জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে -৮৩/রোশেনারা খান

পশ্চিমবঙ্গ সরকার দ্বারা আয়োজিত রবীন্দ্রজয়ন্তী ও বর্ষাবরণ অনুষ্ঠান চলছে।

যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান

পর্ব (৮৩)

আজ একটা ব্যস্ততম দিন গেল। হিয়ারিংয়ের জন্য দুটোর সময় ডেকে ছিল। উনি বললেন, ‘আগে চলে যাও, ভিড় হবে। ওনার কথামত ১২ তায় গিয়ে শুনলাম  দুটোতেই আসতে হবে। অফিসটা কেরানিতলায়, বাড়ি থেকে দূরে। ফিরে এসে আবার দেড়টার সময় গেলাম। আমি আর চন্দ্রিমা বসে আছি, অপেক্ষার যেন শেষ  নেই। ক্রমশ ভিড় বাড়ছে। কাজ শুরুই হয়নি। আড়াইটাতে কাজ শুরু হল। আমার কাজ শেষ হল ৫ টায়। তাও মেদিনীপুর কলেজের অধ্যাপক সুধিন্দ্রনাথ বাবু রিকোয়েস্ট করলেন, তাই হল। আমি অসুস্থ বোধ করছিলাম। উনি গাড়িতে করে বাড়ি পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। আমি সবিনয়ে না করলাম।
🍂

     আজ একটা মনে রাখার মত দিন গেল। ছোটভাইকে নতুন করে চিনলাম। বিশ্বাসই হচ্ছে না ওদের স্বামী-স্ত্রীর মনে আমাদের প্রতি, বিশেষ করে আমার  মেয়ের প্রতি এতখানি ঈর্ষা বিদ্বেষ লুকিয়ে ছিল। ওর স্ত্রী আমার মেয়েকে ঈর্ষা করে এটা ওর আচরণে অনেকবার প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু আমার ভাই(ভাই বলতে ঘৃণা হচ্ছে) যাকে জন্মের পর মায়ের মত করে লালন পালন করে বড় করেছি। সেই বছরই(১৯৭১)আমার বিয়ে হয়েছে। আমি পড়াশোনার জন্য বাপের বাড়িতেই থাকি। খান সাহেব সবটা দেখেছেন, তাই চিঠিতে লিখতেন, সারাদিন ভাইকে নিয়ে ব্যস্ত থেকনা, পড়াশোনা কর মন দিয়ে’।এইসময় ছুটির দিনগুলতে যখন শ্বশুরবাড়িতে এসে থাকতাম, তখন ছোট ভাইয়ের জন্যই বেশি মন খারাপ হত।  আমার  কাছে থেকে কলেজ পাশ করেছে। নিজের দুই ছেলে মেয়ের সঙ্গে কোন পার্থক্য করিনি, আজ সেই ভাই যে ভাষা ব্যবহার করেছে শুনলাম, তারপর আর সম্পর্ক রাখার প্রশ্নই নেই। দাদার কাছে ভাল সাজাও হল, আর এই সুযোগে মনের বিষটা উগরে দেওয়াও গেল। আর ওই দাদার জন্য যা করেছি, তা তো ওর স্ত্রী  জানে না। সেদিন খান সাহেবকে দেখতে না আসাটা আমি মেনে নিতে পারিনি। ও  অসুস্ত হয়েছে, যাদের বাড়িতে থাকত, তারা রিক্সায় করে আমার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। সবে মেদিনীপুর এসেছি, বিশেষ কিছু চিনিনা। ওতেই ডাক্তারের খোঁজে রবীন্দ্রনগর ঘুরে ঘুরে রায়ের নার্সিংহোমে শ্যামল সরকারের কাছে নিয়ে গেছি।  ব্যাথার কারণ অ্যাপেণ্ডিক্স, দ্রুত অপারেশন করতে হবে। এর পরেও আরও অনেকবার ওদের স্বামী-স্ত্রীকে আমার এখানে রেখে  অপারেশন, চিকিৎসা করিয়েছি। যে মানুষটার বাড়িতে নির্দ্বিধায় থেকেছে, সেই অসুস্থ মানুষটার সঙ্গে দেখা না করে কী করে বাড়ির সামনে থেকে চলে যেতে পারল? এটা আমি মেনে নিতে পারিনি। কথা প্রসঙ্গে একদিন আমি আমার কষ্ট, ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেলি। এবং এই ঘটনার পর আমি ওদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্কও ছিন্ন করে ফেলি। ওরাও এটাই চেয়েছিল, যাতে রানীর বিয়ের কোন দায়দায়িত্ব নিতে না হয়।

