জ্বলদর্চি

কলকাতার কামান কাহিনী /প্রসূন কাঞ্জিলাল

কলকাতার কামান কাহিনী 

প্রসূন কাঞ্জিলাল 

আমাদের জাতীয় জাদুঘরের বাইরে একটা কামান আছে। সেটায় লেখা ৯৪৫ হিজরি। শরীয়তপুর থেকে এটি পাওয়া গেছে। গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের শাসনামলের কামানটি তৈরি হয়েছে পিতল দিয়ে।
   খবর আছে, মাহমুদ শাহের শাসনামল মানে ১৫১৭ সালে পর্তুগিজ দস্যু সিলভেরিয়ার জাহাজে গোলা ছোড়া হয় সমুদ্রতীর থেকে। ভারতে মোগলদের রাজত্ব ১৫২৬ সালে শুরু হলেও পুরো বাংলার দখল নিতে তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় ১০০ বছর। মাঝখানের সময়টায় শের শাহ আর বারোভূঁইয়াদের দারুণ দাপট ছিল। আর সে সময় যুদ্ধের বড় উপকরণ ছিল কামান। কামানের উন্নতিতে শের শাহের ভালো ভূমিকা আছে। তিনি সাম্রাজ্যের প্রায় সব তামা রাজকীয় কামারশালায় এনে জড়ো করেন। তাঁর বাহিনীতে হালকা কামানের সংখ্যা ছিল চার হাজার। বরেন্দ্র জাদুঘরে তাঁর আমলের দুটি কামান রক্ষিত আছে। মালদা থেকে পাওয়া গিয়েছিল কামান দুটি। এগুলোর নির্মাতা সৈয়দ আহমাদ রুমি। এগুলোর প্রতিটির ওজন ৬০ কেজির মতো। কামানগুলোর মুখে বাঘের প্রতিকৃতি দেখা যায়। জাতীয় জাদুঘরের ২৩ নম্বর কক্ষে ঈশা খাঁর তিনটি কামান আজও আছে।
    এইভাবেই বিভিন্ন সময়ে কয়েক দশক আগে থেকে কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গা থেকে উদ্ধার হয়েছে ইতিহাসের এইসব বিস্ফোরক চিহ্ন সমূহ।
 ১৭৫৬ সালের জুন মাস, ২০ তারিখ।  নবাব সিরাজ উদ দ্দ্যৌল্লা কলকাতা আক্রমণ করে ব্যাবসাদার গোরা ইংরেজদের সাধের ফোর্ট উইলিয়াম ভেঙে চুরে তাদের উচিৎ শিক্ষা দিয়েছেন।  শুধু তাই নয়,  গোরাদের একবস্ত্রে কলকাতা ছাড়তে বাধ্য করলেন। তারা গিয়ে আশ্রয় নিলো ফলতায় ডাচদের এক ফেলে আসা কুঠিতে। সিরাজ বীরদর্পে ফিরে গেলেন মুর্শিদাবাদ।  কলকাতার রক্ষণাবেক্ষণের ভার দিয়ে গেলেন হুগলীর ফৌজদার মাণিকচাঁদের ওপর। মাণিকচাঁদও সিরাজের ফেলে যাওয়া কামান বন্দুক আর আরও কিছু কামান টামান জোগাড় করে ফেলে যাওয়া দূর্গকে সাজিয়ে গুছিয়ে তুললেন। বেশ আনন্দেই আছেন তিনি। 
  প্রায় মাস ছয়েক পার হয়ে গেছে। ডিসেম্বর মাস, শীত কাল। খবর পেলেন সেই গোরা সাহেবরা  আবার আসছে কলকাতার দিকে। অনেক লোক লস্কর সিপাই শান্ত্রী নিয়ে। ক্লাইভ নামে একটা নতুন সাহেব তাদের নেতা। ক্লাইভের একটা চিঠি পেলেন তিনি, মিটমাটের জন্য। কিন্তু তিনি নবাবের সাক্ষাৎ প্রতিনিধি।  গোরাদের এত সাহস, তারা দলবল নিয়ে আসে যুদ্ধ করতে। চলো ওদের দেখে আসি। মাণিকচাঁদ চললেন বজবজের দিকে হাতির পিঠে হাতিয়ার নিয়ে।  বজবজের কাছে দেখা হল দুপক্ষের। ক্ষমতা দখলের লড়াই শুরু হল। হেনকালে এক গোলা মাণিকচাঁদের মাথার এক পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। ব্যস, মাণিকচাঁদের যুদ্ধ শেষ। বজবজ থেকে কলকাতা হয়ে সোজা আবার হুগলীতে নিশ্চিত আশ্রয়ে । ফেলে গেলেন কামান বন্দুক গোলা বারুদ সব কলকাতায়। ক্লাইভ আর ওয়াটসন পুনর্বার কলকাতার দখল নিলেন ১৭৫৭ সালের ১ লা জানুয়ারি। 
   দিন পেরিয়ে যায়।সওদাগর ইংরেজদের হাতে ভারতের রাজদন্ড। সালটা ১৯২২-২৩ হবে। পুরনো ফোর্ট উইলিয়াম যেটা এখনকার জিপিও থেকে শুরু হয়ে ফেয়ারলি প্লেসের ইস্টার্ন রেলওয়ে অফিস অবধি ছিলো, তাকে ভেঙে ফেলে নতুন সব বাড়ি বাড়ি প্রাসাদ করা হচ্ছে সেখানে। ফুটপাথ তৈরি হচ্ছে, নতুন রাস্তা তৈরি হচ্ছে। এখন সেই মতন স্ট্র‍্যান্ড রোডের ফুটপাথ, ফেয়ারলি প্লেসের ফুটপাথ তৈরি হচ্ছে। একদিন রাস্তার সাবগ্রেড করবার সময় খুব খোঁড়াখুঁড়ি হচ্ছে। দেখা গেল ওই ফেয়ারলি প্লেসের ভাবী ফুটপাতের নীচে একটা কামানের মুখ দেখা যাচ্ছে। সুপারভাইজার, সাইট ইনচার্জ সাহেব এলেন। অর্ডার হলো কামানটা খুঁড়ে বার করো। কারণ ওখানেই ছিলো পুরনো দুর্গের উত্তর- পূর্বের বুরুজের অংশ। যাই হোক কামান তো মাটির নীচ থেকে এলেন ওপরে। শুধু কামান নয়, কিছু গোলা ও রয়েছে কাছাকাছি দেখা গেল। সবাই ওপরে এলেন। রাখা হল রাস্তার ওপারে আর এক বাড়ির বারান্দায়।  শুরু হল সাহেবী তদন্ত। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা এলেন। এদিকে সারা কলকাতা থেকে কাতারে কাতারে লোক আসছে ওই কামান আর গোলা দেখতে।
বিশেষজ্ঞ কমিটি জানালেন অবশেষে যে এই কামানটি ইংরেজদের বিলেত থেকে আনা কামান নয়। সে কামান অন্য রকম। এই কামান লম্বায় অনেক বড়, আকৃতিও অন্য রকম। আর এই কামান তো বানায় মুর্শিদাবাদ,  নদীয়া আর বীরভূমের কারিগররা। তাদের নকশা খোদাই করা আছে কামানের  ওপরে। তবে কি এই কামান সিরাজ উদ দ্দ্যৌল্লা আর মাণিকচাঁদের ফেলে যাওয়া কামান! হয়তো মাণিকচাঁদ দূর্গের উত্তর পূর্ব বুরুজের কাছে কামান বসিয়ে সুরক্ষার আয়োজন করেছিলেন। পরে সাহেবদের উল্টো তাড়া খেয়ে সে সব আর নিয়ে যেতে পারেননি।
🍂

   ভারতীয় যাদুঘর আর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালকে অনুরোধ করা হলো কামান আর গোলা নিয়ে যাবার জন্য যাতে প্রদর্শন করা যেতে পারে সেখানে। কিন্তু তাঁরা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলেন। এরমধ্যে এক সকালে দেখা গেল সব গোলা হাওয়া এই পাহারার মধ্যে। তবে কামানের কি গতি হবে? আদেশ হলো স্ট্র‍্যান্ড রোডের আর ফেয়ারলির মোড়ে স্ট্র‍্যান্ড রোডের ফুটপাথের ওপর দাও কামানটা গেঁথে।  মুখটা থাকবে ওপরে। সেই  থেকে সেই কামান আজও সেইভাবেই আছে।
  আবার কিছু তথ্যানুযায়ী,
২০০৯ সালে মেয়ো হাসপাতালের কাছে মাটি খুঁড়তে গিয়ে দু’টি কামান পাওয়া গিয়েছিল দশ বছর পড়ে থাকার পর জোড়াবাগান, নিমতলা ঘাট স্ট্রিটে সেগুলি সংরক্ষিত হয়। ২০১৭'এ হরিণঘাটায় পাওয়া যায় প্রাক্ মুঘল যুগের ব্রোঞ্জ কামান। সম্প্রতি সরকারি আধিকারিক বিপ্লব রায় সেটি নিজের অফিসে আনেন। টিপু সুলতান শাহি মসজিদে আছে ষোলো কামান, চোদ্দটি কামান আলোকস্তম্ভে পরিণত হয়েছে । ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের অলঙ্কৃত ব্রোঞ্জ কামানের বাংলা হরফ জানায়, সেটি নদিয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের আমলে তৈরি। আর এই প্রতিটি শনাক্তকরণেই  জন্য ডাক পড়ে শহরের কামান ও অ্যান্টিক বন্দুক বিশেষজ্ঞ অমিতাভ কারকুন-এর । প্রসঙ্গত, শিকার কাহিনি থেকে আগ্নেয়াস্ত্রের বিবর্তন নজরে আসে তাঁর, ক্রমে পেয়ে বসে বারুদ আবিষ্কার ও আগ্নেয়াস্ত্রের ইতিহাস নিয়ে জানার নেশা। বিভিন্ন সংগ্রহশালা ও দুর্গে রাখা কামান, বন্দুকের অনুসন্ধান ও গবেষণা শুরু করেন তিনি।
   এবার আসি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি কামান উদ্ধারের ঘটনায়। সকাল থেকেই এলাকায় রটে গিয়েছিল কামান উদ্ধারের কথা। দমদম সেন্ট্রাল জেলের প্রবেশদ্বারের সামনে থেকে উদ্ধার করা হবে মাটিতে গেঁথে থাকা প্রাচীন যুগের কামান। কয়েকশো বছরের পুরোনো কামান উদ্ধারের সাক্ষী থাকতে সকাল থেকেই যশোহর রোডে ভিড় করেছিলেন বহু মানুষ।
সূত্রের খবর, মাটির নীচে থাকা কামান উদ্ধারের জন্য  সপ্তাহ তিনেক ধরে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। দুই শতাব্দীর বেশি প্রাচীন এই বিশালাকার কামান উদ্ধারের উদ্যোক্তা তথা রাজ্যের অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জেনারেল অ্যান্ড অফিসিয়াল ট্রাস্টি (এজিওটি) বিপ্লব রায় বলেন, 'কামানটি ১০ ফুট ৮ ইঞ্চি লম্বা। দৈর্ঘ্যের নিরিখে যা এখনও পর্যন্ত কলকাতার সব চেয়ে বড় কামান।'
গত ১৫ মার্চ, ২০২৩ প্রথম খনন শুরু হয়।
 কিন্তু দেড় ফুট মাটি খুঁড়তেই শুরু হয় বিপত্তি। মাটির নীচে সিইএসসি-র অসংখ্য হাই ভোল্টেজ বিদ্যুতের কেবল। তাই, তখন কামানের শুধু ৫ ফুট বার করা গিয়েছিল। তার পর দফায় দফায় খনন হয়।  শুক্রবার, ৩১ মার্চ,২০২৩ তারিখে ফের খনন চলে। কিন্তু বার বার বাধা হয়ে দাঁড়ায় বিদ্যুতের কেবল। পরের 
বুধবার দুপুরে সিইএসসি কর্তৃপক্ষ ফের খনন শুরু করেন। ঘণ্টা দেড়েকের
চেষ্টায় মাটি সরিয়ে ক্রেনে করে কামানটি তোলা হয়। কামানটিকে মিনি ট্রাকে করে এ দিনই নিউ সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এবারও কামান ও অ্যান্টিক বন্দুক বিশেষজ্ঞ অমিতাভ কারকুনের ওপর দায়িত্ব বর্তায় ও তিনি বক্তব্য রাখেন , 'কামানটি অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা গিয়েছে, এটা বড় প্রাপ্তি। মনে হচ্ছে, ১৭৬০ থেকে ১৭৭০ সালের মধ্যে কামানটি তৈরি হয়।'
   মাটি খুঁড়ে যখন এমন কিছু যুদ্ধ বিদ্রোহের প্রাণহারি স্মৃতি চিহ্ন উঠে আসে, বাঙালির জনমানসে যেন ভেসে ওঠে ইতিহাসের পাতার সেই রাজতন্ত্রের ছবি গুলো।

Post a Comment

1 Comments