জ্বলদর্চি

সিংহপুরের সুসীমাপর্ব- ১২/গৌতম বাড়ই

সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ১২
গৌতম বাড়ই


সব মানুষের জীবনেই বাজে কেন এ করুণ সুরের রাত?


কিছু আগে বা কিছু পড়ে, এমন রাতে বেজে চলে বিসমিল্লাহি সানাইয়ের করুণ রসের ধারা। জীবন তো এক খোঁজ, জীবন তো এক রহস্য! প্রতিটি জীবনই এক যাত্রা এবং ভারী আশ্চর্য গন্তব্য শেষে সবাই রেখে যায় এক নিথর, প্রাণহীন দেহ। কেউ বার্ধক্যে, কেউ বা রোগে ভুগে জরাগ্রস্ত হয়ে, কেউ বিভিন্ন দূর্ঘটনায়, আততায়ীর হাতে প্রাণ হারায়, এরকম নানা কারণে তার যাত্রা শেষ করে। সেই তো মৃত্যু। মৃত্যুর রঙ তো একই! আমরা খুব কাছের মানুষজন আর প্রিয়জনেরা তাকে শোকে- স্মরণে- স্মৃতিতে আমাদের অন্তরে বাঁচিয়ে রাখি । মায়ের মৃত্যুর রাতটাতে বসন্তসেনার চোখে ঘুম ছিল না, সে শুয়ে শুয়ে ভাবছিল এই মানুষের  মৃত্যুর চিত্রপট। জন্মানোর কারণটি না হয় এক, তবে মৃত্যু কিন্তু বিভিন্ন কারণে কেন?  বসন্তসেনার মায়ের মৃত্যুটা হঠাৎ নয়, মৃত্যুর সরণীতে মায়ের পদক্ষেপ পড়েছে তখন ক'টা বছর হল। তবুও মনে হত,  তার মা আরও অনেকদিন তাদের সঙ্গে রোগে ভুগলেও সাথে থাকবেন। আজ সারা বাড়িতে আলো জ্বেলে রেখেছে সে, অন্ধকারে মায়ের বিছানার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। এক গভীর শূন্যতা সেখানে। বুকটা কেমন খালি হয়ে ওঠে, অন্ধকারে শূন্যতার গহ্বর আরও বড় হয় যেন। তাই সে আলো জ্বেলে রেখেছে সারাটা ঘরে। 

বাবা আর ভালোমামা রয়েছেন অন্য ঘরে। এই ঘরে এই মুহূর্তে বসন্তসেনা একা, আলোমাসি রিফ্রেশ- রুমে গিয়েছেন। ভালোমামা এসেছেন দুর্গাপুর থেকে আর আলোমাসি,  শিলিগুড়ি থেকে দুপুরের ফ্লাইটে চেপে সোজা দমদম বিমানবন্দর থেকে কেওড়াতলার শ্মশানে এসেছিলেন। কাছের লোক আর আত্মীয় বলতে এই দুজনই তার মায়ের শেষকাজে উপস্থিত হয়েছিলেন। ভালোমামা মায়ের মাসতুতো ভাই আর আলোমাসিও মায়ের রক্তের সম্পর্কের কেউ নন, তবে তারচেয়েও বেশি কিছু বাসবদত্তার কাছে। এদের সম্বন্ধে বসন্তসেনার কাছে  অনেক গল্প  আছে। যা একদিনে ফুরোবে না। যারা নিকটে থাকেন, কলকাতার আশেপাশে তাদের কাউকে মায়ের মৃত্যু সংবাদ সে নিজে দেয়নি, বাবা বা এই ভালোমামা আর আলোমাসি হয়ত দিয়েছেন। ভালোমামা আর মামিও মায়ের অসুস্থতার সময় থেকেই অনেক অনেকবার তাদের বাড়ি আর বিভিন্ন নার্সিংহোমে আসা যাওয়া করেছেন , পাশে থেকেছেন। আলোমাসি তো দীর্ঘদিন মেশো আর ভাইকে শিলিগুড়ির বাড়িতে ফেলে রেখে তাদের পাশে থেকেছেন। নার্সিংহোমে যাতায়াতে বসন্তসেনার  সঙ্গী হয়েছেন। কাছের লোকেদের জিজ্ঞাস্য অনেক, কিন্তু ওই  দুঃসময়ে  নানান অজুহাত দেখিয়ে তাদের পাশে অন্তত এসে সহযোগিতা করেননি বা দাঁড়াননি। অজুহাত মানেই একগাদা মিথ্যে দিয়ে সাজানো কথা। আর অবলীলাক্রমে এইসব মিথ্যে বলতে দেখে সেইসব সন্মানীয় আত্মীয়স্বজনদের বসন্তসেনা ঘৃণার চোখে দেখেন এখনও। 

