জ্বলদর্চি

কালের অতল তলে কলোরাডো-১৮/চিত্রা ভট্টাচার্য্য

কালের অতল তলে কলোরাডো 
১৮ পর্ব 
চিত্রা ভট্টাচার্য্য 
     
মেঘ মেদুর ছায়াবৃত মনে বিনিদ্র রাতের অগুনিত প্রহর রাশি একে একে পার হয়ে পূবের আকাশে নব দিগন্তে আলোর আভাস দেখা দিলেও রাত জাগা ক্লান্ত ভেগাস গভীর ঘুমে অচেতন। অধীর আশায় অনিমেষে--দূরের রেডউডের বনের ঝাঁকড়া মাথার ফাঁকে শিশু সূর্যের কোমল পরশ -চেতনায় রেখা টেনে যায়।সমস্ত মলিনতা মুক্ত হয়ে এই পাপের নগরী যেন নব সূর্যের আলোক ধারায় পবিত্র স্নানে  সিক্ত হযে উঠলো। সারা রাত জেগে এক কঠোর জীবন সংগ্রামের করুণ পাণ্ডুলিপির পাতা উল্টে গেলাম। ঘুম জড়ানো গলায় মুন বারবার মোহাচ্ছন্নের মত বলেছিল ''ব লো -তো- --মণিমা ,আমি কি পাপ করছি ? বেঁচে থাকা বা বাঁচতে চাওয়া টা কি অন্যায় ? অসীমের অনন্ত কোলাহলে আলোকের স্বর্ণকমল মুদ্রিত আঁখি পল্লবের ওপর পরশ বুলিয়ে গেলো। 
  এ প্রশ্নের কি উত্তর দেবো ? পাপ পুণ্য ন্যায় অন্যায়ের বিচারক তো আমি নই।  ওকে কিছু বলার মত ভাষা আমার অভিধানে নেই। শুধু জানি মুনের এ লড়াই কঠিন জীবন যুদ্ধে হেরে না গিয়ে  মাথা তুলে জয়ের পতাকা বহন করে বাঁচার সংগ্রাম ।  
 বললাম তোর মুখের এই হাসিটা সব চেয়ে দামী। নিজের কাছে সৎ থেকে এগিয়ে যাওয়ার স্পর্দ্ধা ও  সাহস কে কুর্নিশ জানাই। সংসারের এমন পরিস্থিতি সহ্য করে যে মেয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারে  সে আমার চোখে অসাধারণ। পিছন ফিরে তাকানোর কিছু নেই ,বাচ্চা দুটোর যশোদা মা হয়েছিস। জীবন যেমন অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে আগামীতে দেবে ও অনেক কিছু। সেই অক্ষয় ধন কে আগলে রেখে এগিয়ে চল। এই পৃথিবীর জল হাওয়া ,ধুলো মাটি সবার জন্য। প্রত্যেকের নিজের মত করে বাঁচার অধিকার আছে।  কেনই বা পিছন ফিরে তাকাবি ? বন্ধন,ছিন্ন করে এগিয়ে অবশ্যই যেতে হবে। ঘুম ভাঙলে, ও বলে সারা রাত তোমার কাছে প্রলাপ বকে গেলাম ,এতো দিন মনের ভিতর চাপা যে অশান্তির বোঝা নিজের অন্তস্থলে বয়ে বেড়াচ্ছিলাম ,আজ সেই রুদ্ধ জানলার জম ধরা কবাট টা হ্যাঁচকা টান মেরে খুলে দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে বেশ হালকা লাগছে। '' রেস্তোরাঁ খুলতে হবে ,সকালের তাড়া আছে। ''নাইট কুইনে '' তোমাদের সবার ব্রেকফাস্টের নিমন্ত্রণ রইলো .সে  আর এক মিনিট ও দেরী না করে তড়িঘড়ি দৌড় লাগালো। আমাদের ও শুরু হলো ক্যালিফোর্নিয়া ফেরার প্রস্তুতি।  

