জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ১৬ / সালেহা খাতুন

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ১৬ / সালেহা খাতুন 


সত্যিকারের বীর অনুপম ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হয়েও র‌্যাগিংয়ের শিকার হয়ে ফিরে আসে। পড়াশোনা করে পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে। ১৯৯৪ এ ইণ্ডিয়ান এয়ারফোর্সে রেডিও ফিটার হিসেবে জয়েন করে। বর্তমানে ২০০৬ থেকে ল্যাণ্ড অ্যাণ্ড ল্যাণ্ড রিফর্ম ডিপার্টমেন্টে স্পেশাল রেভেনিউ অফিসার হিসেবে কর্মরত। আমার বন্ধুভাগ্য দেখে আমি নিজেই মাঝে মাঝে বিস্মিত হয়ে যাই। আর একজন বন্ধু বিভাস। ওর সঙ্গে ক্লাস ফাইভ থেকে একসঙ্গে পড়েছি। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিক থেকে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু ইংরেজি টিউশন আমরা জয়নাল সাহেবের কাছেই পড়তাম। ফলে একসঙ্গে পড়তে যেতাম। ও আসত বেলডুবি থেকে। আমি সাহাপুরে থাকি। যেতে হবে বাউড়িয়ায়। যাওয়ার পথে ও আমাকে ওর সাইকেলের পেছনে বসিয়ে নিয়ে যেত। ফেরার পথেও তাই। সঙ্গে আরো দুই বন্ধু থাকতো কুতুব আর রফিকুল।

 বিজনবাবুর কাছে ফিজিক্স কেমিস্ট্রি ম্যাথ পড়া হয়ে যেত। বাকি রইলো বায়োলজি। কলেজেই পঞ্চানন বাবুর কাছে পড়তাম। সপ্তাহে একদিন শুক্রবার। বড়ো মাসি উলুবেড়িয়ায় থাকতেন বলে ঐ দিনটার রুটিন সহনীয় হয় আমার। ভোর পাঁচটার সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে একঘন্টা হেঁটে পাঁচলার কাছাকাছি বিজনবাবুর বাড়িতে পড়ে বাস ধরে উলুবেড়িয়া কলেজে যেতাম। সেখানে ক্লাস করে চলে যেতাম বড়ো মাসির বাড়ি। মাসি গরম জল রেডি করে রাখতেন। আমি স্নান করে খেয়ে দেয়ে বিকেল পাঁচটার সময় কলেজের কাছাকাছি একটা বাড়িতে পঞ্চানন বাবুর কাছে পড়তে যেতাম। ফেরার সময় স্যারের সঙ্গেই ফুলেশ্বর স্টেশনে এসে ট্রেন ধরতাম বাড়িতে ফেরার জন্য। আমি বাউড়িয়ায় নেমে যেতাম। স্যার যেতেন রামরাজাতলা। আমাকে নিতে বাবা হ্যারিকেন নিয়ে স্টেশনের কাছাকাছি চলে আসতেন। রাত নটায় বাড়ি ফিরতাম। 

কোনো কোনো দিন উলুবেড়িয়া স্টেশন থেকে ট্রেন ধরতাম। ছুটে এসে মেল লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেন ধরে একবার উল্টো দিকে চলে গিয়েছিলাম। ট্রেন চলতে শুরু করতেই বুঝি ফুলেশ্বর না গিয়ে বীরশিবপুর যাচ্ছে। চলন্ত ট্রেন থেকে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করতেই সহযাত্রীরা হই হই করে ওঠেন। নামতে দেন না। পরের স্টেশনে নেমে আবার হাওড়াগামী ডাউন ট্রেন ধরে বাউড়িয়ায় ফিরি। বন্ধু তুলিকা এরকম প্রায়ই গুলিয়ে ফেলতো। লোকাল ট্রেনের সামনে পেছনে একই ডিজাইন ওকে বিভ্রান্তিতে ফেলতো। ভয়ে আমাদের মতো পণ্ডিতদের সঙ্গে যাতায়াত করতো। আমার মুশকিল আসান অনুপম তো থাকতোই।
🍂

 উচ্চমাধ্যমিকে আমাদের বায়োলজি ডিপার্টমেন্ট থেকে এডুকেশনাল ট্যুরে মুকুটমনিপুর নিয়ে যাওয়া হয়। রাত্রি দশটায় কলেজ থেকে বাস ছাড়বে। অতএব তার আগে কলেজে পৌঁছতে হবে। সন্ধের আগেই চলে গেলাম গরুহাটায় সহপাঠী স্বাতী পালের বাড়ি। গরম গরম ফুলকপির তরকারি দিয়ে দুই বন্ধুকে ভাত খেতে দিলেন কাকিমা। দুজন মিলে চলে এলাম বাস ধরতে।অনেকের অভিভাবক এসেছিলেন। তার মধ্যে আমার বন্ধু দীপার মামা এসেছিলেন। বয়সে অনেক বড়ো মামার দুই কাঁধে হাত রেখে দীপা কী সুন্দর গল্প করছিল। কী ভালো যে লাগছিল। পরে দীপার মামার বাড়িতেও গিয়েছিলাম। দীপা মামার বাড়িতেই মানুষ হয়েছে। দীপা ভালো আবৃত্তি করে। ও এখন কোলকাতায় থাকে।

ক্লাস সেভেনের পর মায়ের সঙ্গে একবার দীঘা গিয়েছিলাম মাধ্যমিকের সময়। এই প্রথম বন্ধুদের সঙ্গে পরিবারের লোকজন ছাড়া ট্যুরে গেলাম। অবশ্য স্যার ম্যাডামরাও ছিলেন। তবে আমার অভিজ্ঞতা বলে বাইরে গেলে বন্ধুরাই প্রোটেকটারের ভূমিকা নেয়। পরের দিন রাত্রি একটায় আমাদের বাস ফিরলো কলেজে। স্যারেরা অতো রাতে আমাদের একা একা বাড়ি যেতে দিলেন না। টিচার্স রুমে আমাদের বসিয়ে রাখলেন। কাজ দিয়ে দিলেন । এ ধরনের ভ্রমণের গুরুত্ব নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে দিলেন ঐ রাত্রে। সকাল হতে ট্রেন ধরে ঘরে ফিরলাম।
 উচ্চমাধ্যমিকের পর ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়া বন্ধুদের সমাজ মাধ্যমে ফিরে পেয়ে ‘সময়’ নামে একটি কবিতা লিখলাম -
          
 আমাদের যে দিন গিয়েছিল চলে
               আবার এসেছে ফিরে।
লিপিকা সুস্মিতা স্বাতী অনুরাধা দেবমিতা দীপা নাসিমের হাত   ধরে।

তিরিশ বছর আগে
সদ্য কৈশোর পেরোনো দিনগুলির
নির্মাণ ঘিরে ছিলাম একঝাঁক তরুণীর দল।
চোখজুড়ানো সে সব মুখে
আজ পরিপূর্ণতার স্পষ্ট ছাপ।

সেদিন যে ভবিষ্যত আমরা কেউই পাইনি দেখতে
আজ আর কল্পনা নয় 
বাস্তবিক পৌঁছে গেছি সেই ভবিষ্যতে।

আসলে নতুন করে আত্মজীবনী লেখার প্রয়োজন মনে হয় ছিল না কেননা আমার প্রতিটি কবিতাই আমার আত্মজীবনীর অংশ।
(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments