কালের অতল তলে কলোরাডো
১৫ পর্ব
চিত্রা ভট্টাচার্য্য
মন মেতে আছে মাইলের পর মাইল জুড়ে রক্তাভ পাহাড়ের বেহিসেবী লাল রঙের প্লাবনে। যে দিকেই তাকাই রক্তিম পর্বতের শীর্ষদেশে তখন দ্বিপ্রহরের সূর্য দেব রুদ্রতপ্ত তপস্বিনীর গৈরিক বেশে জ্বলন্ত দৃষ্টি মেলে যেন স্বয়ং নটরাজের ভূমিকায় আবির্ভুত হয়েছে। কোথাও জনপ্রাণীর সাড়া নেই নিথর প্রকৃতির নিস্তব্ধতায় আমার চোখের সামনে ব্রাইসপার্কে এক অন্যরকম আলোকজ্জ্বল দ্বিপ্রহরের ছবি ভেসে উঠলো। দিগন্ত প্রসারী ঢেউ খেলানো ধুধু পাহাড়ে এখন তাপ প্রবাহে প্রলয় নাচনের ইঙ্গিত। কাছে দূরের রুক্ষ পাহাড়ি সৌন্দর্যের যে কোনো দৃশ্য মনের ক্যামেরায় চিরস্থায়ী হয়ে সুগভীর দাগ কেটে চলেছে। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে ভাবি পৃথিবীর জন্ম লগ্নের সাক্ষী স্বরূপ কোটি কোটি বছরের স্মৃতি ভারে জর্জরিত হয়ে সর্বংসহা এই বিশাল পর্বতরাশি নিথর নিশ্চল মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। ট্যাকোমার জানলায় চোখ রেখে অন্তহীন সেই রক্তিম অপরূপ স্বর্গীয় সৌন্দর্যে মুদ্ধ আমি।
ব্রাইসের পাহাড় থেকে ধীরে ধীরে নীচের এক উপত্যকায় এসেছি । জুপিটারের ছায়ায় এখানে সর্বত্র এক মনোরম পরিবেশ। বেগনে রঙের ফুলে ভরা নাম না জানা গাছের তলায় ট্যুরিস্ট দের জন্য নির্মিত বিশ্রামের জায়গা দেখে ডাইনিং টেবিল সাজিয়ে নিলাম। হ্যারিগ্র্যান্ড পার দেওয়া লাঞ্চ বক্স দুই হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মধ্য দুপুরের ভুখা পেট সব দাউ দাউ জ্বলছে ,একটু ও সবুর সৈতে নারাজ। প্লেট চামচ সাজিয়ে হটপট খুলে ব্যুফে সিস্টেমে লাঞ্চ শুরু হলো। এতদিন পর টুনা মাছের ঝাল ,চিকেন কারী পোলাউ পনির কোপ্তা, প্রতি টা রান্না অমৃত, এককথায় লা জবাব ! আমি তারিফ করবো কি? বিস্মিত ! আনন্দে আপ্লুত। এত শৌখিন সুস্বাদু রান্না দিয়ে বন ভোজন জীবনে এই প্রথম।
গ্র্যান্ডপার লক্ষ্মীছাড়া হার্মাদের দল বলে you are a great cook Grandpa....you are amazing....রান্না গুলো সব yummy....delicious,,,আরো কত কি। যত বিশেষন ঝুলিতে জমা ছিল। লাঞ্চ টেবিলেই ইয়ম অতনুর সাথে আমাদের অবাধ খুশি টুকু ভিডিও কল করে হ্যারিসাহেব কে জানালাম। গ্র্যান্ডপা তার মোটা ভুরু আর তাগড়াই সাদা গোপ টি নাচিয়ে ,ভোজন রসিকদের আনন্দ মুচকি হাসিতে উপভোগ করলেন। এ প্রান্ত থেকে হাত নেড়ে বললাম ,হাই মিষ্টার হ্যারি ''তোমার প্রতিটা রেসিপি স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। আমাকে অবশ্যই ধার দিও। '' উনি চোখ পাকিয়ে বলেন ''কভি নেহী।" আমি ও হেসে ফেলে বলি '' আচ্ছা সে দেখা যাবে ।'' এই নির্জন পাহাড়ি উপত্যকায় বনের ধারে বসে এমন পরিপাটি সুস্বাদু লাঞ্চের ব্যবস্থা ? আমার সুদীর্ঘ্য রান্নার অভিজ্ঞতায় স্বপ্নেও ভাবতে পারিনা।
