জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প—তিব্বত (এশিয়া)ব্যাঙ বাবাজীর বদ বুদ্ধি /চিন্ময় দাশ

চিত্র- শুভম দাস 

দূরদেশের লোকগল্প—তিব্বত (এশিয়া)
ব্যাঙ বাবাজীর বদ বুদ্ধি
চিন্ময় দাশ 

পাইন শক্ত সমর্থ হলে, দুর্বল লতাও আকাশ ছুঁতে পারে। —তিব্বতী প্রবাদ।

অনেক কাল আগের কথা। পৃথিবীর তখন তরুণ বয়স। জীব জন্তুরা নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করতে পারত। সেসময় একদিন এক বাঘ বেরিয়েছে তার ডেরা থেকে। বেশ বয়স হয়েছে বাঘটার। একটা পাহাড়ী নদীর পাশ দিয়ে হেলেদুলে চলেছে বাঘ।
একটা ব্যাঙ ছিল নদীর জলে। সে বাঘকে দেখতে পেয়ে গেল। এতটুকু একটা পুঁচকে জীব। বাঘ চোখে পড়তেই, ভয়ে বুক কেঁপে উঠল বেচারার। বাঁচবার জন্য, ঝটপট একটা গাছের ডালে চড়ে বসল ব্যাঙ। 
যেই না বাঘটা কাছাকাছি এসেছে, ব্যাঙ ভাবল, গাছে তো চড়ে বসেছি, আর ভয় কিসের? বাঘের সাথে একটু মস্করা করা যাক। বলল—পেন্নাম হই, রাজামশাই! সকাল সকাল কোথায় চললেন? 
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বাঘ। এদিক ওদিক চেয়েও, কাউকে চোখে পড়ল না। কথার উত্তর দিয়ে, বলল—পুরো দু’দিন বেরোইনি। পেট চুঁইচুঁই করছে। শিকারে বেরিয়েছি তাই। কিন্তু তুই কে?
ব্যাঙ গলা তুলে, দেমাকের সুরে বলল—আমাকে চেনেন না? আমি হলাম ব্যাঙেদের রাজা।
বাঘ একটু হেসে বলল—বেশ ভালোই হোল। বেরিয়ে আয়। সকালের জলখাবারটা তোকে দিয়েই শুরু করা যাক।
ভয় পেতে বয়েই গেছে ব্যাঙের। সে বলল-- খাবো বললেই তো আর খাওয়া যায় না। তাছাড়া, কে কাকে খাবে, সেটা তো পরে যাবে। তার আগে একটা পরীক্ষা হয়ে যাক। 
বাঘ একটু থমকে গেল। বলল-- বলছিসটা কী, হতভাগা? বনের রাজা পরীক্ষা দেবে একটা ব্যাঙের সাথে?  
ব্যাঙ দেমাক দেখিয়ে বলল—রাজার সাথে রাজার পরীক্ষা। আপত্তি কেন তাতে? হলামই বা ছোট। একজন রাজা তো! দুই রাজার কার কতো হিম্মত, পরখ করে দেখা যাক। তার পরে তো খাওয়ার কথা। 
বাঘের আঁতে লাগল কথাটা। এদিকে শিকারে যেতেও দেরী হয়ে যাচ্ছে। এখানে আটকে থাকলে পেট ভরবে না। বলল—শুনি তো, কী তোর পরীক্ষা। 
ব্যাঙ বলল—এই তো রাজার মতো কথা। ঠিক আছে, প্রথম পরীক্ষা হোক, এই নদীটা পারাপার। এক লাফে এই নদীটা পার হতে হবে। রাজী?
ব্যাঙ এক লাফে নদী পার হবে? হাসিতে পেট গুড়গুড় করে উঠল বাঘের। বলল—রাজী।  
ব্যাঙ বলল-- আপনি হলেন বড়। আগে আপনি লাফ দিন।
বাঘ বলল-- এই কথা। হয়ে যাক পরীক্ষা। 
 ব্যাঙের মনে হোল, এই মওকা। বাঘ লাফিয়ে ওপারে নামবে গিয়ে। সেই সুযোগে আমিও কেটে পড়ব। হাজার খুঁজেও পাবে না আর আমাকে। কিন্তু সাথে সাথেই তার মনে হোল- না। পালিয়ে যাওয়া বুদ্ধিমানের কথা নয়। বরং একটু কেরামতি দেখানো যাক রাজাকে। 
বাঘ লাফ দিতে তৈরি হয়েছে। ব্যাঙ করল কী, টুক করে লাফিয়ে নেমে পড়ল গাছ থেকে। বাঘের লেজের ডগা কামড়ে বসে রইল চুপটি করে। লম্বা এক লাফ দিল বাঘ। সোজা গিয়ে পড়ল নদীর ওপারে গিয়ে। আর, তার লেজের ঝাপটায়, ব্যাঙটা গিয়ে পড়ল আরও অনেকটা দূরে। 
বাঘ তো আর ব্যাঙের চাতুরির কথা জানে না। সে গলা তুলে হাঁক দিল—এবার তুই লাফিয়ে আয় দেখি। 
পেছন থেকে ব্যাঙ বলল—কাকে হাঁক পাড়ছেন, রাজামশাই? আমিও এপারেই। বরং একটু বেশিই লাফিয়েছি আপনার চেয়ে। এই দেখুন, আপনার পেছনেই এসে পড়েছি আমি। 
ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল বাঘ। মুখে কথা সরছে না তার। ব্যাঙ বলল—তাহলে প্রথম পরীক্ষায় আমিই জিতেছি। এবার শেষ পরীক্ষাটা হয়ে যাক। 
বাঘ বলল—কী পরীক্ষা শুনি। 
ব্যাঙ বলল—আসুন, দুজনে বমি করব এবার। দেখা যাক, কার পেটে কোন খাবার আছে? 
সত্যি সত্যি দু’দিন কিছুই পড়েনি বাঘের পেটে। অনেক চেষ্টার পর, এক্টুখানি তরল জল ছাড়া, কিছুই বেরুল না বাঘের পেট থেকে। তা দেখে, ব্যাঙ তো হেসেই আকুল। ব্যাঙ্গ করে বলল-- এইমাত্র?
বাঘ গরগর করে বলল—তুই দেখা। 
সামান্য একটু হিক্কা মতো তুলল ব্যাঙ। কয়েক টুকরো লোম বেরিয়ে এলো গলা থেকে। 
ভুরু কুঁচকে বাঘ বলল—কী এগুলো? 
--চিনতে পারছেন না? ব্যাঙ বলল—কাল একটা আস্ত বাঘ খেয়েছিলাম যে। এই লোম কটাই যা হজম  হয়নি এখনও। পেটে রয়ে গেছল।
কানে শুনে আর নিজের চোখে দেখে, বাঘের তো আক্কেল গুড়ুম। ভয়ে বুক ঢিপঢিপ। অনেক ক্ষমতা তো এই পুঁচকেটার। লাফ দিয়েছে আমার চেয়ে লম্বা। আস্ত একটা বাঘ খেয়েছে গতকাল। নিশ্চয় এ ব্যাটা আমাকেও গিলে খাবে এবার। এখান থেকে সরে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
  আর কোন কথা নয়। উলটো মুখে ঘুরে, লম্বা এক লাফ। তারপর দৌড় দৌড়। ব্যাঙের সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচল বাঘ।
ছুটতে ছুটতে একটা পাহাড়ের তলায় এসে থেমেছে বাঘ। সেখানে দেখে, একটা শেয়াল নামছে উপর থেকে।
শেয়াল বলল—হোলটা কী আপনার? এতো হাঁফাচ্ছেন কেন, রাজামশাই? 
--আর বোল না, পণ্ডিত। বাঘ বলল—বড় জোর বেঁচে গেছি বরাত জোরে। ভাগ্যিস সময় মতো পালাবার মতলবটা মাথায় এসে গিয়েছিল। নইলে আজ বেঘোরে মারা পড়তে হোত। 
শেয়ালের তো মাথায় কিছু ঢুকছে না। বনের রাজাকে পালিয়ে বাঁচতে হয়েছে? ব্যাপারটা কী? জানতে চাইল—ব্যাপারটা ঠিক কী, খুলে বলুন তো দেখি।
একটু দম নিয়ে, বাঘ বলল—সকালে বেরিয়েই ব্যাঙেদের রাজার সাথে দেখা। পরীক্ষা দিয়ে দেখাল, সে আমার চেয়ে লম্বা লাফ দিতে পারে। আস্ত একটা বাঘ গিলে খেয়েছে গতকাল, তার প্রমাণ পেলাম। কোন রকমে পালিয়ে আসতে পেরেছি।
শেয়াল বলল—কী যে বলেন, রাজামশাই। আমি আপনার চেয়ে কতো ছোট এক জীব। আমিও পায়ের তলায় চেপে মারতে পারি ব্যাঙটাকে। আর আপনি কি না, ভয় পেয়ে পালিয়ে এলেন! ঠিক আছে, চলুন তো আমার সাথে। দেখি, কত বড়ো রাজা সে হতভাগা। 
বাঘ বলল- তুমি পণ্ডিত হতে পারো, কিন্তু কত বড়ো ধুরন্ধর, সেটাও আমি জানি। আমাকে নিয়ে যাবে। আর বিপদ বুঝলেই আগে নিজে পালাবে। 
শেয়াল বলল—কী যে বলেন না আপনি, তার ঠিক নাই।
--ওটি হচ্ছে না, পণ্ডিত। তুমি কতো বড় ধুরন্ধর, সে তো আমি জানি। ওটাও জানি, বিপদ বুঝলে, তুমিই সরে পড়বে আগে। যেতে হলে, চলো। তুমি সামনে, আমি থাকব তোমার পিছুপিছু। বাঘ বলল-- তাছাড়া, আলাদা আলাদাও যাব না। একসাথে বেঁধে বেঁধে যাবো। এসো, দুজনে লেজে বাঁধাবাঁধি করে নিই আগে।   
বাঘের লেজের সাথে শেয়ালের লেজ বাঁধা হোল। শেয়াল পণ্ডিত সামনে, পেছনে বনের রাজা বাঘ। 
নদীর পাড়ে বসে আছে ব্যাঙ। রোদ পোয়াচ্ছে মনের আনন্দে। চোখে পড়ে গেল, বাঘ আবার ফিরে এসেছে। সাথে একটা শেয়াল। 
একটু ভড়কে গেল বেচারা। এবার বুঝি আর চালাকি চলবে না। শেয়েল অতি বুদ্ধিমান। তাছাড়া দুজনের চোখকে ফাঁকি দেওয়া সোজা কথা হবে না। তার চেয়ে, মানে মানে নদীতে নেমে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। 
তখনই মজার ব্যাপারটাও চোখে পড়ে গেল ব্যাঙের। রাজা আর পণ্ডিত—দুজনের লেজ গিঁট দিয়ে বাঁধা। ভয়াণক হাসি পেল ব্যাঙের। গিঁট দিয়ে লেজ বেঁধে এসেছে, মানে রাজার মনে ভয় আছে এখনও। 
ব্যাঙের মাথায় দুষ্টুমি চেপে বসল আবার। যেই না কাছাকাছি হয়েছে দু’জনে, ব্যাঙ খেঁকিয়ে উঠল—কী রকম আক্কেল তোমার, পণ্ডিত? বলেছিলাম না, বাঘ খেয়ে খেয়ে মুখ ধরে গেছে আমার। একটা নেকড়ে বা সিংহ ধরে আনতে। কথাটা ঢোকেনি মগজে? একটা বুড়ো বাঘকে বেঁধে এনেছ। দেখাচ্ছি মজা। দুটোকেই খাবো আজ। এসো এদিকে।
আর যায় কোথায়? শেয়ালের বলবার  বা ভাববার কোন সুযোগই হোল না। বিশাল এক লাফে ছুটতে শুরু করল বাঘরাজ। শেয়াল তো ছিল লেজে বাঁধা। সেও টানা হয়ে চলল হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে। প্রথমে ছাল-চামড়া উঠতে শুরু হোল। হাড়গোড় ভাঙতে লাগল তারপর। বাঘের থামবার কোন লক্ষণই নাই। 
কেবল শেয়ালের পরিত্রাহী চিৎকারটাই ভেসে আসতে লাগল বাতাসে। রাজামশাই কোথায় গিয়ে থেমেছিলেন, বা পণ্ডিতমশাই তার আগেই অক্কা পেয়ে গিয়েছিলেন কি না, ব্যাঙ বাবাজী জানতে পারেনি। 
আমরাও নিতে পারিনি সে খবর।
🍂

Post a Comment

0 Comments