সুশোভনবাবু এই নিয়ে তাকে বলেছিলেন- " বুঝলি হাসনু মা , এইসব ছোটখাটো সাংসারিক ব্যাপারে বেশি মাথা গলাবি না, এতে নিজেকেই নিচে নামতে হয়। জেনে রাখবি, মানুষের ভিতরের প্রকৃতি কম- বেশি সবখানেই এক। প্রথমেই দেখে নেয় লাভ- ক্ষতির হিসেবটুকু। " 

বসন্তসেনা বলেছিল তার বাবাকে- " কিন্তু বাবা, তুমি তো ওদের যে কোনও বিপদে খবর পেয়ে দিন- রাতের যে কোনও সময়ে ছুটে গিয়েছ, কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে নার্সিংহোমে বা বাড়িতে সব জায়গায়। মায়ের অসুস্থতার পর তুমি হয়ত আর সেভাবে যেতে পারনি, আমিও সবার খবর আগের মতন রাখতে পারিনি, তাতে ওরা কী ওদের কর্তব্য কর্মগুলো করবে না? বা এইভাবে বেমালুম ভুলে গেল? "
🍂

সুশোভন বললেন- " এই আশা করাটাই বৃথা, চিরন্তন সত্য যা- তুমি তোমার কর্তব্য করে যাও। ফলের আশা করনা। পাশের ঘরে মা শুয়ে রয়েছে, এখন এই অসুস্থ শরীরে তাকে মানসিক ভাবে উত্তেজিত করলে  সেটা খারাপ হবে। এইসব তুচ্ছ ঘটনা বলে এড়িয়ে যাও।‌তারা নেই তো কি হয়েছে? তাতে  আমাদের কখনও লোকবলের অভাব হয়েছে? আমার সহকর্মীরা, তোমার মায়ের স্কুলের সবাই কিংবা প্রতিবেশিরা সবসময় এগিয়ে আসছে, অযথা ওদের নিয়ে চিন্তা করনা। পাশের ঘরে  মায়ের কাছে গিয়ে টেবিলের ওপরে রাখা ওষুধ দুটো মাকে খাইয়ে দাও হাসনু- মা। শুধু মনে রাখবে এই কথা, যা বৌদ্ধ সাহিত্যে ধম্মপদে  বলে গিয়েছিলেন স্বয়ং বুদ্ধদেব - মা পিয়েহি সমাগচ্ছি অপ্পিয়েহি কুদাচনং। পিয়ানং অদসসনং দউকখং অপ্পিয়ানং চ দসসনং। অর্থাৎ  কিনা, প্রিয় বা অপ্রিয় কারো কাছেই যেওনা, প্রিয়ের অদর্শনে দুঃখ আর অপ্রিয়ের দর্শনেই দুঃখ ।" 

"ঠিক আছে বাবা। তবে গীতার উদাহরণ যে সবসময় ধ্রুব সত্য। সবসময় এ্যাপলাইয়েড আমি তা মনে করি না। তবে আজ আমি তোমার সাথে তর্কেও যেতে চাইছি না। " -  এই বলে,  বসন্তসেনা  বাবার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন, বাবাই তার প্রকৃত শিক্ষক আর বন্ধু এ জগতে, সে সত্যি ভাগ্যবতী। তারপর মায়ের কাছে মায়ের ঘরে চলে এসেছিল। 

মনে পড়ছিল বসন্তসেনার কত কথা,  সেইদিন মাকে নিয়ে। এই মায়ের অসুস্থতার পর, এই তো অল্প কিছুদিন আগে,  একদিন মায়ের কাছে বসে রয়েছে, তার মা দীপশিখা জিগ্গেস করলেন তাকে- " হা রে তুই বিখ্যাত ডিজাইনার এবং লেখক ক্রিসদা রডরিগেজের নাম শুনেছিস? 