     বাবলি এসব শুনে  প্রচণ্ড রেগে আমার সেজভাইকে ফোনে বলে, আমার দেওয়া টেবিল-চেয়ারে বসে খাবে, আমার মাকে অপমান করবে? ভুলে গেছে? এ বাড়ির খেয়ে বড় হয়েছে? তুমি ওর কাছে জানতে চাও, কেন মাকে অপমান করেছে? আমি ছাড়ব না। ব্রিটিশ দূতাবাসের মাধ্যমে ওদের নামে কমপ্লেন করব।  ওদের শাস্তি দেওয়াব। মনির কাছে ও সব অস্বীকার করেছে, মনিও ভাইয়ের  কথাটাই  বিশ্বাস করেছে এবং ছোটবোন ছবিকে বকাবকি করেছে আমাকে সব কথা জানানোর জন্য। মনি বাবলির কথাগুলো পাপুকে বলেনি। আমিও ওসব ঝালেলা চাইনি। আমার এখন আসল মানুষটাকে নিয়েই চিন্তা। ওঁকে ভাল রাখতে হবে। আমি ওদের ওপর কোন দিক দিয়েই নির্ভরশীল নই।  

      গতকাল ডায়ালিসিসের সঙ্গে ইনজেকশন ছিল, কিন্তু নিয়ে যেতে ভুলে গেছলাম। আবার বাড়ি গিয়ে নিয়ে আসতে হয়েছিল। ‘মহারাজা’ লজে মিটিং ছিল, সেখানেও যেতে পারিনি। আজই বিকেলে দূরদর্শন থেকে রামকৃষ্ণ বাবু ফোন করে মহিলাদের কয়েকটা বিষয় নিয়ে ভেবে জানাতে বললেন। আমাকে দিয়ে প্রোগ্রাম  করাবেন।

   আজ জুলাইয়ের ২৮, কলকাতা গেছলাম। ‘অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস’ এ আয়োজিত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি আলোচনা চক্রে যোগ দেবার জন্য। ওঁরা অনুরোধ করেছিলেন মাননীয় অশোক গাঙ্গুলিকে আলোচনায় অংশগ্রহণ করার জন্য যদি রাজি করাতে পারি। আমি বললে উনি না করবেন না, জানি, তা বলে যেখানে সেখানে যাওয়ার কথা বলতে পারি না। যাক, উনি  এসেছিলেন। আলোচনা হয়েছে, যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা কতটা ফলপ্রসূ হবে বলা মুশকিল।

