রোশেনারা খান
পর্ব ৯০
সারাপাড়া ভেঙ্গে পড়েছে, আরেফুলদা (মল্লিক) খুব ভাল মানুষ, খান সাহেবের পূর্ব পরিচিত, ওনারও আদি বাড়ি কেশপুর থানায় ।খান সাহেব যাঁদের খবর দিতে বলেছিলেন, রানী সবাইকে একে একে ফোন করে। সাহবাজ আর ওর বাবা ফোন পাওয়া মাত্র চলে এসেছে। ওরা আমার সম্রাটকে নীচের ঘরে নিয়ে চলে যায়। আমি নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করি, যেন চলে যাওয়াটা ওনার মনের মত হয়। আরেফুলদা জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাবি, জানাজা কখন হবে? মেয়ে জামাই কি আসতে পারবে? পারলে ওনার দেহ আজ রেখে দেওয়া হবে। না হলে আজই দাফন করে দেওয়া ভাল।
মেয়েকে দুঃসংবাদটা আমাকেই দিতে হল। তারপর আমার সঙ্গে কথা হয়নি। শুনলাম ওরা ১ ঘণ্টা সময় চেয়েছে। আসতে পারছে কিনা তারপর জানিয়ে দেবে। সারা শহর ও কেশপুরের আশপাশের গ্রামের আত্মীয়স্বজনরা,পরিচিত জনেরা আসছেন। আমার পরিচিত মানুষরা বেশিরভাগই এসেছেন। সুদীপের ফোনে খবর পেয়ে স্বপ্না সঙ্গে সঙ্গে কলেজ থেকে রওনা দিয়েছে। সমস্ত দায়িত্বটা নিয়েছেন সাহবাজের বাবা সাহজামাল আর প্রতিবেশীরা। যারা এসেছেন ও আসছেন, তাঁদের চা-বিস্কুট দেওয়া, দুপুরের খাওয়ার আয়োজন করা, সব করছেন প্রতিবেশীরা। আমার সন্তানতুল্য ভাইয়েরা কাজে হাত লাগিয়েছে। কুইজকেন্দ্রের সবাই সস্ত্রীক এসে দেখে যাচ্ছেন, দেখা করে যাচ্ছেন। ওনার চাকরিজীবনের পরিচিত ও আপনজনেরা এসেছেন তাঁদের সাজাহানদাকে শেষ বারের মত শ্রদ্ধা জানাতে। কাউন্সিলর নির্মাল্য, বাম নেতা বিজয় পাল এসেছেন, বিজয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা অন্যরকম। বাপেরবাড়ি শ্বশুরবাড়ি থেকে অনেক আত্মীয় এসেছেন। এরমধ্যেই চলছে কোরান সরিফ পাঠ। আমার খুব মনে হচ্ছে ওনার ঘুম ভাঙ্গিয়ে একবর যদি ওনাকে এসব দেখাতে পারতাম, তো বলতাম, দ্যাখ, কত মানুষ এসেছেন, কত মানুষ তোমার শেষ বিদায়ের আয়োজনে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে চলেছেন।
হয়ত এই লেখা পড়ে অনেকে ভাবছেন, আমি এত গুছিয়ে লিখেছি কী করে? হ্যাঁ, এটা মনে হতেই পারে। এসব কথা লিখছি ৩ বছর পর, সেইসময় কী হয়েছিল? কারা এসেছিলেন? কে কী করেছেন? সেই মুহূর্তের কিছু কিছু দৃশ্য, ঘটনা স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে মনের মধ্যে কিছু লেখাছিল ডাইরিতে, আর বাকিটা সেইসময় যারা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের থেকে শোনা।যেটুকু জেনেছি, সেটুকুই লেখার চেষ্টা করছি।তাছাড়া যত কষ্টই হোক, লিখতে তো আমাকে হবেই।
