জ্বলদর্চি

লোকমাতা রানি রাসমণি —১৫ /সুমিত্রা ঘোষ

লোকমাতা রানি রাসমণি —১৫
সুমিত্রা ঘোষ

জানবাজারের বাড়িতে অনেক প্রকার উৎসব অনুষ্ঠিত হত যেমন দোল, রাস ইত্যাদি। সব উৎসবের কেন্দ্রে ছিলেন জানবাজারের জমিদারবাড়ির গৃহদেবতা রঘুনাথ জীউ। এঁকে ঘিরে উৎসব আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীরা দল বেঁধে আসতেন। উৎসবে একটা বিশেষ অঙ্গ ছিল ব্রাহ্মণ ভোজন। কোনপ্রকারে কয়েকজন ব্রাক্ষ্মণকে কিছু খাইয়ে দেওয়া নয়, সে ছিল এক বিশাল ব্যাপার। যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে ব্রাহ্মণদের ভোজন করিয়ে তৎসহ দক্ষিণা দেওয়া হত। রানি লোকজনের মাধ্যমে সব সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতেন।
দোল, রাস উৎসব ছাড়া জানবাজারের জমিদার বাড়িতে দুর্গোৎসব, বাসন্তী পুজো, লক্ষ্মীপুজো, সরস্বতী পুজো এবং কার্তিক পুজোর অনুষ্ঠানও হত। একবার দুর্গাপুজো উপলক্ষে জমিদার বাড়িতে একটা অভাবনীয় ঘটনা দেখল জানবাজারের মানুষরা। রানি রাসমণি প্রতিদিন পালকি করে দাসীদের সঙ্গে গঙ্গাস্নানে যেতেন। লোকেরা জানতেও পারত না। কারন রানি ভোরবেলায় নিঃশব্দে নিত্য গঙ্গাস্নান করে আসতেন। রোজকার জীবনে ছন্দপতন ঘটল একবার দুর্গাপুজোর নবপত্রিকা স্নানের জন্য গঙ্গা ঘাটে যাওয়ার সময়। নবপত্রিকা স্নান করাতে নিয়ে যাওয়ার সময় ঢাক-ঢোল-কাঁসর এসবের আওয়াজ হত এখনও যেমন হয়। একবার পুরোহিতগণ নবপত্রিকা নিয়ে গঙ্গাঘাটে চলেছেন বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহযোগে। সেইসময় এদেশে বিদেশী শাসন ছিল এবং সাহেবগণ ইচ্ছেমত কুঠি নির্মাণ করে মনের সুখে বসবাস করতেন। রাজচন্দ্র দাস জীবিত কালে বাবুঘাট এবং বাবুরোড নামক রাস্তা তৈরি করিয়েছিলেন। বাবুরোডের পাশে এক কুটির ছিল যেখানে সাহেব থাকতেন। নবপত্রিকা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গঙ্গারঘাটে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে তাতে কুটির সাহেবের ঘুমের ব্যাঘাত হয়েছে।
🍂
তিনি রাগান্বিত হয়ে পুলিশ দিয়ে বাজনা বন্ধ করে দিলেন। ঢাক, ঢোলের শব্দে আকাশ বাতাস মুখরিত হচ্ছিল। পুলিশ ঢাক-ঢোল বাজানোর উপর বিধিনিষেধ  আরোপ করেছে এ খবর রানির কানে পৌঁছানো মাত্রই রানি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে কালক্ষেপ করেননি। পরের দিন রানি আরও ঢাকি জোগাড় করে শব্দের মাত্রা আরও বাড়িয়ে গঙ্গার দিকে একটি সমারোহ পাঠালেন। এভাবে দুর্গাপুজো শেষ হল। এর পর রানির কাছে চিঠি এল - সরকারের আদেশ, ভবিষ্যতে ওইপথে এমন উৎপাত  যেন না হয়। কারণ ঐ পথে কুটির সাহেবের ঘর আছে । রাসমণি মামলা করলেন। মামলায় রানির হার হল । রানিকে জরিমানা বাবদ  ৫০/- কোম্পানীকে দিতে হল। জরিমানা দিয়ে রানি পিছিয়ে আসেননি। তিনি গরানকাঠের বেড়া দিয়ে জানবাজার থেকে বাবুঘাট পর্যন্ত পুরো রাস্তাটা বন্ধ করে দিলেন। এবার সাহেরের লোকজন আর ঐ রাস্তায় যাতায়াত করতে না পারায় খুবই অসুবিধার সম্মুখীন হল। সেকারণে রাস্তা বন্ধ করার জন্য সরকার পক্ষ থেকে রানির কাছে চিঠি পাঠানো হল যাতে করে রানি সর্বসাধারণের জন্য রাস্তা খুলে দেন। রানি সরকার পক্ষকে জানিয়ে দিলেন ঐ জমি জানবাজার জমিদারীর খাস জমি। তাই তিনি নিজের ইচ্ছানুসারে ব্যবস্থা নিতে পারেন এবং নিয়েছেনও। ইংরেজ সরকার মহাসমস্যায় পড়লেন। রাস্তা বন্ধ থাকলে সরকারপক্ষের লোকেরা ঐ পথে যাতায়াত করতে পারবে না। তখন সরকার পক্ষ নরম মনোভাব নিয়ে রানির কাছে অনুরোধ রাখলেন রানি যেন রাস্তা খুলে দেন এবং জরিমানা বাবদ যে পঞ্চাশ টাকা রানির কাছ থেকে সরকার নিয়েছিল তাও সম্মানের সঙ্গে ফেরৎ দিল রানিকে। এমন কোমলে কঠোরে তৈরি রানি রাসমণি। যখন যেমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তখন সেইভাবে নিজেকে তৈরি করে পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন রানি।
ক্রমশ
 

Post a Comment

0 Comments