শহরে যায় এবং বাকি নেভাদা ও আরিজোনায় পৌঁছয়। এছাড়া ও, হুভার ড্যাম নেভাদা, অ্যারিজোনা এবং ক্যালিফোর্নিয়ার জন্য কম খরচে জলবিদ্যুৎ সরবরাহ করে। বাঁধটি প্রতি বছর চার বিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘন্টার ও বেশী  বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে এবং এটি হুভার ড্যামে বিক্রি হওয়া শক্তি থেকে উৎপন্ন মার্কিন রাজস্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গুলির মধ্যে একটি যা এর সমস্ত পরিচালন এবং রক্ষণাবেক্ষণের খরচ ও পরিশোধ করে। লেক মিড থেকে নদীর জলের সঞ্চয় এবং ডেলিভারি ও বাঁধের ব্যবহারের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।  লাসভেগাস, লসঅ্যাঞ্জেলেস এবং ফিনিক্সের মতো এলাকায় পৌরসভার জল সঞ্চার করে ও  মেক্সিকো তে সেচের জন্য নির্ভরযোগ্য যথেষ্ট জল সরবরাহ করে থাকে।  
                                                                                     ইয়াম ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে গলায় ঢেলে ,পারভীনের হাতে বোতল টা এগিয়ে দিতেই অতনু চেঁচিয়ে উঠে প্রায় কেড়ে নিয়ে বোতল টির       অবশিষ্ট্যাংশ জল নীচের দিকে ঢেলে দেয়। আমরা হ্তবাক হয়ে ভাবছি এ আবার কেমন পাগলামো ? রেগে গিয়ে বলি জল না খেয়ে ফেলে দিলে কেন ? অতনু বলে তাকিয়ে দেখ কেমন মজা ! অবাক হয়ে দেখি সে জল নীচে তো পড়লই না বরং ওপরের দিকে ভাসতে শুরু করলো। বন্ধুরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে হাততালি দিয়ে ওঠে। পারভীন অবাক ,পরীক্ষা করার জন্য তখনি হাতের ছোট্ট ন্যাপকিন টা ফেলে দিলো।  দেখছি সে ও নীচের দিকে না পরে হাওয়ায় ভাসতে শুরু করেছে যদিও তেমন বিশেষ হাওয়া নেই । ব্রতীন হেসে বলে, এখানে এসেই শুনেছিলাম অনেকেই এই ব্যাপারটিকে ভুতুড়ে কান্ড বলে। কিন্তু আসলে তা নয় পৃথিবীতে এমন কয়েকটি স্থান আছে যেখানে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অনুপস্থিতি। এই ধনুকাকৃতি হুভার ড্যামের জায়গাটিতে ও যে সেই মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অনুপস্থিত-- অতনু জল ফেলে সেই তথ্যের প্রমান দিল।

 আমরা যখন নিজেদের মধ্যে এমন অবাক কর কান্ড নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত তখন দেখতে পেলাম অন্যান্য দর্শনার্থীরা ও উৎসাহী হয়ে উঠেছে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির অনুপস্থিতি পরীক্ষার খেলায়। হাতের কাছে যা কিছু অছে তাই ছুঁড়ে দিচ্ছে টস করার ভঙ্গীতে। পারভীন বলে তা ছাড়া আরেকটি মজার ঘটনা লক্ষ্য করার মত। দুইপারের দুই টাইম জোন আরিজোনার আর নেভাদার সময়ের মধ্যে প্রায় এক ঘন্টার ডিফারেন্স রয়েছে। ড্যাম টা ক্রস করলেই আমাদের সবার রিষ্টওয়াচ গুলোর টাইম রিসেট করতে হবে। অতনুর মনে পড়ে, কাল পারভীন কে একা ছেড়ে দিতে হবে।  এখান থেকে প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টার মত সময় লাগবে পাহাড়ি রাস্তা ড্রাইভ করে পারভীনের কাউন্টিতে পৌঁছতে। আমাদের সবার মন খুব খারাপ। ওর  মার অসুখ টা যেন খুব খারাপ বার্তা বয়ে আনছে । ওরা  নিজেদের মধ্যে গভীর আলোচনায় ব্যস্ত। বন্ধুর বিপদে এ ভাবে একাকী ওকে ছেড়ে দিতে মন চায় না তবু যেতে দিতে হবে। ওদের অফিসিয়াল  ছুটি যে সব ফুরিয়ে গিয়েছে।  

আমাদের চলার শেষ নেই  প্রায় ঘন্টা দেড়েক এখানে সময় কাটিয়ে এখন চলেছি ৩০মাইল দূরের রাতের   অপ্সরী সুন্দরী লাসভেগাসের দিকে। ইতিমধ্যে সকলের মন কফি ব্রেকের জন্য উতলা। সামনেই এক রেস্টরুম চোখে পড়াতে ব্রতীন কে নির্দেশ দিয়েছি গাড়ি থামা তে। অতনু বলে গাড়িতে  আর দশ মিনিট মত এগোলেই অনতিদূরে পাবো এক গ্যাস স্টেশন। সেখানে  নতুন একটি  কফিক্যাফে খুলেছে ,কফি বেশ সস্তা। এবং মিনিট সাতেকের মাথায় সেখানে পৌঁছে গেলাম। দীর্ঘ্য জার্নির পর একে একে ফ্রেশ হয়ে কফির মগ হাতে নিয়ে এক শেডের তলে বেঞ্চে আয়েশ করে বসে আছি। একটি যথেষ্ট লম্বা বাস গ্যাস ষ্টেশনে  থামলো। এটি একটি  রিক্রিয়েশন ভ্যান। এই ভ্যান গুলো স্কুল বাসের মত ,এর মধ্যে নানা রকম ক্যাবিনেট খাওয়া থাকা শোয়া ঘুমোনো কিচেন ফ্রীজ টিভি এবং লাইব্রেরীর ও টয়লেট সব ব্যাবস্থা পর্যন্ত রয়েছে । 

এই রিক্রিয়েশান ভ্যান  গুলো দেখলেই আমার খুব আনন্দ হয় । খুব ছোট বেলার কথা মনে পড়ে। ক্যালেন্ডারে দূরের ধূসর পাহাড় ,নীল সমুদ্র সৈকতের সোনালী বালুকা বেলা , সবুজ অরণ্য প্রান্তরের ছবি বা ধূসর মরুভূমির ধুধু  প্রান্তর দেখলেই ,অজানা কে জানা অচেনাকে চেনা, অদেখা কে দেখার জন্য সুদূরের পিয়াসী বালিকা  মন আকুল হতো, অথচ বেড়াতে যাওয়ার উপায় নেই। তখন কল্পনায় ঘরের তলায় চাকা লাগিয়ে আর খোলা জানলায় পুরোনো থালার স্টীয়ারিং বসিয়ে ছোট ছোট ভাই বোনেদের নিয়ে পৌঁছে যেতাম সেই অপরিচিত ছবির রাজ্যে। এক অকৃত্রিম আনন্দে ছবিতেই ছোট বেলার স্বপ্নময় খেলার জগত পরিপূর্ণ হয়ে উঠতো। এরপর বড়ো হয়ে বেড়াতে গিয়ে রেলের গাড়ি চড়ার যখন সুযোগ এসেছে ,তখন  সেই ঝমাঝম রোম্যান্টিক আওয়াজ , কুউ-উ-উ-উ ঝিক ঝিক শব্দে এবং ছোটো বেলার চাকা আলা ঘরের সাথে বেশ কল্পনার মিল খুঁজে পেয়েছিলাম। সিনেমাতে  R, V দেখেছিলাম , কিন্তু  বারো বছর আগে আমেরিকার ফ্লোরিডায় প্রথম এই ভ্যান গুলোকে চোখের সামনে দেখে একথায় বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়েছিলাম। সুযোগ পেলেই সেই অচেনা মানুষদের সাথে ভাব জমিয়ে  R, V র ভিতরে ঢুঁ মেরে দেখতাম ভিতর টা কেমন সাজিয়েছে। সেদিনের বালিকা মনের খেয়ালী কল্পনা যে এমন বাস্তব সত্য হয় তাই ভেবেই খুশির অন্ত ছিল না। রিক্রিয়েশান ভ্যান গুলো আমার কল্পিত সর্ব সুবিধা যুক্ত সেই চলন্ত  বাড়ি। পেট্রলবা ডিজেল ভরো আর যেখানে খুশি চলো মজার অন্ত নেই ।  
                                                                                অবাক হয়ে দেখি সেই  ভ্যান থেকে পিলপিল করে নামছে পীতাভ বরণ সরু চোখ চ্যাপ্টা নাকের  একটি  চাইনিজ পরিবার। একই রকম সাজ পোশাক মেরুনের হলুদ কালো চেক কাটা কটসউলের জামা পরা মাথায় লাল নীল টুপি র ওপর সাদা পাখির পালক গোঁজা। একের পর এক আটটা বাচ্চা বাস টির ভিতর থেকে নামলো। সবচেয়ে বড়োর বয়স ১২ হবে ,তারপর ,ক্রমে ১০ ও ৮ বছর। তারপর দুজন একই রকম দেখতে যমজ ৬ বছর হবে এবং সর্ব কনিষ্ঠ ৪ বছরের তিনটি বাচ্চা একদম একই রকম দেখতে।  ইয়াম হাততালি দিয়ে বলে ও কি মজা ! সবশেষে বেরোলো পাঁচ ফুট ও  পাঁচ ফুট  তিন ইঞ্চি লম্বা প্রায়  ৪০বছর বয়সী ওদের মা--বাবা। ক্ষুদে বাচ্চারা   জোর হল্লা শুরু করেছে ওদের মাতৃ ভাষায়। কারো ক্ষিদে পেয়েছে ,কেউ জল খাবে ,তো কেউ কোক খাবে কেউ চিপস বা  কুকিজ কেউ টয়লেটে যাবে। একজন কাঁদছে  তো  অপর জন ও কাঁদে। একজন তো প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলে কান্না শুরু করলো। পারলে সবাই একসাথে রেস্টরুমে  ঢুকবে।  কিন্তু টয়লেট তো একটাই। ভারী কৌতুক ,একেবারে হৈহৈ কান্ড। 
Recreation van
                                                                                         আমি হাঁ ! হয়ে শুধুই  তাকিয়ে আছি। ওদের বাবা মা নির্বিকার হয়ে শপিং এ  ব্যস্ত। বাচ্চা গুলো চার জনই আমাদের বেঞ্চে বসতে চায়। পারভীন বলে ইশ কী যন্ত্রনা ! ভাগ্যিস আমরা আগেই  কাজ সেরে নিয়েছিলাম। ভাবছি ধন্য এই  ''মা''।আজ এই প্রগতির যুগেও  যিনি এদের গর্ভে ধারণ করে শিশুদের নানা বায়না দৌরাত্মি দুষ্টমি অনায়াসে সহ্য করে লালন পালন করে চলেছেন। এ জগতের নিয়ম কানুন বড়ো বিচিত্রময়। কারো  বুকে সন্তানের জন্য হাহাকার , কারো কোল  উপচে পড়ছে সন্তান সৌভাগ্যের সাফল্যে। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। আবার এক হারিয়ে যাওয়া দিনের ছোটবেলার ছবি মনের আয়নায় উঁকি দিয়ে যায়। আমার সর্বংসহা মাকে মনে পড়ে।  

বারো ও দশ বছরের দাদা দিদি আপ্রাণ চেষ্টা করছে বাকী ছয় জন কে শাসন করে বশে আনার। কিন্তু এই ছোট্ট কিউটের দল মহাবিচ্ছু। ওদের দেখে এতো মজা লাগছিল আমার ঝোলা উপুড় করে যত চকলেট বিস্কিট ছিল সব প্যাকেট ওদের হাতে তুলে দিয়ে ভাব জমাতে চাইলাম। মোটে পাত্তা দিতে চাইছে না। মুখ ঘুরিয়ে নিজেদের মধ্যে দুষটু চোখে মুচকি হেসে ভাষা বিনিময় চলছে । অবশেষে ওদের মা বাবার সঙ্গে পরিচয় হলো --মিস্টার ও মিসেস ডং পেশায় টেলর,চলেছেন লাসভেগাসের শহরের উপকণ্ঠে শহরের উপকণ্ঠে এক বস্ত্রবিপনী কোম্পনীতে নতুন কাজের সুযোগ পেয়ে নতুন কর্ম সন্ধানে। তাঁদের অনুমতি পেয়ে আমার উপহার বাচ্চারা নিলে তাদের গোলাপী গাল আহ্লাদে ভরে উঠলো। আমরা ও খুব খুশি হলাম।মিষ্টার ডং হাতে নেড়ে বলেন আবার দেখা হবে। পারভীন ,ইয়াম হেসে বলে কী সুইট just like a flower ,,, আমি ভাবি  ঠিক যেন এক রাশ হলুদ গোলাপ ফুলের বাগানে এসে দাঁড়িয়েছি।  ভাবছি  ট্যুইন বেবি  দেখেছি  কিন্তু এই প্রথম এমন সুন্দর  ট্রিপ্লেট বেবি দেখলাম।  মিসেস ডং বাচ্চাদের তাড়া লাগিয়ে বাসে তুলছেন। আমরা ও বাইবাই জানিয়ে গাড়ি ষ্টার্ট দিলাম লাসভেগাসের দিকে ।

Post a Comment

0 Comments