জ্বলদর্চি

লোকমাতা রানি রাসমণি —১৬ /সুমিত্রা ঘোষ

লোকমাতা রানি রাসমণি —১৬
সুমিত্রা  ঘোষ

গোটা বাংলায় রানি রাসমণির জমিদারির ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। রাজচন্দ্রের মৃত্যুর পর বিষয়-সম্পত্তির দায় দায়িত্ব যখন রানির উপর ন্যস্ত হয়েছিল তখন রানি বড় জামাই রামচন্দ্র আটা ও ছোট জামাই মথুরামোহনকে সঙ্গে নিয়ে জমিদারির কাজ চালাতে লাগলেন। মেজ জামাই শ্বশুরবাড়ি থাকেননি, মেজজামাই তার পরিবার নিয়ে নিজের বাড়িতে থাকত। বড়জামাই ও ছোট জামাই জানবাজারের বাড়িতে বসবাস করত।
জামাইদের মধ্যে মথুরামোহন হয়ে উঠলেন রানির ডানহাত।  জানবাজারের যাবতীয় বিষয়সম্পত্তি দেখাশোনার ভার মথুরামোহনকে দিয়েছিলেন রানি রাসমণি। বড় জামাইকে বিভিন্ন তালুক দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তবে ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ তদারকি করতেন মথুরামোহন। এ ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট অভিজ্ঞ ছিলেন, যখন প্রয়োজন হত অত্যাবশ্যকীয় আদেশপত্র, হিসাব ও দলিল প্রভৃতিতে রানি স্বাক্ষর করতেন শিলমোহর দিয়ে।
রানি রাসমণি জমিদারনী, কিন্তু প্রজাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক মা ও সন্তানের মতো। মোকিমপুর নামে যে তালুক ছিল যেখানে নীলচাষ হতো এবং  নীলকর সাহেব চাষীদের ওপর যথেচ্ছ অত্যাচার করত। বাংলা সাহিত্যের একজন প্রখ্যাত লেখক দীনবন্ধু মিত্র নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কাহিনী তুলে ধরেছেন তাঁর 'নীলদর্পণ' বইতে, যে কাহিনি পাঠ করলে চোখের জল ধরে রাখা যায় না।
🍂

যে প্রসঙ্গের অবতারণা চলছিল তা হচ্ছে মোকিমপুর পরগণার নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কাহিনি রানির কানে এসে পৌঁছালো। রানি সঙ্গে সঙ্গে সাহেবদের সংযত হতে খবর পাঠালেন। তিনি এমন কঠোর মনোভার নিয়েছিলেন যার ফলে সাহেবরা নিজেদের গুটিয়ে নিতে বাধ্য হলেন। সেই সময় জমিদারে জমিদারে লড়াই হত। কে কত বড়, কার শক্তি বেশি এই ভাবে লড়াই লেগেই থাকত। কথায় বলে রাজায় রাজার যুদ্ধ হয় উলুখড়ের প্রাণ যায়। তখনকার দিনে জমিদারকে রাজা বলা হত। এই ভাবে রাজায় রাজার যুদ্ধ হওয়ার সময় একবার এক ঘটনা ঘটেছিল। জগন্নাথপুর নামে এক তালুকের প্রজাদের ওপর পাশের এক তালুকের জমিদার অত্যাচার শুরু করল। জগন্নাথপুর তালুকের কাছারির কর্মীরা পালটা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল, রানি রাসমণি খবর পেয়ে জগন্নাথপুর তালুকের কর্মচারীদের বলে পাঠালেন প্রজাদের রক্ষা করাই কর্মচারীদের কর্তব্য, আক্রমণ করা নয়। উভয় তালুক-এর মধ্যে লাঠালাঠি শুরু হলেও তা আর বেশি দূর এগোল না। রানির কথা শুনে উভয়পক্ষ সেবারের মতো সংযত হয়েছিল।
রানি রাসমনি সেকালের নামকরা জমিদারনী ছিলেন। সমগ্র বাংলায় তাঁর ব্যবসার জাল বিস্তার ছিল। রানির মাঝে মাঝে ইচ্ছে হতো খুব ঘটা করে উৎসব পালন করবেন এবং ইচ্ছে পূরণ করতেন। শহরের মানুষজন রানির এলাহি খরচের বাহার দেখে অবাক হয়ে যেত। জানবাজারে যা কিছু হবে তা কখনওই ছোটখাটো হবে না। রানির উৎসবে আপামর জনসাধারণ যোগ দিত সে নীচতলা উপরতলার যে শ্রেণির হোক না কেন। উৎসব উপলক্ষে যতটা পারা যায় মানুষের সেবা করার প্রবণতাই তাঁর  মনে সদা কাজ করত। রানি সকলের পাশে থেকে আশ্বাস দিয়ে বলতেন, আমি এক রানি, যে সদাই তোমাদের পাশে আছে।
(ক্রমশ) 

Post a Comment

0 Comments