ডায়েরির পাতা উল্টেদেখি লাসভেগাসের যে গল্প সেদিন বলতে  শুরু করেছিলাম তা অর্দ্ধ সমাপ্তই  রয়ে গিয়েছে। ভেগাস গড়ে ওঠার অনেক রোমাঞ্চ কর কাহিনী ,আমার সংগৃহিত স্মৃতির পাতা ভরে লেখা রয়েছে। যা সম্পূর্ণ বলা হয় নি--- এ বিলাসী  শহরের প্রতি পরতে পরতে যে রোমহর্ষক গল্প রয়েছে সে সব ধূলোমাটির তলে চাপা পড়া মলীন কাহিনী গুলো না লিখলে  লাস ভেগাসের গল্প সম্পূর্ণতা পাবে না।    আজ বসেছি ঝুড়ি উপুড় করে আমার  সঞ্চিত অভিজ্ঞতা দিয়ে এই আড়ম্বরে ভরা জাঁকজমক পূর্ণ নগরীর  ইতিকথা বলতে। 

  পাথুরে মরুঅঞ্চলে যে বিস্তীর্ণ শ্যামলিমার পাশে  স্নিগ্ধ নীলজলের হ্রদপাওয়া গেলো তার ই  ধারে ছোট ছোট তাঁবু বেঁধে দূর দেশ থেকে কাজের আশায় আসা খেটে খাওয়া শ্রমিকের দল সাধারণ বসতি গড়ে তোলা শুরু করেছিল। ওরা শহর গড়ে তোলার কাজের ফাঁকে দৈনন্দিন স্বাচ্ছন্দের জন্য চাষবাস শুরু করে। ক্রমশঃ ওদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় শস্য শ্যামলা ফসলে প্রানোচ্ছল প্রকৃতি।   মাঠ প্রান্তরের রুক্ষ জমি হরিয়ালিতে ভরে উঠেছিল ,ধূসর মরুর ধুধু উপত্যকা গুলো ফসলে পরিপূর্ণ ক্ষেতে হাওয়ার দোলায় মাঠ ভরা গম ভুট্টার সবুজ গাছ গুলো লকলকিয়ে বেড়ে উঠে শীষ সমেত মাথা নাড়ায়। কাঁচা ফসল পাকে সোনালী আলোয় ভরে ওঠে দিগ্দিগন্ত । ক্রমশঃ আশে পাশের থেকে আরো নতুন লোকজন এসে বসতি স্থাপন করে।  
🍂

এর আরো অনেক পরে, ১৯০৫সালে লস এঞ্জেলসে এবং সল্ট লেক সিটির মধ্যে রেল লাইন তৈরী হওয়ার সময় লাইনটি  লাস ভেগাসের ওপর দিয়েই দুই শহরের সংযোগ করে। তারপরই এখানে আরো মানুষের ভীড় বাড়তে থাকে নতুন বসতি গড়ে ওঠে । তারপর ১৯৩১ সালে,  নেভাদায় যখন কলোরাডো নদীর ওপর হুভার ড্যাম তৈরীর কাজ শুরু হয়েছিল তখন পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে নানা ধর্ম নানা ভাষা ও নানা  জাতের শ্রমিক শ্রেণী কাজের আশায় ঘনঘন  লাসভেগাসে আসতে ,শুরু করলে এই অঞ্চল ধীরে ধীরে শহরে পরিবর্তিত হতে থাকে। তারা ঘরবাড়ি নির্মাণ করে সংসার বেঁধে পাকাপাকি এই নতুন শহরের নিবাসী হয়ে ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখে। বাঁধ নির্মাণের বিশাল কাজ ও চলতে থাকে । সভ্যতার বিকাশে কালক্রমে লাস-ভেগাসে নগরায়ন শুরু হলে মাফিয়া রাজের দল কালো টাকা সাদা করার সুযোগ পেয়ে যায়। এবং ভেগাসে শহর আধুনিকী করণের  নির্মাণ প্রকল্পে বিভিন্ন খাতে তারা প্রচুর টাকা ব্যয় করতে শুরু করে ।   

 শহর উন্নতির বিভিন্ন প্রকল্পে প্রচুর অল্প বয়সী যুবকেরা কাজের সন্ধানে সংসার সমাজ আত্মীয় পরিজন ছেড়ে এখানে জমায়েত হতে শুরু করেছিল। তারা দিনভর হাড় ভাঙা পরিশ্রমের পর রাতে বিনোদন বিলাসিতায় উম্মুখ হয়ে উঠতো। বাঁধ এবং শহর তৈরির নির্মাণ সম্পূর্ণ হলে ও শহুরে নানা সুখ সুবিধার আয়োজন সম্পন্ন বিদ্যুতের যোগান হলে প্রচুর হোটেল মোটেল তৈরী হয়। এই সুযোগে মাফিয়াদের দল ঐ যুবক শ্রমিক দের সময় কাটানো ও  বিলাসিতার জন্য একের পর এক থিয়েটার সিনেমা হল ক্যাসিনো গড়ে তুলতে শুরু করে। ক্রমে সেই অভ্যাসের দাস হয়ে রাত জাগা শহর হয়ে ওঠে ভেগাস। এবং পর্যটক দের জন্য বড় আকর্ষণের জায়গায় পরিণত হয়। তখন কিন্তু শহরে জুয়া নিষিদ্ধ ছিল  । 

মুন বলেছিল জানো মণিমা , “what happens in Vegas, stays in Vegas”  শুধুমাত্র এই একটি লাইনের কারণে লক্ষ লক্ষ ভ্রমণ পিয়াসী মানুষ ছুটে এসেছে ‘সিন সিটি’ এই লাস ভেগাসে। এই স্লোগানটি আধুনিক পর্যটন ব্যবসায় অন্যতম বিখ্যাত একটি ট্যাগ লাইন,যেমন তেমনি হোটেল ,ফুডপ্লাজা ও রেস্তোরাঁর ব্যাবসাকে ও সমৃদ্ধ শালী করে তুলেছে। পর্যটক ও লাস ভেগাসের মধ্যে এই টানের প্রধান কারণ এই শহরের বাতাসে যে স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া যায় তা আর পৃথিবীর অন্য কোনো শহরে নেই।  । রাত জাগা শহর থেকে তাদের  দুই হাতের মুঠো ভরে লুটে নেয় অবাধ স্বাধীনতা। কড়া নিয়ম শৃঙ্খলের বন্ধনের  নাগপাশে হাঁপিয়ে উঠে সামাজিক মানুষ গুলো ক্ষণিক মুক্তির স্বাদ পাওয়ার জন্য, নিয়ম কানুন বহির্ভুত নতুন এক আশ্চর্য্য জীবনের হাত ছানিতে মরীয়া হয়ে ছুটে আসে উত্তাল সাগরের তীর ভাঙা ঢেউয়ের মত।  