     এক আত্মীয় খুব অসুস্থ, বাবলি কিছু টাকা পাঠিয়েছিল, আজ তানির হাতে দিয়ে পাঠালাম। অনুষ্ঠানের কথা আমাকে আগেই জানিয়ে ছিল, গতকাল রাত প্রায় ১০ টায় সুদীপ কার্ড দিয়ে গেছে। আজ সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান। রানী কলেজ থেকে ফিরলে তারপর যাব। আজ দুপুরে বাংলাদেশ হাই কমিশন থেকে প্রকাশিত ‘ভারত বিচিত্রা’ পত্রিকার জন্য একটি লেখা শেষ করলাম। আজ একটি মেয়ে এসেছিল, খান সাহেবর দেখভালের বিষয়ে কথা বললাম, সামনের শুক্রবার থেকে আসবে। রানী কলেজ থেকে ফিরলে ৫ টা ৩০শে অনুষ্ঠানে গেলাম। তারও কিছু পরে অনুষ্ঠান শুরু হল। মঞ্চে অনেকে ছিলেন, বিশ্বজিত সেন(বিএড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধক্ষ্য) ,কবি নির্মাল্য, স্বপ্না ঘড়াই(রামানন্দ কলেজের অধক্ষ্য), অনন্যা(তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরের আধিকারিক), এস ডি ও, এ ডি এম, বিডিও, মৌসম(শিক্ষক),  সুকান্ত(ব্যাঙ্ক করমচারি) ও আরও অনেকে। এটা ছিল রবীন্দ্রজয়ন্তী ও বর্ষা বরণের সরকারি অনুষ্ঠান। আমাদের প্রত্যেককেই বরণ করার সময় একটি করে গাছের চারা উপহার দেওয়া হল। সবাই মিলে চারাগাছে জল ঢেলে অনুষ্ঠানের সূচনা হল। প্রথমে যিনি বলতে উঠলেন, তিনি অনেক সময় নিয়ে নিলেন। যত ভালই বক্তব্য রাখুন না কেন, তাঁকে থামতে জানতে হবে। অনেকে দেখেছি যতটা বলবেন ঠিক করেছেন, বা লিখে এনেছেন, সেটা শেষ করবেনই। আমার আর ধৈর্য থাকছিল না। আমার মন পড়ে আছে বাড়িতেই। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। আমি যত বার ওঠার চেষ্টা করছি, অনন্যা(তথ্যসংস্কৃতি দপ্তরের আধিকারিক) ততবারই বসিয়ে দিয়ে বলছে, ‘আর একটুক্ষণ বসুন দিদি’। শেষে উঠে দাঁড়িয়েছি যখন, তখন আমাকে ২/৪ কথা বলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলে, আমি একটি কবিতা শোনালাম। মাননীয়া এডিএম উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দন করে বললেন, ‘ আপনার কবিতা খুব ভাল লেগেছে’। তবে এই অনুষ্ঠানে স্বপ্নাকে কিছু বলতে না দেওয়া ঠিক হয়নি।

     অধ্যাপক ইয়াসিন ফোন করে বলল্‌, ওর পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীতে আমার নাম রাখছে। প্রকাশক কমলেশের ওখান থেকে আবার ফোন করে জানাল, যেহেতু বাবলিরা আসছে, তাই এই মাসে কোন অনুষ্ঠান রাখছে না। পারলে একদিন এসে দেখা করে যাবে।