মায়ের পাশে বসে সে মায়ের দিকে অবাক চোখে তাকাল আর বলল- " কেন মা? ওনারও তো তোমার মতন পাকস্থলীর ক্যানসার হয়েছিল, মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে মারা যান। তুমি কি ফেসবুকের থেকে কোনও পোস্ট দেখেছ ওনাকে নিয়ে? " 

-  "হ্যাঁ রে! আজকাল ঐ সব পোস্টে কেমন চোখ আটকে যায়। মৃত্যু নিয়ে নানান চিন্তা ভাবনা মাথায় চলে আসে। তবে মনটা শক্ত করে ফেলেছি। শুধু ভাবতে গেলে কষ্ট লাগে তোদের ছেড়ে চলে যেতে হবে! আচ্ছা বলত, আমাদের এই জীবন কিসের জন্য? মৃত্যুর কী কোনও রঙ থাকে? জীবনটাকে যেমন সাতরঙা বলা হয়। " 

বসন্তসেনা বলে- না মা, জীবন বা মৃত্যুর রঙ থাকবে কী করে?  আমার তো মনে হয় ওসব রঙের আমদানি কবিরা করেন তাদের চেতনা থেকে। তাদের চেতনায় জন্ম আর মৃত্যু যে ভাবে ধরা দেয়। ঐ পোস্ট আমার চোখেও পড়েছে, সত্য- মিথ্যা জানিনা, তবে এক সত্য অনুভব রয়েছে। যার অত সম্পদ, বিত্ত , তার জীবনে আজ তা নিষ্প্রয়োজন! তার কথার উদ্ধৃতিও দেয়া আছে সেখানে, 'মৃত্যুই একমাত্র বাস্তব।' সেই পোস্টে নিচে আবার লেখা, ভাগ্যে কার কী থাকে, কেউ জানে না ইত্যাদি। এমন কিছু আহামরি কথা নয়, যে গভীরভাবে ভাবাবে। এগুলো আবার কিছু ব্যর্থলোক ফেসবুকের পাতায় নিজের মনগড়া কথাও মিশিয়ে করে। তাই বলছি, দেখেছি আর অল্প একটু বিশ্বাস করেছি। তুমি মনের জোর রাখো, এইসব নেগেটিভ পোস্ট এড়িয়ে যাবে। জানবে মানুষের মনের জোরই মানুষের আয়ুবৃদ্ধি করে মা। " 

দীপশিখা বলে ওঠেন- " হাসনু মা, আমিও তো আরও আরও বাঁচতে চাই তোমাদের নিয়ে। মৃত্যুকে আমিও জয় করতে চাই। তাকিয়ে আছি সেই মিরাকেলের দিকে! যদি একদম বেঁচে উঠি। " 

বসন্তসেনার  চোখ জলে ভিজে আসে, মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। দীপশিখাদেবী বলে ওঠেন- " তুই আমার সত্যি কোনো জন্মের মা ছিলিস বল তো!"

বসন্তসেনা বলে- " তাই যেন হয়। তুমি সত্যি আরও অনেকদিন বাঁচবে। একদম বেঁচে উঠবে। আমরা একসাথে থাকব আরো আরো অনেকদিন মা। " 

দুঃখের সেই রাত, শোকের সেই রাত শেষ হয়ে কেটে গিয়েছে আরও কিছু বছর। সময় তো বহতা চিরদিন। যেভাবে কেটে যায় হাজার হাজার বছর। মনে পড়ে যায় তার বঙ্গেশ্বরের রাজকন্যার কথা। তাকে মৃত্যুভয় আটকে রাখতে পারেনি। সে ছুটেছিল অজানা এক পথে, সেই ভয়ংকর এক রাতে। তারপরের গল্পটা আরও সুন্দর। সেই ইতিহাসের গল্পও  যেমন চমকপ্রদ, তেমন বিস্ময়কর। এ হল বসন্তসেনার বেঁচে থাকবার উপকরণ।

যখনই সে আটকে পড়ে জীবনের কোনও এক সমস্যায়, অমনি ইতিহাস থেকে বেরিয়ে এসে সুসীমা তাকে জায়গা করে দেয়, তাকে ছুটবার রাস্তা বলে দেয়। মায়ের মৃত্যুটা তাকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল ঠিকই, তবে একই সঙ্গে তাকে এই পৃথিবীতে নির্ভয় একলা চলবার, একলা লড়াইয়ের জন্য তৈরী থাকবার অনুপ্রেরণাও‌ জুগিয়েছিল। আর তার পেছনে ছিল ইতিহাসের সেই নারী সুসীমা। 

বসন্তসেনা আজ মেঘলা দিনে সন্ধের মুখে ছাদে উঠে আসে। তাকিয়ে তাকে ঐ দূরের অসীম কালো গহ্বরে। যেখানে লুকিয়ে আছে যাবতীয় সব বিস্ময়। মানুষ আদতে সব থেকেও একা এবং ভীষণ একা। এই একক থেকেই উপলব্ধি হয় পৃথিবীর সব সৃষ্টির। সব অজানা রহস্যের। মনে আঁকে প্রশ্ন! 

ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments