জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোক গল্প-- এঙ্গোলা (দক্ষিণ আফ্রিকা) /চিতার চোখে জলের দাগ/ চিন্ময় দাশ

শিল্পী - শুভম দাস 

দূরদেশের লোক গল্প-- এঙ্গোলা (দক্ষিণ আফ্রিকা) 
চিতার চোখে জলের দাগ 
চিন্ময় দাশ 

অনেক অনেক কাল আগের কথা। একটা গাছের ছায়ায় বসে আছে একটা লোক। শিকারে এসেছে লোকটা। মানুষটা কিন্তু মোটেই সুবিধার নয়। যেমন অলস, তেমনি ধুর্ত। 
সামনে একটা খোলা মাঠ। এক পাল কৃষ্ণসার হরিণ চরে বেড়াচ্ছে। যেমন হৃষ্টপুষ্ট, তেমনি দেখতেও ভারি সুন্দর। তবে, হরিণগুলো আছে অনেকটাই দূরে। শিকার করতে হলে, বেশ খানিকটা কাছাকাছি যেতে হবে। 
কিন্তু সরাসরি তো যাওয়া যাবে না। লম্বা দৌড় লাগিয়ে, হরিণও তাতে আরও দূরে সরে যাবে। সেয়ানা কম নয় ওরাও। একটাই উপায়, যেতে হবে ঝোপের আড়াল রেখে। সেও কম কসরতের কাজ নয়। 
এখানে ঝোপ তেমন উঁচু নয়। ফলে, যেতে হবে হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে। নইলে, হরিণের চোখে পড়ে যেতে হবে। হয়েছে কী, এগুলো আবার কাঁটাগাছের ঝোপ। তার উপর গরমটাও পড়েছে জব্বর। হামাগুড়ির কাজটা খুবই হয়রানির।
এই হয়রানির কথা ভেবেই, গা করছে না লোকটা। চুপটি করে বসে আছে। মনের ভাবনা, এক-আধটা হরিণ যদি দলছুট হয়ে চলে আসে এদিকে। তাহলেই কেল্লা ফতে। পরিশ্রম হোল না। শিকারও হয়ে গেল। 
হঠাৎই একটু যেন সর-সর আওয়াজ। ভারি হালকা শব্দটা। ভয়ে গা সিরসির করে উঠল লোকটার। আড়চোখে চেয়ে দেখল, ডানদিকের ঝোপের আড়ালে কিছু একটা নড়ে উঠল। চিতা নয় তো?
চোখ সরু করে চেয়ে রইল। হ্যাঁ, যা ভেবেছে ঠিক তাই। একটা মা-চিতা। বাচ্চাও আছে সাথে। সেও হরিণের পালটার দিকে তাক করে বসে আছে সুযোগের অপেক্ষায়।
কিছুক্ষণ বাদে এগোতে শুরু করল চিতানি। এগোচ্ছে, তবে খুবই সতর্কভাবে। একেবারে বুকে হেঁটে। খুব ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। তবে নিজেকে ঝোপের আড়ালে রাখছে সব সময়। চোখ আটকে রেখেছে হরিণগুলোর ওপর। 
শিকারী অবাক হয়ে দেখল, একটা হরিণ বোকার মতো আলাদা হয়ে  পড়েছে দল থেকে। বুঝতে দেরি হোল না, মরণ খেলা করছে ওটার কপালে।
চিতানিরও চোখ আটকে গেছে হরিণটার ওপর। এবার সরু সরু লম্বা পাগুলোকে পেটের তলায় গুটিয়ে নিল চিতানিটা। সামান্য আগুপিছু করল শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে। তার পরেই আচমকা একটা লাফ। একেবারে ধনুক থেকে ছিটকে বেরোনো তীরের মতোই।
হরিণটাও কিছু আঁচ করে দৌড় লাগিয়েছে। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। অনেকটা দৌড়েও, চিতার সাথে পেরে ওঠা হোল না বেচারার। একেবারে ঘাড়ে এসে পড়ল চিতাটা। টুঁটি কামড়ে চেপে ধরে থাকল। 
হাঁফাতে হাঁফাতে মাঠের  কিনারা পর্যন্ত হরিণকে টেনে নিয়ে এল চিতানি। একটা ছায়ামত জায়গায় এসে, খানিক থামল। দম নিচ্ছে টেনে টেনে। 
বসে বসে চিতানির বুকের ওঠা-নামা দেখছে শিকারি। যে গতি আর দক্ষতা দেখাল বাঘটা, বিস্মিত হয়ে দেখবার মত। 
🍂

ঝোপের দিকে চেয়ে দেখল, তিন-তিনটা বাচ্চা আছে বাঘিনীর। তারা তিনটিও মাথা উঁচিয়ে দেখছে মায়ের শিকার করার দৃশ্য। বাচ্চাগুলো অপেক্ষা করে আছে, কখন মা ফিরবে খাবার নিয়ে।
অলস লোকের হিংসেটা বেশিই হয়। অন্যেরা সুখে আছে দেখলে, গা জ্বলে যায় তাদের। এখন তিনটে বাচ্চার ওপর হিংসা হতে লাগল শিকারির।  কেমন সুন্দর মা শিকার করে আনছে, আর বসে বসে আরাম করে খাচ্ছে তিনটিতে। 
লোকটার মনে হোল, তার নিজেরও যদি এরকম একটা শিকারি থাকতো! তাহলে, শিকার করে আনবার ঝূটঝামেলা সে-ই পোহাত। তাকে নিজেকে আর এসবের দায় পোয়াতে হোত না।
এবার ধূর্তামি চেপে বসল লোকটার মাথায়। ভাবতে ভাবতে একটা দুষ্টু বুদ্ধিও এসে গেলো। খুব ভালো করেই জানে, চিতা সহজে মানুষকে আক্রমণ করে না। তাহলে আর চিন্তা কীসের? চুপিসারে একটা বাচ্চাকে সরিয়ে নিলে কেমন হয়? 
বাচ্চাটা বড় হবে। একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নিলেই হোল। সেই বাচ্চাই তখন শিকার করে আনবে। নিজেকে আর কষ্ট করতে হবে না তখন। 
ভাবতে গিয়ে মনে বেশ পুলক হোল। এদিকে চিতানি আর তিন বাচ্চা মিলে, ভোজ লাগিয়ে দিয়েছে। সুযোগের অপেক্ষা করতে লাগল শিকারি। 
খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল চিতানি। হেলতে দুলতে চলে গেল সেখান থেকে। বাচ্চা তিনটে খাচ্ছে আর হুটোপাটি করছে নিজেদের মধ্যে। 
চিতানি নিশ্চয়ই জল খেতে গেল নদীতে। তার মানে, সময়ও নেবে খানিকটা। এটাই মোক্ষম সুযোগ। সন্ধ্যেও নেমে আসছে এদিকে। বল্লমটা শক্ত মুঠোয় ধরে, ঝোপটার কাছে পৌঁছে গেল দ্রুত পায়ে। 
তুলতুলে তিনটে বাচ্চা। খেলা করছে নিজেদের মধ্যে। দৌড়ে পালাবে, তেমন জোর হয়নি এখনও তাদের নরম পাগুলোতে। কিন্তু একটা ফ্যাসাদে পড়ে গেল লোকটা। তিনটের মধ্যে কোন ছানাটাকে নেওয়া যায়? বড় হয়ে বেশি তাগড়াই হবে কোনটা? কী করে বাছা যায়? ভেবে ওঠা যাচ্ছে না। 
দূর ছাই, অতো ভাবাভাবির কী আছে? তিনটাকেই নিয়ে চলে যাই। সব ঝামেলা চুকে যায় তাতে। তাছাড়া, একটার চেয়ে তিন-তিনটা শিকারি থাকলে, দারুণ কাজ হবে। দিন কাটানো যাবে একেবারে রাজার হালে। 
যেমন ভাবা, তেমন কাজ। তিনটে বাচ্চাকেই তুলে নিয়ে, চটপট সরে পড়ল সেখান থেকে।  
মা-চিতা ফিরে এলো জল খেয়ে। কিন্তু বাচ্চারা কোথায়? একটাকেও চোখে পড়ছে না। এদিকে ছোটে। ওদিকে ছোটে। চিহ্নটুকুও নাই কোত্থাও। একটা নয়। দুটো নয়। তিন-তিনটে বাচ্চা! একেবারে হাওয়ায় উড়ে যাবে না কি? 
চোখে অন্ধকার দেখছে চিতানি। পাগলের মত ছুটে বেড়াতে লাগল চারদিকে। বুক ফেটে যাচ্ছে যন্ত্রনায়। 
তখন শুরু হোল তার কান্না। চিৎকার করে কাঁদতে লাগল বাঘটা। কাঁদতেই লাগল। সন্তান হারানো মায়ের কান্না! তার কান্নার শব্দে বন-মাঠের আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে রাত ফুরিয়ে গেল।
রাত গিয়ে, ভোরও হোল এক সময়। দিনের আলো ফুটে উঠল। কিন্তু কান্নার বিরাম নাই। বিরাম হবে কেন? দিনের আলোতেও বাচ্চাদের কোন হদিস পেল না কোথাও। বনজঙ্গল কাঁপিয়ে বিলাপ করতে লাগল বাঘিনী। গাল ভেসে যেতে লাগল চোখের জলের অবিরল ধারায়। 
কান্নার শব্দটা এত তীব্র, গাঁয়ের মানুষরাও শুনতে পাচ্ছে। শুনতে পাচ্ছে, কিন্তু কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। এমন করে বুক ফাটা কান্না কাঁদে কে? কাঁদেই বা কেন?
বেলা বাড়তে, গাঁয়ের মোড়ল এসে হাজির হোল। বুড়ো মানুষ। দেখেছে অনেক, শিখেছেও অনেক। বনের জীবদের সম্পর্কে তার অগাধ জ্ঞান। তেমনি মমতাও খুব তাদের জন্য। 
কাল রাতে অনেক ক্ষণ ধরে বাঘটার কান্না শুনেছে মোড়ল। তার মনে হয়েছে, বাঘটার বাচ্চার কিছু হয়েছে। বাচ্চা মরে গেলে তো এমন করে কাঁদে না বনের কোন প্রাণীই। নিশ্চয় খুঁজে পাচ্ছে না বাচ্চাকে। এছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। 
মোড়লকে আসতে দেখে, এক এক করে লোক জুটতে শুরু করল। ক’জন জোয়ান ছেলেকে ডেকে বুড়ো বলল—ভালো করে খুঁজে দ্যাখো তো, গ্রামে কোথাও ঢুকে পড়েছে নাকি কোন বাঘের বাচ্চা?
ছেলের দল বেরিয়ে পড়ল বাঘের বাচ্চার সন্ধান করতে।  বেশি সময় গেল না, ফিরেও এল খানিক বাদেই। তারা বলল—একটা নয়, মোড়ল। তিনটে চিতার ছানা ধরে এনেছে শিকারিটা। 
ভীষণ রাগ হোল মোড়লের। আদিবাসি সমাজের নিয়ম-রীতি ভেঙেছে লোকটা। অনেক লোক জড়ো হয়েছে আশেপাশে। মোড়ল বলল—পেটের জন্য বাঘকে যেমন খাবারের জোগাড় করতে হয়, তেমনি আমাদেরও। কিন্তু সেটা করতে হয় বুদ্ধি আর শক্তি দিয়ে। চুরি করে নয়। 
একটু থামল বুড়ো। রাগে গরগর করছে মানুষটার গলা। আবার বলল—এটা আমাদের সমাজের নিয়মের বাইরে। গোটা আদিবাসি সমাজের অমর্যাদা এটা। তার চেয়েও বড় একটা কথা আছে। মায়ের কোল খালি করে বাচ্চা তুলে আনা, জঘন্য অপরাধ। এর কোন মাপ নাই। 
গাঁয়ের লোকেরা সবাই সায় দিল মোড়লের কথায়। মোড়ল বিধান দিয়ে দিল—এ গ্রামে আর থাকতে দেওয়া হবে না শিকারি লোকটাকে। আর একটা কথা। বাচ্চা তিনটাকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেব আমরা।
হইহই করে উঠল গাঁয়ের লোকজন। সবাই খুশি। সবাই সমর্থন করল মোড়লের বিধান দুটিকে।
পাঁচজন ছেলে আবার ছুটল শিকারির বাড়ি। চিতার বাচ্চাগুলোকে তুলে নিয়ে এলো।  
বিচার শেষ হয়েছে। বাচ্চাগুলোকেও নিয়ে আসা হয়েছে। তিনটে চিতার ছানা কোলে। মোড়ল চলল বনের দিকে।
একটা ঝোপের কাছে বসে ছিল চিতানি। কেঁদে কেঁদে আর ছুটে ছুটে শরীর এলিয়ে গিয়েছে বেচারির। বুড়োর আসবার শব্দে চমকে তাকাল চোখ তুলে। 
সেখানে আরও বড় চমক অপেক্ষা করছিল তার জন্য। চিতানি অবাক হয়ে দেখছে, তার হারিয়ে যাওয়া তিনটি বাচ্চা ফিরিয়ে এনেছে একটা বুড়ো মানুষ। 
ছিটকে উঠে দাঁড়াল চিতানিটা। বিশ্বাসই হচ্ছে না যেন তার। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আনন্দে বুক ফেটে যাচ্ছে মায়ের। 
এখন এক ফোঁটা জলও গড়াচ্ছে না চোখ দিয়ে। গড়াবেই বা কী করে? সারা রাত কেঁদে কেঁদে সব জল গড়িয়ে গিয়েছে চোখ থেকে। কেবল মুখে একটা বাঁকা দাগ ফুটে আছে চিতার। 
দু’চোখের কোণ থেকে দুই গাল বেয়ে, জল গড়িয়ে নেমেছিল একেবারে চিবুক পর্যন্ত। আজও চিতার দু’গালে দুটো কালো দাগ দেখতে পাওয়া যায়। সেটা এক সন্তান হারানো মায়ের বুকফাটা কান্নার চিহ্ন।

Post a Comment

1 Comments