     আজ ইদ্দুজ্জহা, আমার তাতে কিছু যায় আসেনা। কাজের লোক পাচ্ছিনা,  ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ফ্রিজে চিকেন ছিল, সেটাই রান্না করলাম, সঙ্গে টম্যাটো চাটনি। রানী বাড়ি যায়নি। উনি যথারীতি বমি করে দিলেন। ওনাকে ধুইয়ে মুছিয়ে বিছানায় শোয়ালাম। একটু পরে ঘুমিয়ে পড়লেন। আমি আর রানী খেলাম। বিকেলে রানী সাহানাজদের বাড়ি গেছল, ওর মা টিফিন কৌটো ভরে পোলাও, মাংস,  সিমাই পাঠিয়েছেন। এই আন্তরিকতা নিজের ভাইবৌএর কাছ থেকে কখনও  পাইনি। বেশ কয়েক বছর ধরেই আমি কোন উৎসব পালন করি না। তাছাড়া উৎসবের নামে এই প্রচুর পরিমানে পশুহত্যা আমি মন থেকে মেনে নিতে পারিনা। ছোটবেলায় একটি বিদেশি গল্পের অনুবাদ পড়েছিলাম। এক দরিদ্র মা তার ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে শহরের একপ্রান্তে বাস করতেন, কয়েকদিন পর ‘বড়দিন’। কিন্তু দরিদ্র মা এখন পর্যন্ত কেক ও নতুন পোশাক কেনার কোনও ব্যবস্থা করে উঠতে  পারেন নি। কিছুই নেই তাদের, আছে একটিমাত্র মেষ শাবক। আগামিকাল বড়দিন, সারা শহর আলোয় সেজে উঠেছে। ছেলের শুকনো  মুখ মা আর সহ্য করতে না পেরে, মেষ শাবকটিকেই কসাইয়ের কাছে বিক্রি করে  ছেলের জন্য নতুন জামা কিনে যখন কসাইখানার পাশ দিয়ে ফিরছিলেন, তখন  রক্তে তার পা ডুবে যেতে দ্যাখে এখুনি বিক্রি করে যাওয়া মেষ শাবকটির কথা  মনে পড়ে যায়, সারা শরীর তার কাঁপতে থাকে। ছেলের জন্য কেনা জামাটি হাত থেকে সেই রক্তের স্রোতে পড়ে যায়।
      এরকম আরও একটি করুণ স্মৃতি মনে গাঁথা হয়ে রয়ে গেছে। পাশের বাড়িতে কোরবানির জন্য একটি গাভী কিনে এনেছে, গাভীটি থেকে থেকেই হাম্বা হাম্বা করে তার বাছুর কে ডাকছে। ওই ডাক আমার বুকে এসে বিঁধছ। ভাবছি ওর বাছুরটিও নিশ্চয় মাকে ডাকছে। পরের দিনই ছিল ইদুজ্জহা, মায়ের সন্তানের জন্য সেই কাতর ডাক আজও কানে বাজে। অনেকে প্রশ্ন করবেন, আপনি কি  মাংস খান না? খাই, সেটার জন্য একদিনে এত প্রাণী হত্যার প্রয়োজন হয়না। যেমন পশুরা পশুর মাংস না খেলে ভারসাম্য রক্ষা করা মুস্কিল হত। মানুষের ক্ষত্রেও তাই। শুধু কোরবানি নয়, ধর্মের নামে সব পশুবলির কথাই বলছি। কোরবানির আসল উদ্দেশ্য হল মনের ভিতরের পশুকে হত্যা করে নিজেকে কলুষ মুক্ত করা। আর একটা দিক হল, যাদের মাংস কিনে খাওয়ার ক্ষমতা নেই,  তারা এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে। কোরবানির মাংসের তিন ভাগের একভাগ এদের জন্য নির্দিষ্ট করা থাকে। পশুর কথা থাক, আবার মানুষের কথায় ফিরি।  তারা হল আমার তথাকথিত আপনজন।

      কিছু কিছু ঘটনা বা কথা কখনো ভোলা যায় না আমি ভুলতে পারিনি।                                        জীবনের ওপর দিয়ে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। এইসময়ই মানুষ চেনা যায়। আমাকে  একবর চিকিৎসার জন্য কয়েকদিন কলকাতায় থাকতে হয়েছিল। সেই  কয়েকটা  দিন তাঁর ছোট শ্যালক তাঁকে খাইয়ে ছিল। কয়েকটা দিন যে ওনাকে খাওয়াতে হয়েছিল, আর সেটাতে ওর বউ যে কতটা বিরক্ত হয়েছিল তার প্রমাণ কয়েকদিন পরেই পেয়েছিলাম। উনি একদিন ছোট শ্যালকের বাড়ি গেছলেন, ছোট সেই সময় বাড়ি ছিল না। ওর বৌ ভাবল এই সুযোগ, আবার যদি ওনাকে খাওয়াতে বলি? তাই ওনাকে কথায় কথায় শুনিয়ে দেয় ‘আমরা এখন আর রান্না করি না, মায়ের কাছে খাই’,  উনি কথাটার অর্থ না বুঝলেও আমি শুনে ঠিকই বুঝেছিলাম।  

                                         ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments