ভোলগা নদীর খোঁজে – ১৫
বিজন সাহা
ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে
জলবিদ্যুৎ মিউজিয়াম দেখা শেষ করে গাইডের সাথে আমরা চললাম রক্তের উপর দ্মিত্রি গির্জায়। এটা উগলিচের প্রধান না হলেও জনশ্রুতির কারণে সবচেয়ে আকর্ষণীয় গির্জায় পরিণত হয়েছে। এর সাথে জড়িয়ে আছে রাশিয়ার ইতিহাস, জড়িয়ে আছে অনেক কৌতূহল। রক্ত মনে হয় সব সময়ই মানুষকে টানে বা কৌতূহলী করে তোলে। ফলে আর কিছু শুনুক বা নাই শুনুক এই গির্জায় ঢুকে সবাই গাইডকে ঘিরে ধরে আর সে যা বলে তা গোগ্রাসে গিলতে শুরু করে। হয়তো পরিস্থিতিকে একটু বেশি নাটকীয় করে তোলার জন্য এই গির্জার আলোটাও কেমন যেন ভূতুরে ভূতুরে করে রাখা হয়। যেহেতু আমি সব সময় ছবি তুলি তাই আলোটা খুব খেয়াল করি। আর গির্জায় গেলে আমি খুব পছন্দ করি ফ্রেস্কোর ছবি তুলতে। আগে অবশ্য ছবি তোলা নিষেধ ছিল। এখন ১০০ রুবল দিয়ে অনুমতিপত্র কিনলেই হয়ে যায়। তবে ফ্ল্যাশ ব্যবহার করতে দেয় না। এটা অবশ্য ওরা ঠিকই করে। ফ্ল্যাশের আলো ছবির জন্য ক্ষতিকর।
জানি না সবার সাথে কি না তবে আমার সাথে এমনটা প্রায়ই হয়। যখন কোথাও দ্বিতীয় বার আসি, এমনকি সেখানে যদি মাত্র কয়েক ঘন্টা সময়ও কাটাই কত স্মৃতি যে ভিড় করে আসে মনে। মনে হয় কত পরিচিত এই জায়গা, এই মাটি, এর গাছপালা। আর যদি ঘটনাক্রমে সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা থাকে তবে এই সব মুখগুলো ভিড় করে আসে। হ্যাঁ। এই উগলিচে আমরা এসেছিলাম ১৯৮৮ সালে। সোভিয়েত আমলে আমাদের পড়াশুনার বাইরেও বিভিন্ন শিক্ষামূলক ভ্রমণে নিয়ে যাওয়া হত। পরিচয় করিয়ে দেয়া হত সেসব জায়গার সংস্কৃতির সাথে, দেখানো হত কীভাবে বাস করে সোভিয়েত মানুষ। প্রতি বছর শীতে আর গ্রীষ্মে কয়েকটি ট্যুরের আয়োজন করা হত। শীতের ছুটি ছিল মাত্র ১৫ দিন তাই সাত থেকে ১০ দিনের জন্য দু' তিনটে শহর ভ্রমণের ব্যবস্থা হত। গ্রীষ্মে ছিল একাধিক ট্যুর। এছাড়া ছিল তিন সপ্তাহের জন্য ব্ল্যাক সীতে রেস্ট বা মালদাভিয়ায় আঙ্গুর তোলা কাম রেস্ট নেয়া। এসময় অনেকেই যেত ছাত্র নির্মাণ দলে। শীতে আমি যেতাম আমাদের ছাত্র সংগঠনের সম্মেলনে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন শহর থেকে বাংলাদেশী ছাত্রছাত্রীরা আসত। সে এক মহা মিলন মেলা। কয়েকটা দিন কীভাবে যে কাটত। গ্রীষ্মে যেতাম নির্মাণ দলে। প্রথমত তখন নিজেকে সমাজতন্ত্রের কর্মী বলে মনে হত। তাই নিজের সামর্থ্য মত যেটুকু পারি সেটা করা। আর কিছু কিছু উপার্জন। ১৯৮৪ সালের গ্রীষ্মে যাই কাজাখস্তানের এক গ্রামে কাজ করতে আর ১৯৮৬ সালে সাইবেরিয়ায়। তাইগায় বাস করার অভিজ্ঞতাই অন্য রকম। ১৯৮৮ সালে কাজ করি মস্কোয়। ১৯৮৫ সালে মস্কোয় বিশ্ব যুব উৎসব পালিত হয়। সেখানে কর্মী হিসেবে ছিলাম। সেই সূত্র ধরে পরে আলমা-আতা, ওশ, ফ্রুঞ্জে (বিশকেক), ৎসেলিনোগ্রাদ (আস্তানা) এসব জায়গায় যাওয়া। এসব ভ্রমণের আয়োজন করত আমাদের ইউনিভার্সিটি আর মস্কো শহর সোভিয়েত। ১৯৮৮ সালের নদীপথে ভোলগা ট্রিপ ছিল শহর সোভিয়েতের উদ্যোগে। বাংলাদেশ থেকে অনেকেই ছিলাম। মামি থেকে ছিল হাবিব, ইকবাল, লেবু; মেই থেকে নবীন; প্রথম মেডিক্যালের দীপু আর প্যাট্রিস থেকে আমি। আবার যখন উগলিচে ফিরে এলাম ওদের মুখগুলো ভেসে উঠলো মনের কোণে। আজ সবাই বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কেউ আমেরিকায়, কেউ কানাডায়, কেউ বাংলাদেশে আর আমি রাশিয়ায়। অবশ্য এতে অবাক হবার কিছু নেই। শোনা যায় এক সময় আদম আর হাওয়া নাকি আফ্রিকার এক জীর্ণ কুটিরে বাস করতেন। আজ তাদের উত্তরসুরীরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে, শুধু তাই নয় চাঁদে বাসের পরিকল্পনা করছে।
🍂

রক্তের উপর দ্মিত্রি গির্জা – ছবির মত দেখতে ভোলগার খাড়া তীরে উগলিচ ক্রেমলিনের উত্তরপূর্ব দিকে এই গির্জা তৈরি করা হয় ঠিক যেখানে যুবরাজ দ্মিত্রিকে হত্যা করা হয়েছিল সেখানে। আর এ থেকেই নাম রক্তের উপর। যেন যুবরাজ দ্মিত্রির রক্তের উপর দাঁড়িয়ে আছে এই গির্জা। বর্তমানে এটা উগলিচের ঐতিহাসিক-স্থাপত্য ও শিল্প বিষয়ক মিউজিয়ামের অন্তর্ভুক্ত। যেখানে যুবরাজ দ্মিত্রিকে হত্যা করা হয় সেখানে প্রায় সাথে সাথেই গড়ে ওঠে কাঠের চ্যাপেল। ১৬৩০ সালে চ্যাপেলের জায়গা নেয় কাঠের গির্জা। বর্তমানের পাথরের গির্জার কাজ শুরু হয় ১৬৮১-১৬৮২ সালে। কাজ চলে জারের অনুদানে। ১৬৯০ সালে থেকে রানী আন্না ভাসিলিয়েভনা চেরকাসস্কায়া এর দায়িত্ব নেন। পাথরে তৈরি এই গির্জার নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৬৯২ সালে। সে বছরই একে পবিত্র মানে উপাসনার উপযোগী করে তোলা হয়। স্থানীয় কিংবদন্তী অনুযায়ী যুবরাজের প্রতিটি মৃত্যু বার্ষিকীতে বালুর ভেতর থেকে রক্ত বেরুত। বলা হয়ে থাকে রোমানভ বংশের প্রথম জার মিখাইল ফিওদরভিচের ভাগ্যে এমন মৃত্যুই ছিল, কিন্তু ইভান সুসানিন তাঁকে রক্ষা করে। আর সেজন্যেই তিনি গির্জা তৈরির খরচ বহন করেন। পিটার দ্য গ্রেট সহ রোমানভ জারেরা দ্মিত্রির কাল্ট বা ব্যক্তি পূজা সমর্থন করে সেটাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেন। এই গির্জায় যথাক্রমে যুবরাজ দ্মিত্রি, প্রধান দেবদূত মিখাইল ও ইয়ারোস্লাভলের অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে সক্ষম ফিওদর ও তাঁর দুই সন্তান দাভিদ ও কনস্তান্তিনের নামে তিনটি সিংহাসন ছিল। রক্তের মত লাল রঙের এই গির্জা দেখতে অনেকটা জাহাজের মত।
অনেকগুলো গির্জার পাশাপাশি উগলিচে রয়েছে বেশ কয়েকটি মনাস্তির। ভোলগার তীর থেকে একটু দূরে অবস্থিত ভস্ক্রেসেনস্কি ছেলেদের মনাস্তির কবে তৈরি হয়েছিল সেটা কেউ জানে না, তবে এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় পঞ্চদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। প্রথমে এটা ছিল কাঠের তৈরি আর বর্তমান রূপ পায় দুই শ বছর পরে। শুভ্র শ্বেত বর্ণের উপর সোনালী গম্বুজ অনেক দূর থেকেই পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নিকোলাই রেরিখ সহ অনেক শিল্পীর তুলিতে এই মনাস্তির ধরা পড়েছে। ভস্ক্রেসেনস্কি মনাস্তিরের পাশেই শোভা পাচ্ছে উগলিচের অন্যতম সুন্দর রঝদেস্তভা ইয়োয়ানা প্রেদতেচি গির্জা। মৃত