টিম লিডার ব্রতীন এখানে ৪৫মিনিটের মত ব্রেক দিয়েছে। ডাইনিং টেবিলে বসেই উল্টো দিকের পাইনের সারির ফাঁকে লাল পাথরের বাঁ দিক ঘেঁষে ঝর্ঝর করে বয়ে চলেছে পাহাড়ি ঝর্ণা ধারা। এক চিলতে খাদের বুকে টলটলে ফিরোজা রঙের জলে দুপুরের জ্বলন্ত আকাশ ঝাঁপ দিয়েছে। সাদা মেঘেরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে পাহাড়ের গায়ে লেপ্টে আছে । স্পষ্ট তার প্রতিবিম্ব পড়েছে শান্ত স্থির জলে। ব্রতীন অতনু ইয়ম লেক দেখতে গিয়েছে। বেশ বুঝেছি ,এখন সিগারেটের ব্রেক ।
বিশাল প্রান্তরের সামনে বেশ বড়ো এক পেল্লাই পাথরের চাতালে পা ঝুলিয়ে বসে আছি। এই বিশালত্বের সামনে নিজেদের অতি ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র লাগছে। পেছনে খাড়াই পাহাড়ের দেওয়াল উঠে গেছে। পারভীনের মুডঅফ, চুপচাপ বসে আছে আমার পাশ টিতে। ওর ফর্সা কপালে চিন্তার ভাজ। মোবাইলে কিছু আগে ঢোকা একটা ম্যাসেজ মন দিয়ে বারবার পড়ছে। ওর দিকে সস্নেহে তাকিয়ে বলি কোনো দুঃসংবাদ ? বলে ,না তেমন কিছুই নয়। মা চাকরি ছেড়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় আমার কাছে থাকতে চায়। কিন্তু এখোনো আমার পোস্টডক কমপ্লিট হয়নি।পার্মানেন্ট জব পাইনি ,ছোট্ট একটা ঘরে শেয়ারে থাকি , পুরাতত্ত্ব বিভাগে চাকরি করা আমার স্বপ্ন। অন্ততঃ এখোনো দুটো মাস লাগবে । একেবারে job confirm হলে মা কে নিয়ে আসার প্ল্যান ছিল।
আমি বেশ কয়েকদিন ধরেই লক্ষ্য করেছি ,এই স্মার্ট ফর্সা লম্বা বাস্তববাদী পারভীন মাঝেমাঝেই আত্মবিস্মৃত অন্যমনস্ক হয়ে যায়। আধুনিক যৌবনের দূত হয়ে ও ওর চোখ ঘুরে বেড়ায় কোন অতীতে অজানার সন্ধানে ? পৃথিবীর বুকে নিঃশব্দে চাপা পড়া অদেখা ঐ সুপ্ত জায়গা গুলোর রহস্য উদ্ঘাটন করতে ওর যত উৎসাহ। বাঁধন ছাড়া হয়ে শুধুই অতীতের খোঁজে ঘুরে বেড়াতে ওর জুড়ি নেই। আদি সমাজ সভ্যতা, জীবনে বেঁচে থাকার রহস্য ওকে তাড়া করে বেড়ায়। আমরা ভাবি সমাজতত্ত্ব ,ভূবিদ্যা ,ইতিহাস নিয়ে রিসার্চ করতে গিয়ে ও এক অদ্ভুত মানসিক অবসাদের মধ্যে ডুবে রয়েছে।