বাবলিরা জানিয়েছে, ওরা আসছে। আগামিকাল সন্ধ্যায় ওদের ফ্লাইট দমদমে ল্যান্ড করবে। সেই মত গাড়ি পাঠায় যেন। তখন আলোচনা শুরু হল, কী ভাবে ওনাকে এতটা সময় রাখা যাবে? কেউ বলছেন, কলকাতায় ‘পিস হেভেন’এ নিয়ে গিয়ে রাখতে পারলে ভাল হত। আবার কেই বলছেন খড়গপুরে রাখার ব্যবস্থা আছে কিনা খোঁজ নিলে হয়। শেষপর্যন্ত বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করা হল। এমনিতে শীতকাল, ওনার শুকনো শরীরের কিছুই হবে না। তবুও বরফ নিয়ে এসে তার ওপর শুইয়ে রাখা হল। আমি দেখতে গেলাম, বহুদিন পর শান্তিতে ঘুমচ্ছেন বহু যুদ্ধের নায়ক আমার সম্রাট। খুব কষ্ট লাগল বরফে শোয়ানো দেখে। উনি যে খুব শীতকাতুরে, একদমই ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারেন না।
নিজের জীবনে, নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এই কাহিনী লেখা সহজ নয়। বার বার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। চোখের জলে আঁচল ভিজে যাচ্ছে। তবুও লিখে চলেছি। বুকের মধ্যে জমাট বাঁধা কষ্টগুলো বরফের মত গলে পড়ছে। এত অভিশপ্ত জীবন কারো না হয়। রফিক সাহেবের বাগানে প্রতিবেশীরা মুরগির মাংস আর ভাত রান্না করেছেন। সবাইকে ডেকে ডেকে খাওয়ানো হচ্ছে। রাতের খাওয়ার আয়োজনও করা হয়েছে। মানুষ আসার বিরাম নেই। ওনাকে দেখে, আমার সঙ্গে দেখা করে চলে যাচ্ছেন। সবাই একটি কথা বলেই সান্ত্বনা দিচ্ছেন, ‘আপনি তো অনেক করেছেন, চিকিৎসায়, সেবায় কোনও ত্রুটি রাখেন নি, ওনার সময় হয়ে গেছে, তাই উনি চলে গেলেন’।আমি কি সাত্যিই সব করতে পেরেছি? আমার মনে হচ্ছে আরও একটু বেশি সময় ওনার সঙ্গে কাটাতে পারলে ভাল হত।
🍂
গতকাল দুপুর থেকেই প্রতিবেশীদের কয়েকজন নিজেদের খরচে রান্না করে সবাইকে খাওয়াচ্ছেন। ওনাকে স্নান করিয়ে, নতুন পোশাক পরিয়ে শেষ যাত্রার জন্য রেডি করে বাড়ির সামনে তাঁবুতে(মৃতদেহ বহনের খাটিয়া)শোয়ানো আছে।আমি মাথার কাছে দাঁড়িয়ে সবার সামনে ওনার কাছে মাফ চাইলাম। উনি কোনও অপরাধ করেননি, তাই ওঁনাকে মাফ করার কোনো প্রশ্নই নেই।
রাত ৮ টার পর এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি এসে বাড়ির সামনে দাড়াল। বাবলি গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে আসে, ‘আমি বাপিকে একবর ছোঁব’। মেয়েটা আমার গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদল। কিন্তু গোসল, কাফন হয়ে গেছে, তাই মেয়েরা আর ছুঁতে পারবে না। আমি, এই প্রতিবাদী মহিলা, কোনও প্রতিবাদ না করে স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার কথায় যদি ওঁরা চলে যান? তখন কী হবে? আমার সম্রাট তাঁর বেগম, তাঁর মহল ছেড়ে চতুর্দোলায় শুয়ে চলে গেলেন অজানার উদ্দেশ্যে। নাহ, সব কথা লেখা সম্ভব নয়। আর পারছিনা। দীপ আমাদের মা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির ভিতর নিয়ে এল। কী করে থাকব আমি? সেই কোন বালিকাবেলা থেকে আজ প্রায় ৫০ বছর ধরে ওই মানুষটাকে ঘিরেই তো আমার জীবন আবর্তিত হয়েছে। এক এক সময় ওনার সেই কাতর উক্তি, ‘বেবি, ভীষণ কষ্ট, আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না’, আমাকে ভাবতে মজবুর করত, আমি কি চাইব? ওনার চলে যাওয়া? না আমার কাছে থেকে কষ্ট পাওয়া?