পুত্রের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই গির্জা নির্মাণ করেন বনিক কুপোলসভ। ১৯৩০ এর দশকে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সময় পরিকল্পনা অনুযায়ী এই গির্জা সরানোর কথা ছিল। কিন্তু গির্জার ঐতিহাসিক মূল্য ও স্থাপত্য সৌন্দর্য বিবেচনা করে শেষ পর্যন্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্র সরিয়ে নেয়া হয়। উগলিচের আরও অনেক স্থাপত্যের মধ্যে যেটা আমার চোখে পড়েছে সেটা বোগোইয়াভলেনস্কি মেয়েদের মনাস্তির। শুভ্র এই স্থাপনার গম্বুজগুলো ঘন নীল আর তার গায়ে অসংখ্য তারা শোভা পাচ্ছে। ঠিক যেন মেঘমুক্ত শরতের রাতের আকাশ। দ্মিত্রি দনস্কইয়ের স্ত্রী রানী এভদকিয়া চতুর্দশ শতকের শেষে এই মনাস্তির প্রতিষ্ঠা করেন। অন্য এক ভার্সন অনুযায়ী ১৫৮৪ থেকে ১৫৯০ সাল পর্যন্ত ছেলের সঙ্গে উগিলিচে অবস্থানের সময় সম্রাজ্ঞী মারিয়া ফেওদরোভনা এই মনাস্তির স্থাপন করেন। ১৯৩০ সালে সোভিয়েত সরকার এই মনাস্তিরের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। ২০০০ সালে মনাস্তির আবার রাশিয়ান অর্থডক্স চার্চের হাতে ফিরিয়ে দেয়া হয়, ২০১০ সাল থেকে এটা আবার কাজ করতে শুরু করে। ২০১৮ সালে যখন এক্সারশনে উগলিচ যাই তখন ঘুরে ঘুরে এসব দেখি, প্রচুর ছবিও তুলি। আমার ধারণা এতদিনে সারা দেশের মত এখানেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তাই প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল আবারও এসব জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর। কারণ শুধুমাত্র বিভিন্ন সময়ে কোন শহর বা জনপদের তুলনার মধ্য দিয়েই আমরা জানতে পারি উন্নয়নের গতিবিধি, জানতে পারি সমাজ কোন দিকে যাচ্ছে। তবে কালিয়াজিন থেকে আমরা যখন উগলিচ এসে পৌঁছুলাম তখন আঁধার নেমে এসেছে। তাছাড়া সেই তভের থেকে শুরু করে উগলিচের দূরত্বও নেহাত কম নয়। রাস্তায়ই দেমিদ একজনের সাথে কথা বলে বাসা ঠিক করল। শহরের কেন্দ্র থেকে বেশ দূরে। পুরানো সোভিয়েত আমলের বিল্ডিং। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বাসার মালিক এলেন। আমাদের সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলেন নিজের ডেরায়। পাশের দোকান থেকে রাতের আর সকালের খাবার আনলাম। খাবার মানে মূলত টোম্যাটো, শসা, অলিভ, চিজ এসব দিয়ে সালাদ, রুটি আর সকালে ঐ ধরণের কিছু একটা। এর মধ্যেই সবাই স্নান সেরে নিলাম। আমি সাধারণত রাতে ঘুমানোর আগে বই না পড়লে চোখ বন্ধ করতে পারি না। কিন্তু সারাদিন জার্নির পরে বই পড়ার শক্তি আর থাকে না। ভেবেছিলাম পরের দিন সকালে কিছু সময় শহরটা দেখে রওনা হব ইয়ারোস্লাভলের পথে। কিন্তু সকালে আকাশ খুলে গেল, ঝির ঝির করে পড়তে শুরু করল সূর্যের তাপে অতিষ্ঠ মেঘের ঘাম। আমরা গাড়ি থেকেই আশেপাশে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে রণভঙ্গ দিয়ে পথে নামলাম। পরবর্তী যাত্রাবিরতি ইয়ারোস্লাভল – ইয়ারোস্লাভল রেজিওনের রাজধানী।
উগলিচের উপর ছবি পাওয়া যাবে এখানে
http://bijansaha.ru/album.php?tag=180
0 Comments