কিছুটা সময় নীরব থেকে পারভীন বলে মার শরীর ঠিক নেই। হোমের চাকরি তে ছুটি নিয়েছে। কী এক অজানা ভাইরাস রোগ দেখা দিয়েছে ,খুব ছোঁয়াচে। সর্দি কাশি জ্বর শ্বাস কষ্ট শুরু হয় হাফ ধরে যায়। কাল দিনের বেলায় লাসভেগাস থেকেই নেভাদার ভিলেজে চলে যাবো ভাবছি। আমি বলি অবশ্যই যাবে। জ্বর সর্দি কাশি এসব তো সিজিন চেঞ্জে হয়েই থাকে। এবারে একটু ব্যক্তিগত প্রশ্ন করায় দেখি ওর মনের আগল খুলে গেল। পারভীন দুই মলাটের মাঝে সুপ্ত থাকা অপ্রকাশিত গল্পের পাতা ওল্টায়।
মিষ্টার লুইস ও রাবেয়ার দুই পরিবারের পূর্ব পুরুষ গোল্ডরাশের সময় দূর্গম পথের অনেকঝড় ঝঞ্ঝা সহ্য করে শীতে গ্রীষ্মে জীবন বাজী রেখে স্বর্ণ সন্ধানে স্পেন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন। তারপর স্বর্ণ সন্ধানের ধামাকা কেটে গেলে ওরা এখানেই বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে বেরিয়ে নিউ মেক্সিকোয় স্থিতু হয়ে বসে। এবং বংশ পরম্পরায় সানফ্রান্সিকোর নগরী তৈরী , গোল্ডেন ব্রিজ, নদীতে বিভিন্ন ড্যাম তৈরী , রাস্তা ঘাট ,পার্ক ,রেললাইন বন্দর শহর তৈরী ইত্যাদি নগর উন্নয়নে সাধারণ শ্রমিক হয়ে সর্বত্র কাজের সন্ধানে একসঙ্গে ঘুরে বেড়াতেন। কঠিন বাস্তবের মোকাবিলায় চারপুরুষ ধরে কেউ কখোনো কারো হাত ছাড়েনি। পরিবর্তনের স্রোতে দিন চলে ,দুই পরিবারের লুইস ও রাবেয়া এক সাথে বড়ো হয়। এবং গভীর বন্ধুত্বের পর ,প্রেম ও বিয়ে করে। ক্ষেতি জমি , মেষ শাবক ও তাদের শিশুটির শৈশব থেকে কৈশোরে যাওয়া নিয়ে সুখেই তাদের দিন কাটছিল। কিন্তু সুখ শান্তি বোধহয় চিরস্থায়ী রূপে আমেরিকান সামাজিক জীবনে ধরা দেয়না।
ক্রমশঃ পারিবারিক সম্পর্কে চির ধরে ঝামেলা শুরু হয়। ,দুজনের মধ্যে তুমুল ঝগড়া অবিশ্বাস,একে অপরকে সন্দেহ , নিত্য অশান্তি ছাই চাপা আগুনের মত লুইস ও রাবেয়ার ভালবাসার সংসারে ধিকিধিকি করে জ্বলতে থাকে। মিষ্টার লুইস দিনের পর দিন বাইরে রাত কাটায়। রাবেয়া অপমানিত বোধ করে ও প্রতারণার স্বীকার হয়। এরপর মিষ্টার লুইস একরাতে জুনি আন্টিকে ঘরে নিয়ে এলে মা রাবেয়ার সহ্যের বাঁধ ভেঙে যায়। গৃহের সুখ শান্তি এমনিতেই তলানিতে ঠেকেছিল। মা সেদিন ই ভোর রাতের আঁধারে তার মেয়েকে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লে জেনেছিলাম ওদের আমি বায়োলজিক্যাল সন্তান নই। পালিতা কন্যা। ,তখন আমি ক্লাস ফাইভ।দশ বছরের মেয়েটির কাছে এক মুহূর্তে পৃথিবীর রঙ ধূসর বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল।