ঘরময় ছড়িয়ে রয়েছে, তাঁর ছড়ি, চটি, চশমা, ফোন, আইপ্যাড। মাথার কাছে টেবিলে রাখা আছে, ওষুধের বাক্স, বোরলিন, অম্রতাঞ্জন, চিরুনি। শুধু আমার ৫০ বছরের জীবন সাথীই নেই। আমাকে না বলে চুপি চুপি চলে গেছেন। জানতেন আমার সামনে দিয়ে উনি যেতে পারবেন না। আমার সঙ্গেই কেন এমন হল? আল্লাহ্ নাকি যা করেন, ভালর জন্যই করেন। যারা বলেন, তাঁদের কাছে আমার প্রশ্ন, এতে আমার কি ভাল করলেন তিনি? আমারই সবসময় কেন এত ভাল করেন? কারো এর উত্তর জানা আছে? আমি কী করে থাকব?
ওদিকে আমার নবতিপর মা গ্রামের বাড়িতে একা কান্নাকাটি করছন। আমি কাকে সান্তনা দেব? আমাকেই বা কে দেবেন? এই শোকে কোনো সান্ত্বনা হয় কি? আজ ৪ দিন হয়ে গেল উনি একটি বারও আমাকে ডাকেননি, ‘ বেবিই, ও বেবিই একবার এসোনা’। আজ তিনদিন আমি আমার সম্রাটের মুখ দেখিনি। এরই মধ্যে অনেকের সঙ্গে অনেক কথা বলতে হচ্ছে। জামাই চলে যাবে, তাই আরেফুলদা অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করে এসে বললেন, ‘ভাবি আপনার জামাই মেয়ে তো চলে যাবেন, জামাই থাকাথাকি বড় কাজটা করে নিলে ভাল হয়’। আমার আপত্তির কারণ ছিল না। তাই বললাম, ‘দেখুন ধর্মীয় কাজে আমার আপত্তি নেই। তবে যেটুকু না করলেই নয়, সেটুকুও হবে। ভুরিভোজ খাওয়ানোর আয়োজনে আমার আপত্তি আছে’। ‘না ভাবি, আপনি যেমন বলবেন তেমনই হবে’, আরেফুলদা বললেন।
মাদ্রাসার ছাত্ররা কোরান পাঠ করল, মোল্লা, মোয়াজ্জিন ও ৫ জন বিধবাকে বাবলি নতুন জামাকাপড় দিল। ওনার আর আমার ভাইবোনদের ডাকা হয়েছিল। ছোট ভগ্নীপতি আমি বলাতে সেদিন থেকেই আছে। যারা কবর কেটেছেন, গোসল করিয়েছে্ন এবং যারা সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে এই কয়েকদিন কাজ করে চলেছেন, তাঁদের বসিয়ে খাওয়ানো হল। এঁদের মধ্যে প্রতিবেশী ছাড়াও যেমন ফয়জল ছিল, তেমন রঙের মিস্ত্রী সুরজ ছিল, হবু ডাক্তার আসাদুল ছিল, সাহাবাজরা বাবা-ছেলে তো ছিলই। ওদের জন্য চিকেন বিরিয়ানি রান্না হয়েছিল। শির্নি হিসেবে প্রতিবেশীদের বাড়িতেও এক বাক্স করে দেওয়া হল। মেয়ে জামাই কোনও ফাঁক রাখেনি। সবই খুব সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ ভাবে শেষ হল।
বাবলি বলল, ‘মা জানিনা মৃত্যুর পর জীবন আছে কিনা। যদি থাকে তবে বাপি খুব খুশি হবে, বাপি বিদায় বেলা যাদের উপস্থিতি চেয়েছিলেন, তারা সবাই কিন্তু অংশগ্রহণ করেছেন। আমিও আজ শান্তি বোধ করছি। উনি যেমনটা চেয়েছিলেন সবকিছু তেমনটাই হয়েছে। উনি সবসময় বলতেন, আমার মৃত্যু যেন বাড়িতেই হয়। আমাকে নার্সিংহোমে নিয়ে যাবে না।