বাগদি চরিত ( সপ্তবিংশতি পর্ব )
শ্রীজিৎ জানা
লোখার বাপের হাতে বানানো তিলাডোঙা। পাকা তালগাছকে খন্তা আর বাইশ দিয়ে কুঁদে তৈরী করেছিল। প্রথমে একুটা ডোঙা ছিল,পরে জোড়া ডোঙা করে। বেশি স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া ডোঙার কম্ম নয়। মিহি স্রোত অথবা স্থির জল হলে তীরের বেগে ছুটতে পারে এই জলযান। বানবন্যা বাদে পুকুরে ডোবানো থাকে। লোখা সেই ডোঙার ফালি করা পেটে এক বজা কঞ্ছা পুরে দেয়। জলে ডুবে থাকা অবস্থায় মাছেরা সেই ডোঙার পেটে কঞ্ছার ঝাড়ের নীচে আস্তানা বানায়। আর মাঝে মধ্যেই লোখা তার বাপের সঙ্গে ডোঙাকে টেনে আড়ার দিকে আনে। লোখার বাপ নাগাড়ে চিল্লাচিল্লি শুরে করে,
— ওরে উদমাকাড়া একাশি কন্না পেটটা,জলটা হেলকে বেরি যাও। তবে ত হাঁড়াটা হাল্কা হবে। কুনু মুরাদ নাই তোর। কী করে খাবি কে জানে! আমার ত ছ'বজা কাঠ এগি গেছে,তাবাদে দাদারা যেদিন মুখে লাত মেরে তাড়ি দিবেনি,সেদিন বুজবি।
— তুমি গল বোকনি দেখি! এই ত হেলায়ঠি। বেশি হেলি দিলে মাছ গুলান ত লাফি পালি যাবে!
— অম্নি পালি যায়ঠে! ঝিটকানি কঞ্ছা গুলান কি মুক দেকতে দিচু। তুই আগে হেলিয়ে জল ফেলা দিখি
লোখা আর তর্ক করে না। বাপের কথামত চলে। ডোঙার পেট থেকে জল ফেলিয়ে কঞ্ছার বজার ভিতর হাত ঢোকায়। তারপর প্যাকাল,শোল, গোড়ই,ফোলই মাছ ধরে। কঞ্ছার গায়ে গেঁড়ি গুলানকে ছাড়ায়। কঞ্ছার বজা ভিতর থেকে কাঁকড়া ধরে হাঁড়িতে রাখে। সেদিন দুপুরে লোখাদের ভাতের থালার পাশে বহুধরনের রান্না জড়ো হয়। গেঁড়ি চচ্চড়ি,কাঁকড়ার টক আর গোড়ই কিম্বা শোলের সরষা দিযে গদগদে বাটনা। সব বেটা আর বাপ মিলে সেদিন হাঁড়ির ভাত কাবার করে দেয়। বাপ-বেটাদের অমন খেটনের ধাত লোখার মায়ের জানা আছে বলেই সেদিন হাঁড়িতে এক ছটাক চাল সবদিনের চেয়ে বেশিই নিয়ে রাখে।
বাপের পরে লোখার হাতেই তাদের জোড়াডোঙা বেশি বশে থাকে। বন্যার জলে ওই ডোঙায় করেই গোটা কালসাবা,বামুনকুড়,কলাইকুড় লোখা একাই বেয়ে বেড়ায়। মাঠের মাঝখানকে জাল আড়তে যায়। হালুক,পাঙ,ঝ্যাপা বসাতে যায়। বাজার থেকে খাওয়ার জল বয়ে আনে। চেতলা বাজারের ওদিক থেকে গরুর জন্যে ঘাসপাতা ছিঁড়ে আনে। কোচনির ঝাগলের জন্য কাঁঠাল পাতার ডাল কেটে এনে দেয়। ভজা দিগারের ভেলা করার জন্যে কলাগাছ আনতে লোখার এই ডোঙাই একমাত্র ভরসা। তারপরে পাড়া বাখুলের লোকজন ত বইতেই হয় তাকে। অঞ্চল থেকে বন্যার সময় নৌকা দিলেও তার টাইম বাঁধা থাকে। অসুখবিসুখ না হলে,খুব এমারজেন্সি না পড়লে নৌকা পাওয়ার কোন আশা নাই। সেই সময় কলর ভেলা আর ডোঙাই ঢোলের একমাত্র আপদবিপদের বন্ধু। তবে যাদের নিজেদের পানসি আছে তাদের চিন্তা থাকেনা। অনেকে ভেলা তৈরী করে। চেতা পার থেকে বিচাকলার গাছ কেটে আনে। এক দুজন ভেলায় নিশ্চিন্তে চাপা যায়। জলের হাঁড়ি কলসি এমনকি বাচ্চা সহ ছাগল চাপিয়ে দিব্যি যাতাযাত হয়। বনবন্যার কালে এই জলযান গুলোই ঢোলের মানুষজনদের বেশি ভরসার।
এদিকে ডোঙা থেকে মাধু তো নেমে গেল। কিন্তু লোখার কানে যে কথা রেখে গেল তাকে লোখা ফেলতে পারবে না সহজে। পেটা জোঁকের মতো কামড়ে বসে থাকবে তার মাথায়। দিনমান ভাববে মাধুর কথাটার গভীরতা নিয়ে। ডোঙা বেয়ে ঘুরে বেড়াবে চারদিক। আনমনে কখন ভুলে যাবে লগি বাওয়া। কিন্তু এত ভাবনার মধ্যেও একবার ডাক এলেই,আপদবিপদের সাড়া পেলেই লোখা ডোঙা নিয়ে হাজির হবে তুরিদ্দম। তখন তার নৌকা যেন চাঁদ বেনের সপ্তডিঙা মধুকর। অথবা বানের রাতে মোসলেম ডাকাতের দুরন্ত পানসি। চোখের পলকে জল কেটে যেই জলযান নিমিষে নাগালের বাইরে চলে যায়। লোখা ডোঙা ঘুরিয়ে আবার সুবল পিয়নের ভিটার দিকে বাইতে থাকে। একা একা বিড়বিড় করা অভ্যাস আছে লোখার। লগি ঠেলে আর বিড়বিড় করে বকতে থাকে।
—ই ত সেই মাধু মেইছেনা নয় এগবারে। ভগী খুড়া মিছা কথা বলেনি, মেইয়া মানুষকে বুজা খুম মুশকিল! এদের বাইরে এক মুত্তি,ভিতরে এক মুত্তি! অকে এতদিন শালা খারাবই ভেবছিলম। কুন্তু এখন বুজলম উ খগেনকে কত ভালবাসে। মা মরা মেইছেনা,সতল মায়ের কাছে মানুষ,তার উবরে ওই রকম খান্ডাতি মা,কি আর করবে উ।
কথা বলতে বলতে পিয়নের ভিটার কাছে এসে পড়ে ডোঙা। লোখা একটা জোরে হাঁক দেয়-
— কুথা গেলে গো? যাবে যে? জল বাড়েঠে মিসমিস করে। গতিক ভালো নয়। খরখর এসো দিখি।
পিয়নের বউকে লোখা সহ্য করতে পারে না। লোখার গলায় বিরক্তি প্রকাশ পায়। পিয়নের বউ এক বোচকা জিনিস নিয়ে ডোঙায় উঠে পড়ে। শহরে বহুদিন ছিল পিয়নের বউ। লোখা সেকথা জানে। লোখার সম্পর্কে ঠাকুমা হবে পিয়ন গিন্নী। লোখা রসকতা করতে ছাড়ে না,
— অত তিড়বিড় কোরনি জলে লেউঠে যাবে থাইলে। সাঁতার জান নাকি ভুলে গেছ! বাগদিদের ছেনামেইছেনা যেদি না সাঁতার জানে থাইলে ত জাতের নাম ডুবিই দিল। তা ঠাগমা জান ত গ?
— সব সাঁতারই জানি। ডুব সাঁতারও জানি,চিৎ সাঁতারও জানি। আমার বাপের ঘরও নদীর ধারে। বন্যাকে আমার ভয় নেই। তুমি এখন ডোঙা চালাও দেখি।
— তা ত ডঙা বাইয়ে তমাকে ঠিক লিয়ে চলে যাব। তবে তুমি বেশি হেলাদুলা করনি।
— ঠিক আছে। জানি আমি ডঙায় কেমন করে বোসতে হয়।
লোখার মুখ কুটকুট করে। মনের ভিতরে মাসকাটা পিঁপড়ার মতো বদ চিন্তা কামড়ায়।
— মোর ডঙা তলি যায় যাউ,মনে হয়ঠে এগবার হেলকিয়ে ডঙাটাকে পাল্টি খাই দেই। ঠাগমা হউ আর যেই হউ,উ শালা খান্ডাতি মেইয়ার নাম লুকি দিলে তবে মোর মাথা থিকে রক্ত নামবে। বেল্লিকা মেইয়া নিজে লোকের সঙে স্যাঙা করেঠে,আর অন্য কেউ পেম ভালবাসা কল্লেই অর যেন ঝাটি লঙ্কার জ্বালা ধরে যাইঠে!
মনের ভাবনা মনের তলায় পড়ে থাকে। ডোঙা এসে থামে ভিটায়। গাছের সঙে ডোঙাটাকে বেঁধে লোখা পিয়নের বউয়ের পিছন পিছন ঘরের দিকে যায়।
দুপুর পেরোতে না পেরোতেই বন্যার চেহারা পাল্টে যায়। জল গরম কড়ায় দুধ উতরে ওঠার মতো ফুলতে থাকে। ঢোলের সবার চোখেমুখে এতক্ষণে একটা ভয়ের চিহ্ন ফুটে ওঠে। অনেকেই বাজারের হাইস্কুলে চলে গেছে আগেই। প্রতি বছর বন্যার সময় সেখানেই ত্রাণ শিবির খোলা হয়। অঞ্চল থেকে নৌকা দেওয়া হয়েছে। সব্বেশ্বরের সব নৌকাই এখন অঞ্চলের হয়ে লোকজন পারাপার করছে। ভূতা কটালের চিন্তার শেষ নেই। গত বছরে অনেক খেটেখুটে ঝিটাবেড়ার ঘরখানা সে দাঁড় করেছে। মদন কারফারের গোয়াল চালা একটু জল লাগতেই হুড়মুড় করে পড়ে গেছে। নিতাই সাঁতরা উঠানের ধরে নিমতলাকে জল উঠতে শুরু করে দিয়েছে। আর হাত খানেক উঠলেই ঘরে জল লেগে যাবে। ভিটার একপাশের উঁচু দিকটায় বৌ-ছেনাদের নিয়ে চালা তৈরী করতে শুরু করে দিয়েছে। সেই বছর বন্যায় অঞ্চল থেকে একটা ত্রিপল সে পেয়েছিল। সেইটাকেেই বর্ষা কাটতে গুছিয়ে পাট করে রেখেছিল নিতাইয়ের বই ছোবো। দোচাল কারে একটা চালা বাঁধতে তৎপা নিতাই।ঘরের ভিতর থেকে তক্তাপোশ বের করে এনেছে। পাশে বাঁশের বাতা বেঁধে আরেকটা মাচা করেছে। সেই মাচার উপরে ঘরের সব জিনিসপাতি,চালের বস্তা রাখার বন্দোবস্ত করেছে। ত্রিপল বাঁধতে বাঁধতে নিতাই ছোবোর সঙে কথা বলে,
– বইলু বোড়কি,ইবারে জলের যা বড়বাড়ন্ত তা কুনুবারে দেখিনি। বারকে বার যেন ফুলে ফুলে উঠেটে।
— মোর ত গা হাত পা কাঁপেঠে ভয়ে। মোেদের ভিটায় আমরা তিন ঘরেই আছি। বাকিরা ত সব বচকাবুচকি বেঁধে পাৰি গেছে ইস্কুলকে।
— যারা গেছে যাউ। মোর ভিটার ইখিনে যেদি জল উঠে তবে চেতাপারকে আর কুনু শালা বাঁচাতে পারবেনি।
— মা গঙ্গাবুড়ি! তুমি এট্টু শান্ত হও মা। মোদের ঘরদর আর ছেনাপেনার মুখের দিকে তাকাও মা।
—- ঠিকই রে বোড়কি,মা গঙ্গাই ভরসা। তবে বাপের ভিটা ছেড়ে কুথাও যাব নি। মরি ত ছেনাপেনা লিয়ে ইখিনেই মোরব।
নিতাইয়ের মুখের কথা শেষ না হতেই ঘাঁটী পাড়ার দিক থেকে কান্নার আওয়াজ ছুটে আসে। খুব চিৎকার চেঁচামিচি শোনা যায়। হুড়মুড় করে একটা ঘর পড়ার শব্দ ভেসে আসে। কিন্তু এখন ত জানার কোন উপায় নেই নিতাইয়ের। তবে আন্দাজ করতে পারে তারা যে,কারো একটা ঘর পড়ে গেল। ছোবো হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। নিতাই নির্বকার ভাবেই চালা বাঁধার কাজ করে যায়। আসলে নিতাই সেই কবে ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে ঢোলের জল যন্ত্রণার দৃশ্য। বর্ষা এলেই শুধু ঢোল নয় ঘাটালের চার ভাগের তিনভাগ জলের তলায় ডুবে থাকে। বেনো জলে ভেসে, ডুবে তাদের দিন কাটাতে হয়। নিতাই চালার টুঙিতে উঠে ছোবোকে ধমক দিয়ে থামায়,
—-খজরা শালি তুই কাঁদুঠু কেনে! তুই কাঁদলে কি ঘাঁটী পাড়ার দুখ্যু ঘুচে যাবে! ই ত মোদের কপালের দোষ। সরকার এসেঠে আর যাইঠে। উ এসে বলে মাস্টার পেলান কোরবো,সে এসে বলেঠে মাস্টার পেলান কোরবে,তারপরে যেই ভোট শেষ অম্নি -গাঙ পেরালে কুমির চুল ছিঁড়। সব শালা গুলান সুবিধাবাদী। গুয়ের কুনু পিট শালা ভাল নয়। সুদু নিজেরটা গুছি লিবার ধান্দা।
নিতাইকে চালা বাঁধতে দেখে তারাপদ ছুটে এসে। তারাপদও ভিটা ছেড়ে যাইনি। তারও মাটির দোতলা ঘর। চারদিকে দুয়ারে। কেঁদালের দিকে গোয়াল ঘর। ছাগল আর হাঁস মুরগীর ছাড় আছে। নিতাইয়ের গলা পেয়ে তারাপদ বেরিয়ে আসে।
—- কেনে এত বোকুঠু রে নিতোদ্দো! জল যে এগবেরা পঁদ ঠেলা দিই দিল! তুই চালা করুঠু দেখে মোর বউ ত ঘরে কাউঝাউ লাগি দিছে। বলেঠে দেখনা পুটুর বাপ ওদের উঁচ ভিটার দিকে মাচা করেঠে। কি কোরবো রে! আমিও কি কেঁদালের দিকটায় একটা মাচা কোরবো?
— তোর উ দিকটায় উটবেনি। তাবাদে রাতটা গোলে যাউ,কালকে তেমন দেকলে ইস্কুলকে বউ ছেনাদের রেখে এসব।
— সেটা করা যাবে। সুদু চিন্তা অবলা জন্তু গুলানকে লিয়ে। একে ত বিষ্টি ঝরেঠে,তার উবরে গরু ছাগল গুলানের যেন ছেরান্তি রোগ ধরে গেছে। আর মুত কেটাল পরিস্ার কত্তে পারিনি।
— তর বৌদির হাতে আঙুলের গোলে ত হাজা হই গেছে। দিন রাত সরসার তেল মাখেঠে।
— থাইলে বোলুঠু চালা কোরবোনি।
— রাতটা দেখা যাউ না।
—- খানেক খন আগে ভবা ঘাঁটি পাটির লোকজন লিয়ে লৌকায় করে এসছিল। বলে গেল ইস্কুলে নাকি সব ব্যবস্থা করা আছে। খবাব দাবারও দিবে। গেলেই হবে।
— অকে মোর চিনা আছে। শালাটার লেচার ভাল নয়। গেল বারের বন্যায় জিয়ে দেখে লিচি।
—- এবারেই ত অদের কামানি। ওই লৌকায় চেপে ঘুরে ঘুরে ফপর দালালি করবে আর যা জিনিস এসবে নিজেরা আগে ঝাপটি লিবি। তরা শালা বুড়া আঙুল চুষনা।
বোংশা ভিটা ছাড়বে না কিছুতেই। যতই জল বাড়ুক। পাটের বজা, উপড়ানো গাছ, দলছুট হাঁস সব ধরবে সে। বন্যার এই সময়টাতে তার বসে থাকার জো নেই কিছুতেই। ঘনা বাগ মাছ ধরতে কত রকম কৌশল করবে। জগা ঘরের পাড়নে তুলে রাখা বস্তা থেকে সব জাল বার করবে। একদিকে ঘনা অন্যদিকে জগা গোটা কালসাবা ভেলা চড়ে জাল আড়বে। ডেবরিও কম যায় কিসে। বন্যাকে সেও ভয় পায় না। ডিসের হাঁড়ির মুখে দড়ি বেঁধে তার খুঁট কোমরে গুঁজে সাঁতরে গাঁতি জাল তুলতে চলে যাবে মাঠে।
এদিকে হাইস্কুলে এসে উঠেছে বহু পরিবার। মেনকা গত বছর দু'খানা ত্রিপল কায়দা করে বাগিয়ে নেয়। মেনকার বর মারা গেছে তিন বছর হল। ছোট দুটা ছেলে মেয়ে। খাল বিলে মাছ ধরে আর জন খেটে সংসার চালায়। অনেকেই জানে মেনকা একটু ঢলানি গোছের। বন্যা আসতেই সবার আগে সে ছেলে মেয়েকে নিয়ে ইস্কুলে হাজির হয়। সম্পত্তি বলতে বাস্তুর কাগজ। আর নিজের ভোট কার্ড,ছেনাগুলার রেশন কার্ড আর জন্ম সার্টিফিকেট। সেগুলো একটা নাইলনের ব্যাগে ভরে, দু'একটা কাপড়চোপড় নিয়ে চলে আসে। মাথায় তার অন্য ভাবনা চর্কিপাক খায়। এবারে সে যে করে হোক একটা সরকারি ঘর হাসিল করবে। বয়স হয়নি বলে বিধবা ভাতা সে পাবে না। মেনকা জানে ভবা ঘাঁটিকে ধরলেই তার কাজ হবে। রাত হলেই ইস্কুলের ত্রাণ শিবিরটা একটা অন্য চেহারা নেয়। দিনের বেলায় লোকজন সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে বলে বোঝা যায় না। রাত হলে চিলচিৎকার শুরু হয়ে যায়। অনেকে আবার রাতে ভিটা ছেড়ে চলে আসে। সাপখোপের ভয়ে। কিংবা রাতে কোন বিপদআপদ হলে কিছু করার থাকবে না।
তারপর একসময় চিৎকার থেমে যায়। কোলের শিশুরা ঘুমিয়ে পড়ে। জগা সর্দার মদ গিলে এসে একাই বকে যায় নাগাড়ে। শেষে সেও নেতিয়ে পড়ে স্কুলের দুয়ারটায়। পেত্তোবা নেতাদের খিস্তি খেউড় করে। খোঁদলে ঢুকে যাওয়া ঘনার জ্বলজ্বলে চোখ দুটো রাত বাড়ার সাথে সাথে নিভে যায়। ডেবরি আঁশ গন্ধ গায়ে নিয়ে খিচুড়ি খেয়ে পুটুল পাকিয়ে পড়ে থাকে। শুধু জেগে থাকে মেনকা। রাত আরো গভীর হলে একটা টর্চের আলো দু'বার জ্বলবে আর নিভবে। স্কুলের পেছন দিকে ভাঙা পাঁচিলটার দিকে তখন তাকে যেতে হবে। সেখানে গেলেই তার ঘর তৈরীর লিস্টে নাম থাকবে। সেই আশায় মেনকার চোখে ঘুম নেই। মেনকার মনে কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। মন তার বহুবার সায় দিয়েছে–
— কি কোরবো এই গতর লিয়ে। ধুয়ে খাব। চুনাচাপসা বিচে,পঁদের কাপড় তুলে লোকের ঘরে খেটেলুটে কদিন চালাব। উ ত নিজে মোরে, মোদেরকেও মেরে রেখে গেছে। একটা থাকার মত ঘর নাই। যেদি মোকে ছিঁড়ে খাবলে খায় ত খাউ। তবু মোর ছেনাগুলানের জন্নে ত একটা ছপর পাব। পাকার ছপর। না খেতে পাই পেট চাবলা খেয়ে ত এট্টু ঘুমাতে পারব। তাতে পাপ হয় হউ। ছেনাদের সুখেই মোর সুখ। পাপে যেদি শরীলে পোকা পড়ে পোড়ু। অদের জন্নে তাও সয়ে লুব।
মেড়েমুড়ে শিলাই তার জলস্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সব। ফিবছর জলে হেজে, ডুবে ঢোল দিন কাটায়। তারপর আবার উঠে দাঁড়ায়। শিলাইকে গালিগালাজ করে। শিলাইকে ভালবাসে। লোখা জানে তার ভগী খুড়া বন্যা এলেই বলে,
0 Comments