নিউ মেক্সিকো অঞ্চলে এক সরকারী হোমে নিঃসন্তান রাবেয়া বাচ্চাদের ন্যানির কাজ সেরে ঘরে ফেরার সময় এক শীতের রাতে নাভাহোদের পরিত্যক্ত ওল্ড আমেরিকান চার্চের সিঁড়িতে বেতের বাস্কেটে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল। কৌতূহলে বাস্কেট খুলে দেখে তোয়ালে মুড়ে একটি সদ্য জাত বাচ্চাকে কেউ প্রভু যীশুর আশ্রয়ে রেখে গেছে। তৎক্ষণাৎ শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়ে শূন্য মাতৃত্বের বুকে সন্তান সাধ পূর্ণ করে নিজেকে ধন্য মনে করেছিল রাবেয়া । তখন আকাশ ভরা তারার আলো মিটিমিটি জ্বলে অন্ধকারে নির্জন পথের সাথী হয়েছিল।
জোনাক জ্বলা রাতে ফুটফুটে এক তারা আকাশ থেকে খসে ধরায় এসেছে তার কোলে। তাই সেই কন্যা শিশুটি রাবেয়ার পারভীন।' তখন মিষ্টার লুইস ও সানন্দে তাকে কন্যা স্নেহেই গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সেদিনের পর থেকে রাবেয়া মায়ের পরিচয়ে ও অবদানে আমার বড়ো হয়ে ওঠা , স্কুল ,লেখা পড়া সরকারি অনুদান সব। আজ আমি ৩৫ বছরের পারভীন। তবে হায়ার ক্লাসেই স্বাবলম্বী হয়ে গিয়েছিলাম। ক্যালিফোর্নিয়ার সানহোসে তে স্কলারশিপ নিয়ে Sociology পড়তে এসে , সুযোগ পেলেই আদিবাসী নাভাহো দের পুয়েব্লোতে ঘুরেছি শুধু শিকড়ের খোঁজে। যদি ও জানি সব টাই অৰ্থহীন নিছক এক পাগলামো।
এই দুনিয়ায় মা রাবেয়া , ব্রতীন, অতনু ,ইয়ম সিড ও হ্যারি গ্র্যান্ডপা কে নিজের করে পেয়েছি ,এবার তোমাকে ও। বাকরুদ্ধ আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বলি yes my child ..আমাদের দুজনের অন্তরের যত কোলাহল স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে ,কারো মুখে কথা নেই। পারভীনের কালো চোখের ঘন পাতা ভিজে নোনা জলের ধারা বইতে থাকে। সান্ত্বনা দেবার ভাষা খুঁজে পাই না। চারদিক ঘিরে আছে অসম্ভব নীরবতায়। শুধু গাড়ির চাকার যান্ত্রিক শব্দ উঠে বাতাসে মিলিয়ে যায় তাই বুঝি এমন পূর্ণ নীরবতা আরো সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে । পারভীন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম মার চোখের জল মোছাবো। খুব খারাপ লাগে ভাবতে মিষ্টার লুইস আর রাবেয়ার কিশোরী বেলার কত পুরোনো ভালবাসার সম্পর্ক ,পারিবারিক বন্ধনে জড়িয়ে চাওয়া পাওয়ার স্বার্থের টানাপোড়নে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। যখন ওরা শুধুই বন্ধু ছিল কোনো স্বার্থের সম্পর্ক ছিল না তখন ওদের কোনো expectation বা প্রত্যাশা ও ছিল না । ভাবছিলাম কত ছোট্ট বয়স থেকে কি বিশাল দুঃখের পাথরের বোঝা বুকের মাঝে নীরবে বয়ে নিয়ে জীবন তরীর প্রতিকূল দরিয়ায় চলন্ত দাঁড় বেঁয়ে চলেছে এই অসহায় সহজ সরল মেয়েটি। যদিও আমেরিকান সমাজে এমন ঘটনা খুবই স্বাভাবিক। ওরা ভারী মুক্তমনের বিহঙ্গের মত। আবেগ বা সেন্টিমেন্টের ধার ধারে না, কোনো সংস্কারের শিকলে তো আবদ্ধ নয়ই। তবে ব্যতিক্রম ঘটনা ও কিছু থাকে। বয়সের এতো তফাৎ থাকতে ও কেমন করে এই আজ কের যুগের ছেলে মেয়েদের সঙ্গে এমন নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছি নিজেই জানিনা। শুধু জানি বাৎসল্য স্নেহ প্রেম মায়া মমতা বন্ধুত্ব এই মানবিক সহজাত প্রবৃত্তি গুলো স্থান কাল পাত্র ,জাত পাত ,বয়স, গায়ের রঙ রূপ ইত্যাদি বিচার করে জীবনে আসেনা। আসে মানবিক উদারতায় ,বিবেকের ধর্মে।
৪৫মিনিট ব্রেকের নির্দ্ধারিত সময় শেষ হতেই দেখছি ওরা ফিরে আসছে। ব্রতীন বলে কী সুন্দর লেকটি দেখে এলাম তোমরা দেখতে গেলে না। যাইহোক এতদিন প্রকৃতির পথে ঘুরে আমরা প্রাকৃতিক আশ্চর্য্য দেখেছি ।এবার দেখবো মানুষের তৈরী অন্যতম আর এক আশ্চর্য্য সৃষ্টি ।পৃথিবীতে এমন কয়েকটি স্থান আছে যেখানে মধ্যাকর্ষণ শক্তি হার মেনে যায়। হুভার ড্যাম টি তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। প্রকৃতি প্রেমিক দর্শক আমেরিকায় বেড়াতে এসে হুভার বাঁধ দেখবেই। বাস্তবিকই এই বাধঁটি কে আধুনিক পৃথিবীর সাত টি ইঞ্জিনিয়ারিং আশ্চর্য্যের মধ্যে অন্যতম রূপে বানানো হয়েছে। গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন থেকে কাছেই প্রায় চার ঘন্টার দূরত্বে। আবার গাড়ির চাকায় ঝড় উঠেছে। স্প্রিংডেল রকভিল হ্যারিকেন হয়ে সেন্ট জর্জের দিকে চলেছি । এখান থেকে সাড়ে তিনঘন্টার মত লাগবে লাসভেগাসে পৌঁছতে , সেখানে থেকে ৩০ মাইল দূরে অত্যাশ্চর্য্য হুভার ড্যামটি দেখে লাস্যময়ী রাতের রানী লাসভেগাসে আমাদের রাত্রি যাপন ।
ইয়ম বলে এবার হুভার ড্যামের গল্প শোনানোর পালা আমার । পারভীন মিষ্টি হেসে ওকে উৎসাহ দিয়ে বলে যদি কিছু ভুল করিস আমি correct করবো। সাড়ে তিন ঘন্টা পার হয়ে যাবে গল্প শুনেই । অতনু সামনে থেকে মাথা ঘুরিয়ে বলে হবে না ইয়াম , তোর মাউথর্গান টা কে বাজাবে? ব্রতীন এক ধমকে ওকে চুপ করিয়ে বলে ইয়াম কে বিরক্ত করিস না , রাস্তা দেখ অতনু গুগুল ম্যাপের ওপর তোকেই নজর রাখতে হবে।
ইয়াম শুরু করেছে হুভার ড্যামের ওপর ওর সংগৃহিত তথ্য। ১৮০০সালের শেষ ভাগে এবং ১৯০০ সালের প্রথম দিকে উত্তর আমেরিকার দক্ষিণ পশ্চিমদিক দ্রুত বর্দ্ধিত ও প্রসারিত হতে থাকে। এই সব জায়গার বেশীরভাগ অংশ শুষ্ক মরু অঞ্চল হওয়ায় এবং নবনির্মিত শহরাঞ্চলের বসতি গুলোতে বিশেষ জলের ঘাটতি ,এমনকি পানীয় জলের অভাব দেখা দিয়েছিল। এই সময় কলোরাডো নদীর জল ছিল একমাত্র ভরসা। তাই আধুনিক সভ্যতা ক্রমশ সচেষ্ট হয়ে উঠেছিল এই লবনাক্ত নদীর জল কে নিয়ন্ত্রণে এনে যাতে ব্যবহারের উপযুক্ত করে মানুষের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের সুবিধা দেওয়া যায়।
বৈজ্ঞানিকরা সচেষ্ট হলেন এই জল কে শুদ্ধ মিঠে পানীয় জলে পরিণত করতে এবং তাকে পৌরসভার ব্যবহারিক কাজে ও কৃষি জমিতে বিভিন্ন সেচের কাজে উৎপাদনে লাগাতে। সেই ভাবনায় চলে নিরন্তর পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ।এ ছাড়া ও আরেকটি গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় ছিল নদীতে বন্যা এলে বিশাল ক্ষয়ক্ষতি, ভাঙ্গন ও ধ্বংস লেগেই থাকতো। আধুনিক বিজ্ঞান ভিত্তিক সভ্যতা সচেষ্ট হয়ে উঠলো তাকে বাঁধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষয় ক্ষতি ও ধ্বংসের থেকে নিরাপত্তা দিয়ে জীবন কে সুস্থ সুন্দর করে তুলতে।
ব্রতীন বলে you are absolutely correct ..ইয়াম। ..তবে বৈদ্যুতিক শক্তি সঞ্চালন উন্নত হওয়ার সাথে সাথেই কলোরাডো নদীকে জলবিদ্যুতের জন্য একটি সম্ভাব্য স্থান হিসাবে ও দেখা হয়েছিল।উৎসাহিত ইয়াম বলে, নেভাদা ও আরিজোনার সীমানায় কলোরাডো নদীর ব্ল্যাক ক্যানিয়ন অঞ্চলে স্থাপিত একটি কংক্রিট খিলানের ওপরে গড়ে উঠেছে হুভার বাঁধটি । নানান রিপোর্ট অনুযায়ী এই বাঁধের কাঠামো এমন একটি শক্তিশালী আপড্রাফ্ট সৃষ্টি করেছে যে যার ফলে এখানকার বায়ু সমস্ত কিছুকে নীচে পড়ে যেতে দেয়না। বরং ওপরের দিকে ভাসিয়ে রাখে । এই বাঁধের আকৃতি বাঁকা ধনুকের মত। যে কারণে বায়ু জলকে ও ধাক্কা দিয়ে ওপরের দিকে ছুঁড়ে দেয়। এমন কি এই স্থানে কিছু টস করা হলেও সেই বস্তুটি বাঁধের দেওয়ালের সমান্তরালে লেগে যায় এবং মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে সেটি নীচে না পড়ে উপরে উঠতে শুরু করে। এই বাঁধ মার্কিন সাম্রাজ্যের সর্ব বৃহৎ হাইড্রোইলেক্ট্রিক ইনস্টলেশন। দর্শকের ভীড় লেগেই থাকে অত্যাশ্চর্য্য বাঁধ টিকে দেখার জন্য।
চুপ করে থাকা অতনুর অভ্যাসে নেই ঘাড় ঘুরিয়ে জোরেই বলে , ইয়াম তোকে দশে ছয় দেবো ভেবেছিলাম যদি এই পয়েন্ট টা মিস করে যেতিস। এবার দশে দশ। ইয়াম চেঁচিয়ে ওঠে ,কেন রে পাগলা ? পারভীন হেসে বলে বুঝলি না ? আসলে অতনু যে নেট ঘেঁটে লেকচার টা আগেই মুখস্থ করেছিল। তোর জন্য ও যে মোটেই বলার সুযোগ পেলোনা। আমি অতনু ব্রতীন তিন জনেই জোরে হেসে উঠি। অনেক বিষন্ন পরিস্থিতি ,খারাপ লাগা মনের ভার সত্ত্বেও এক স্বাভাবিক সাচ্ছন্দ ময় তরল হাসির ছন্দ বইতে থাকে। আমরা এগিয়ে চলি মানব নির্মিত বিজ্ঞানের সেই অত্যাশ্চর্য্য সৃষ্টি র অদৃশ্য আমন্ত্রণে। ক্রমশঃ
0 Comments