সকালেই পারভীন ফোন করেছিল মায়ের পড়শী মিষ্টার গ্যারি আঙ্কেল কে।  রাবেয়ার  শারীরিক উন্নতির খবর বিশেষ কিছু পাওয়া যায়নি ,তবে আঙ্কেল সীমাই নিয়ে এসেছে লাস ভেগাসের ডাউন টাউনে। মিষ্টার গ্যারি একজন দক্ষ ট্রাক ড্রাইভার। মাল বোঝাই ট্রাক নিয়ে বিভিন্ন শহর থেকে শহরে ,রাজ্য থেকে রাজ্যে পাড়ি দেন। গ্যারি সাহেব সকাল দশ টায় আবার রওনা হবে ওদের  ভিলেজের দিকে। আমার মনে হল,এখন ও হাতে দেড় ঘন্টা সময় আছে ,পারভীন কে ডাউনটাউনে গ্যারি আঙ্কেলের কাছে পৌঁছে দিলে প্রায় তিন ঘন্টার বেশী পাহাড়ি রাস্তা ওকে মন খারাপ নিয়ে একাকী  ড্রাইভ করে লেক টা-হো ছাড়িয়ে  অত দূরের ভিলেজে যেতে হবে না। অতনু ,ইয়াম বলে That's really a very good idea ...প্ল্যান অনুযায়ী ব্রতীন গ্যারি আঙ্কেল কে ফোন করলে তিনি সাদরে রাজী হয়ে বলেন, এক  শর্ত আছে পারভীন লাঞ্চ অফার করবে তো ? পারভীন হেসে বলে ডিনার অফারে ও রাজী আছি। মুনের নাইট কুইন থেকে ব্রেড বাটার ওমলেট কফি ও স্ট্রবেরী জুস্ ইত্যাদি দিয়ে ব্রেকফাষ্ট পর্ব সেরে আমরা ডাউন টাউনের মিষ্টার গ্যারির উদ্দেশ্যে চললাম। এই মহাদেশে একটা ঘটনা আমার ভারী মজার  লাগে , প্রয়োজনে এখানে গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় তবে ড্রাইভ নিজের করতে হবে । ড্রাইভার নিলে খরচ অনেক বেশী পড়বে যা পারভীনের ওপর বাড়তি চাপের হবে। 
 
 গাড়ি চলছে। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে চুপচাপ বসে মুনের কথা ভাবছিলাম। পারভীনের আব্দার এ শহরের যত টা ইতিহাস নোটবই এ লিখেছো তাই বলো।'' আমি  নড়ে চড়ে বসি।  ইতিহাসের ঘটনা গুলো আমার মাথায় কিলবিল করে, তারই পর্যালোচনায় মননিবেশ করি। এই শহরের ইটের পাঁজরে লোহার খাঁচায় যে অতীত ইতিহাস মুদ্রিত রয়েছে তা ঘন আঁধারের কালো ছায়ার চাদরে মোড়া। এই শহরটি মূলত গড়ে উঠেছিল স্থানীয় গ্যাংস্টারদের হাত ধরে যারা সংঘবদ্ধ অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সেই সময়ে    আমেরিকার সীমিত কয়েকটি রাজ্যে জুয়া খেলা আইনত বৈধ ছিল,অবশ্যই নব নির্মিত ভেগাসে ছিল না। ১৯৩১ সালে কিন্তু স্থানীয় ব্যবসার জন্য জুয়া খুব লাভের হবে অনুমান করে এই শহরে জুয়া কে বৈধ করে দেওয়া হলো। এবং নর্দান ক্লাব কে প্রথম জুয়ার লাইসেন্স দেওয়া হয়।  সেই সময়ে এই শহরের জন সংখ্যা ক্রমশঃ বেড়ে দাঁড়ালো আনুমানিক প্রায় ৬ লক্ষ। যার ফলে স্থানীয় গ্যাংস্টারদের মাধ্যমে এখানে প্রচুর পরিমাণে ক্যাসিনো গড়ে উঠতে লাগলো। ১৯৬০ সালের মার্কিন ব্যবসায়ী হাওয়ার্ড হিউজ অনেক গুলো ক্যাসিনো ব্যবসা কিনে নেন। এরপর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীদের সহায়তায় গ্যাংস্টারদের এ শহর থেকে বিতাড়িত করা হয়। যা ছিল একদিন জনহীন মরুঅঞ্চল তা এখন ভীষণ ব্যস্ত, নব নির্মিত উজ্জ্বল ক্যাসিনো গুলো তার দু চোখের পাতার ঘুম কেড়ে নিলো ।  

      শহরটি নিজেকে বিলাস বহুল  ভোগের দুনিয়ায় একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন প্রধান অবসর বিনোদনের  রাজধানী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে তুলেছে। এবং এটি মেগা ক্যাসিনো-ও হোটেল সম্পর্কিত ক্রিয়াকলাপের জন্য ক্রমশঃ সেরা হয়ে নানাবিধ সম্মেলনের কাজ, বিশাল কোম্পানী গুলোর আমন্ত্রণ, নিমন্ত্রণ পার্টিতে মজে লাস ভেগাস এখন একমাত্র বিশেষ আনন্দ নগরী। এ শহরে সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত সূর্য সিঁদুরে রাঙা হয়ে গোধূলি আকাশে অস্ত গেলে ধীরে ধীরে  বিষণ্ণ সায়াহ্নের আঁধার ফিকে থেকে গাঢ় হয়ে গাঢ়তর হলে লাস ভেগাস তার উজ্জ্বল রঙ বাহারী আলোকিত রূপ নিয়ে জেগে ওঠে রাতের অতিথি কে বরণ করে নিতে। রাতের প্রহর এগিয়ে চলার সঙ্গে জুয়া শপিং বিলাসিতা নাচ গান মিউজিক খানা পিনা হৈ হুল্লোড় ও বাড়তে থাকে।  বিনোদনের উপত্যকা সামগ্রিক ভাবে নেভাদার শীর্ষস্থানীয় আর্থিক, বাণিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসাবে কাজ করে নেভাদাকে নিত্য দিন ঐশ্বর্য্য শালী করে তুলছে।  

      ইয়াম বলে এই আজব শহর এক মুক্তাঞ্চল।  যা ইচ্ছে তুমি করো ,যা খুশি সাজো ,ড্রেস পরো ,যা ইচ্ছে খাও, যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াও তোমায় কেউ করেনা মানা ,কেউ দেবেনা বাঁধা। পারভীন বলে, ইয়াম একটু ভুল হয়ে গেল। প্রাপ্ত বয়স্কদের বিনোদনের নানাবিধ সুযোগ ও উপায়ের ব্যবস্থা এই শহরে  থাকলেও ‘সিন সিটি’তে কিন্তু  সত্যিই পতিতা বৃত্তি অবৈধ। জনসম্মুখে মাতাল হওয়া বা মাতলামি করা যুক্তরাষ্ট্রের অনেক রাজ্যে এমন কি পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে অপরাধ      হিসেবে বিবেচিত হলেও নেভাদা র আইনে প্রকাশ্যে মদ্যপান করা বা মাতলামো  করে বেহেড হওয়া কোন দণ্ডনীয় অপরাধ নয়। আমি বিস্ময়ে বলি সে কি? এতো অসম্ভব ! সবাই ইচ্ছে মত যা খুশি তাই করলে অন্যায় বেড়ে যাবে। তাহলে কিভাবে শহরের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় থাকবে ? অতনু বলে ,মদ্যপান করে যদি কেউ অন্যের অসুবিধার সৃষ্টি করে বা মদ খেয়ে নেশা গ্রস্থ হয়ে গাড়ি চালায় বা জনসম্মুখে অসভ্য আচরণ করে অন্যের শান্তি বিনষ্ট করে ,কিংবা কোথাও বিনা অনুমতিতে অনুপ্রবেশ করে তাহলে সেগুলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। তখন নির্ঘাৎ বাছাধন কে জেলে যেতে হবে।                                                                                                    লাসভেগাসের ইন্টারেস্টিং গল্প জমে উঠতেই এসে পৌঁছলাম ডাউন টাউনে  মিষ্টার গ্যারির ঠিকানায়। গ্যারি সাহেব রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে ছিলেন , চিনতে একটুও অসুবিধা হলো না। আলাপ পরিচয় সারা হলো বেশ মিত্রতা গড়ে উঠলো। একেবারে জড়তা হীন এক সাধাসিধে মানুষ। কালো ,পেটানো চেহারা কোঁকড়া চুল অনেকটা ওয়েস্টইন্ডিজের পুরোনো দিনের ক্রিকেট প্লেয়ার ভিব রিচার্ডসের মত দেখতে। ঠিক মনে হবে তারই ভাই দাঁড়িয়ে আছে। পারভীন বলে আঙ্কেল এখানে তুমি কোথায় রাতে থাকলে ? আগের থেকে না ঠিক করলে এ শহরে যে তিল ধারণের ও ঠাঁই নাই। মিষ্টার গ্যারি বলেন এই বড় লোক দের বিলাসী শহরে হোটেল মোটেলের দামী ঘর আমাদের এই খেটে খাওয়া গরিব শ্রমিক শ্রেণীর জন্য নয়।  এই প্রাসাদ নগরীতেই লোক চক্ষুর আড়ালে আছে এক ভারী মজার জায়গা , চল তোমাদের সেই রাজপ্রাসাদের আস্তানায় নিয়ে যাই ।

             গ্যারি পাঁচ মিনিট হাঁটা পথেই নিয়ে এলেন ভেগাস নগরীর আন্ডার গ্রাউন্ডে এক আশ্চর্য্য জায়গায় । যেখানে লাস ভেগাসে স্থায়ী বাসিন্দাদের একটি বিশাল অংশ বাস করে। ব্রতীন বলে আমি স্ল্যাম এরিয়া --  জায়গাটার কথা অনেকের মুখে শুনেছি। এমন কি বিভিন্ন ক্রাইমের সিনেমায় ও দেখেছি। কিন্তু এ যে এমন কাছে হবে ভাবতে পারিনি। গ্যারি বলেন এই যে  নগরীর নীচে আন্ডারগ্রাউন্ডে যে ট্যানেল টির একটু অংশ দেখা যাচ্ছে তা ভাবতে পারো প্রায় ২০০ মাইল লম্বা।  যেখানে অসংখ্য নীচুতলার হা ঘরে মানুষের বসবাস। এই ট্যানেলে মূলত হোমলেস ,জবলেস থেকে শুরু করে দিন মজুর ,বা সামান্য মজুরির শ্রমিক শ্রেণী , সর্বস্ব খোয়ানো জুয়ারী, ভিক্ষুক এবং নেশাগ্রস্ত মানুষেরা বাস করে। এমন কি যুদ্ধ পরবর্তী ট্রমা কাটিয়ে উঠতে না পারা অনেক মানসিক অবসাদ গ্রস্থ অসুস্থ লোকও এখানে বাস করে।
         এ এক বিচিত্র পৃথিবী। গ্যারি ঘুরে ঘুরে  দেখালেন বিলাসী বিত্ত শালী সমৃদ্ধ নগরী ভেগাসের দিন রাতের বাতাসে ডলার ওড়ানোর অপর আর এক পিঠের মর্মবিদারক চিত্র। এক বিস্ময়কর ঘোর অন্ধকারের জীবন।  টানেলের ভিতর ঢুকে একটু কাছে গিয়ে উঁকি মারতেই দেখতে পেলাম তাদের সেখানে শোবার জন্য বেড রয়েছে , ওয়ারড্রব এমনকি বইয়ের তাক থাকলেও তাদের শূন্য পকেটে ডলারের অভাব যেমন প্রকট তেমনি প্রবল খাদ্য সঙ্কট ও তীব্র।প্রায়ই এদের বড়লোকের ফেলে দেওয়া  উচ্ছিষ্ট খেয়েই বেশীর ভাগের দিন কাটে।  প্রদীপের তলায় ঘোর অন্ধকারের মত লাগলো এই হত দরিদ্র মানুষের প্রাণ ধারণ করার বাস্তব চিত্র। প্রতিদিন লড়াই করে টিকে থাকার এক নির্মম জীবন যন্ত্রণার কঠোর দৃশ্য ধনী সমৃদ্ধ শালী ভেগাস শহর লোক চক্ষুর আড়াল করে তাকে লুকিয়ে রাখতে চায়। 

এই  টানেলের থেকে অনতিদূরে একটু বাঁয়ে মুড়ে সোজা হেঁটে চলেছি চোরা গলির মত রাস্তায়। ১৯ সালের প্রথম দিকে গড়ে ওঠা আমেরিকানদের পুরোনো ধাঁচের তৈরী ঘর স্বল্প মধ্যবিত্ত সাধারণ শহর রয়েছে,এখানে। গ্যারি সাহেব কে অনুসরণ করে পায়ে পায়ে হেটে এলাম একটি লম্বা মত কাঠের হল ঘর ,ডর্মিটরিতে। আট টি বেড পর পর পাতা আছে তার ই একটি বেড খুব সস্তায়  ভাড়া নিয়ে গ্যারি সাহেব প্রয়োজন মত দুতিন দিন সেখানে থেকে যায়। ভেগাসের চোখ ধাঁধানো চকচকে অংশটুকুর বাইরে এখানে ও রয়েছে একটি আটপৌরে গৃহস্থালির সাধারণ শহর। যেখানে স্থায়ী ভাবে বসবাস করার জন্য মানুষ আসে। ক্যাসিনো কিংবা হোটেলের রমরমা আড়ম্বরের পরিবর্তে তারা গড়ে তোলে স্থায়ী বসতি গির্জা, শপিং সেন্টার নিয়ে খুব সাধারণ ,সহজ সরল সংসার।    

  পারভীন ইয়াম কে অতনু বোঝায় বর্তমান পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই শহরের অবিশ্বাস্য অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে  কিছু গভীর সমস্যা ও গলদ কত বেশী পরিষ্কার চোখে পরে। পুরো দেশের মধ্যে ব্যক্তিগত ও সম্পত্তিগত অপরাধ, আত্মহত্যার হার ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি,প্রাপ্ত হচ্ছে । মদ্যপান এবং বেআইনি মাদকদ্রব্য ব্যবহারের দিক থেকে লাস ভেগাস সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে। আর জুয়া খেলায় তো এদের জুড়ি পৃথিবীর আর কোনো দেশ নয়। আলোচনা এমন করে চলতে থাকলে আমি প্রমাদ গুন লাম। গ্যারি সাহেব এবার পারভীন কে ফেলেই তার ট্রাক নিয়ে গ্রামে ফিরে যাবেন।এমনিতেই আধ ঘন্টা লেট হয়ে গিয়েছে। পারভীন কে একরকম জোর করেই ট্রাকে তুলেদিলাম।  ব্রতীন ওদের তিন জনের মিলিত সংগ্রহের একটি খাম আমার হাতে দিলে আমার ও পথে খরচ না হওয়া কিছু অতিরিক্ত ডলার সব মিলিয়ে হাজার দুইয়ের মত সাদা খাম টি জোর করেই পারভীনের পিঠের ব্যাগে ভরে দিলাম। বললাম রাবেয়া কে সুস্থ করে তুলতে হবে। এটা বন্ধু দের ভালবাসা ,আমার আশীর্বাদ। কোনো আপত্তি শুনবো না। পারভীনের চোখ থেকে গরম তরল অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। ও রুমাল দিয়ে চোখ ঢেকে বলে কে বলে আমার কেউ নেই এ পৃথিবীতে ? কে বলে আমি একা ?  

মিষ্টার গ্যারির স্টীল কালারের  ১৮ চাকার সীমাই তার বিরাট দেহটি নিয়ে হাইওয়ের ওপর উঠে গিয়ে স্পীড বাড়িয়ে দিলো। অজগর সাপের চকচকে কালো পিঠের মত হাইওয়ের রাস্তায় সীমাই শোরগোল তুলে দূরে বিন্দুর মত মিলিয়ে যাচ্ছে , আমরা ও ট্যাকোমায় উঠে বসলে  ব্রতীন গাড়ি স্টার্ট দিল। এখন পেছনের সীট টি তে অনেক টা জায়গা। বড়ো ফাঁকা লাগছে মাঝখানে যে পারভীন নেই। উম্মুক্ত জীবন তরীর চলন্ত নাও খনিতে ভেসে অনাগত ভাবীকাল মধুময় হয়ে ওঠার আশা নিয়ে পথ প্রান্তরের ধূলি মেখে আবার আমাদের যাত্রা কালের যাত্রা শুরু হলো --প্রকৃতির রাজপাটে অসীমের আনন্দ ধারায় গা ভাসিয়ে দিলাম।                                                                                                                               ক্রমশঃ

Post a Comment

0 Comments