খোকনকে(ডাক্তার এফ আর খান)বলে রেখো ও যেন আমার ডেথ সার্টিফিকেটটা দেয়। এ কথা একদিন খোকনকে বলতে, ও বলেছিল, ‘জামাইবাবুর আমার কাছে এটুকুই চাওয়া’? ওই সেদিন ডেথসার্টিফিকেট দিয়েছিল। ওটা দেখিয়ে রানী গিয়ে কবরস্থান কমিটি থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে আসে। পরে এগুলি জমা দিয়ে আমাকেই গিয়ে মিউনিসিপ্যালিটি থেকে আমার সম্রাটের ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে আসতে হয়। ওনার আর একটি চাওয়া ছিল, পাড়া- প্রতিবেশী,ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন, সবাই যদি তাঁর জানাজায় শামিল হন। সে ইচ্ছাও তাঁর পূরণ হয়েছে। মেয়ে জামাইও আসতে পেরেছে। যা প্রায় অসম্ভব ছিল। বলা যায় সৌভাগ্যবশত ওরা এয়ারইণ্ডিয়ার তিনটি টিকিট পেয়ে গেছল।
আমাদের মধ্যেও পারলৌকিক কাজের দিন নতুন বস্ত্র দেওয়ার রীতি রয়েছে। সেই রীতি মেনে আমার বোন স্বপ্না ও দুই মেয়ে চন্দ্রিমা আর বাবলি আমাকে নতুন বস্ত্র দিয়েছিল। সৌনক সুদীপরা জানাজার মাঠ থেকে সাহদিল মসজিদের সমাধিস্থল পর্যন্ত সঙ্গে ছিল। এই প্রসঙ্গে স্বপ্না আর একটি অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছিল।ও তো খবরটা পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে কলেজ থেকে বেরিয়ে চলে এসেছিল। একটা দরকারি পেপারে সই করে আসা হয়নি বলে পরদিন সকালে ওকে কলকাতা যেতে হয়। সন্ধ্যায় ফিরে আমাদের বাড়িতে আসে। সব মিটে যেতে রাত ১০ টার সময় চুড়িওয়ালা মসজিদের সামনে টোটো ধরে, সেই টোটোচালক বলে, জানেন ম্যডাম, কাল বড় আস্তানায় একজন খুব ভাল লোক মারা গেছেন।আপনি দেখলে বুঝতেই পারবেন না ওনারা হিন্দু না মুসলিম। খুব ভাল ব্যবহার ছিল। কত লোক এসেছিল জানেন? সামনের রাস্তাটা গির্জা অব্দি গাড়ি ভর্তি। স্বপ্নাদের বাড়ি পর্যন্ত সে এভাবেই সুখ্যাতি করে গ্যেছে, স্বপ্না শুনে গেছে। টোটো থেকে নেমে স্বপ্না বলেছে, ‘আমিও ওই বাড়ি থেকেই আসছি’। চন্দ্রিমা কাছে খবর পেয়ে, বিচারপতি অশোক গাঙ্গুলি, সুদিন স্য্যার, সৌমিত্র দস্তিদার, সবিতা, বাসবী, অদিতি, আরও অনেকে পরে পরে ফোন করছেন। সেইদিনই রেখাদি সীমাকে পাঠিয়ে ছিলেন।পরে স্বপ্নাদি এসেছিলেন। কলকাতা থেকে ওসমান এসেছিল। এসে ছিলেন প্রচুর মানুষ, যারা খুব ক্লোজ, তাঁরা আমার সঙ্গেও দেখা করতে এসে ছিলেন। এত মানুষের নাম উল্লেখ করা সম্ভব নয়।
আজ দীপ চলে গেল, বাবলিরা যাবে ১৮ ফেব্রুয়ারি। ১৭ তে রানী- সাহাবেজের রেজিস্ট্রি ও আশীর্বাদ হবে। আমি? আমি তারপর কী করব? কী ভয়ঙ্কর শুন্যতা, অসহনীয় কষ্ট। কাউকে বোঝাতে পারব না। কী করে বাঁচব? মাঝে মাঝে অবসাদে ডুবে যাচ্ছি। কেন এমন হল? স্বাভাবিক জীবনে আর ফেরা হবে?
0 Comments