জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক রাধাকমল মুখোপাধ্যায় /নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক রাধাকমল মুখোপাধ্যায়
নির্মল বর্মন

অধ্যাপক রাধাকমল মুখোপাধ্যায় লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রাবন্ধিক ১৮৮৯ এর ৭ ডিসেম্বর মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে জন্মগ্রহণ করেন। রাধাকমলের পিতা ব্যারিস্টার ছিলেন,  সুতরাং পারিবারিক লাইব্রেরীতে ইতিহাস, সাহিত্য, আইন এবং সংস্কৃত গ্রন্থ সমৃদ্ধ ছিল। সাহিত্যিক রাধাকমল মুখোপাধ্যায় কৃষ্ণনগর কলেজে পড়ার পর প্রেসিডেন্সি কলেজে একাডেমি বৃত্তি লাভ করেন। ইতিহাস ও ইংরেজি তে অনার্স ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন। কর্মজীবনে অর্থনীতি ও সমাজবিদ্যার অধ্যাপক হিসাবে কাজ করেছিলেন।
সাহিত্যিক রাধাকমল  অর্থনীতি ও সমাজ বিজ্ঞানকে পাথেয় করে প্রকৃত অর্থে ছিলেন ট্রান্সডিসিপ্লিনারি পদ্ধতির পথপ্রদর্শক।
১৯৬৮ সালের ২৪শে আগস্ট শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
   প্রাবন্ধিক ও বিশিষ্ট অর্থশাস্ত্র, সমাজতাত্ত্বিক ও  'উপাসনা' পত্রিকার সম্পাদক রাধাকমল মুখোপাধ্যায় অর্থনীতি ও সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক হলেও বাংলা সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল। তার প্রমাণ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সাহিত্য সংস্কৃত বিষয়ক নানা স্বাদের ও নানা ভাবনার প্রবন্ধ।
সাহিত্যিক রাধাকমল মুখোপাধ্যায় রচিত গ্রন্থ গুলি হল:-
  "বর্তমান বাংলা সাহিত্য" , " মনোময় ভারত" ," তরুণের ভারত" ,  "দরিদ্রের ক্রন্দন" ,  "শাশ্বত ভিখারী" , "শিক্ষা সেবক" ,  "পল্লীপ্রচারক" , " বিশ্বভারত" ( দুটি খন্ড)।
এছাড়াও ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার স্বরূপ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন । উদাহরণ:-
    " Democracies Of the East" , "A stydy in comperative politics" , "Theory & Art of Mysticism" , "The Social Structure of values" , "The Calture and Art of India" ইত্যাদি।
    প্রাবন্ধিক রাধাকমল মুখোপাধ্যায় এর "বর্তমান বাংলা সাহিত্য"  গ্রন্থে 'সাহিত্যে বাস্তবতা' প্রবন্ধে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ  খন্ডন করে উত্তর দিয়েছেন। প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত লোকশিক্ষক বা জননায়ক প্রবন্ধ প্রকাশের পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্র পত্রিকায় কাব্যের বাস্তবতা প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক রাধাকমল মুখোপাধ্যায়ের সমালোচনা করেছিলেন।
🍂

রবীন্দ্রনাথের অভিমত ছিল - 'সাহিত্য স্কুল মাস্টারের ভার নেয়নি , কিংবা লোকশিক্ষার কি হবে তার জবাবদিহিও সাহিত্যের কাজ নয়'। প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথের এই বহু বিখ্যাত অভিমত কে বিশ্লেষণ করে রাধাকমল লিখেছেন
    "সাহিত্য আপনার সৃষ্ট আনন্দে বিভোর হইয়া থাকিলে চলিবে না। প্রায়ই দেখা যায়, যখন সাহিত্য আপনার সৃষ্ট আনন্দের তৃপ্তি লাভ করে, সমাজ প্রকৃতির সহিত আত্মীয়তা ও ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ হইতে আনন্দলাভ করে না, তখন সে সাহিত্য ধীরে ধীরে সমাজের সহিত তাহার নিগূঢ় সম্বন্ধ হারাইয়া আত্মম্ভরিত্ব দোষে দুষ্ট হয়"
    প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথের রসের নিত্যতা সম্বন্ধে উপাচার্য রাধাকমল মুখোপাধ্যায়ের মত হল:-
   "কাব্য স্থায়ী হয়,  নিত্য- রস ও নিত্য বস্তুর গুণে" !  তিনি আরও বলেছেন,  " রবীন্দ্র বাবু বলিয়াছেন,  'বাস্তবের হট্টগোলের মধ্যে পড়িলে কবির  কাব্য হাটের কাব্য হইবে'। বাস্তবকে হট্টগোল বলিয়া উড়াইয়া দিলে সাহিত্যের ধ্রুব আদর্শ বিকাশ লাভ করিবে না"। 
রবীন্দ্রনাথের অভিমত সাহিত্য স্কুল মাস্টারের ভার নেয়নি। সুতরাং তার উত্তরে প্রাবন্ধিক রাধাকমল উত্তরে লিখেছেন যে " সাহিত্য যে ইস্কুল মাস্টারের ভার লইবে, সমাজের দীক্ষাগুরু হইবে ইহা ঠাট্টা বা বিদ্রূপের বিষয় নহে। সাহিত্যের পরম সৌভাগ্য, সাহিত্যের চরম সার্থকতা যদি সে সমাজের গুরুর স্থান অধিকার করতে পারে। খ্রিস্ট, সেন্ট পল, বুদ্ধ , চৈতন্য সমাজের শুরু হইয়াছিলেন , এখন সাহিত্যিকগণ গুরু হইতেছেন,-- 
 কার্লাইল, রাস্কিন, টলস্টয় সমাজের শিক্ষা ও শিক্ষার ভার লইয়াছেন"। 
 এ প্রসঙ্গে বার্ণাড শ টলস্টয় কে চিঠি প্রেরণ করেছিলেন, তাতে তিনি উল্লেখ করেছেন----
      "I am not an Art for Art sake man, and could not little finger to produce to work of art if I thought there was nothing more than that in it"?
         সুতরাং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে জগতে রবীন্দ্রনাথ অবিসংবাদিত সাহিত্যিক। প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যের বিশ্লেষণ করে যুক্তির   মাধ্যমে প্রাবন্ধিক রাধাকমল মুখোপাধ্যায় যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন যে, রবীন্দ্রনাথের রাজা , ডাকঘর  ও অচলায়তন ইস্কুল মাস্টারের ভার গ্রহণ করেছে---"অচলায়তনে রবীন্দ্রনাথবাবু গুরুমহাশয়ের বেত্রদণ্ড লইয়া সমাজকে কষাঘাত করিতে সংকচ অনুভব করেন নাই" । আসলেই রবীন্দ্র সর্বস্ব সাহিত্য ভাবনার বিরুদ্ধে প্রাবন্ধিক রাধাকমল মুখোপাধ্যায় বক্তব্য পরিবেশন করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে যথেষ্ট মর্যাদার স্থান অর্জন করতে পেরেছিলেন। তাই বিস্মিতপ্রায় সাহিত্যিক হয়েও প্রাবন্ধিক রাধাকমল মুখোপাধ্যায় বাংলার সারস্বত পাঠক সমাজে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

Post a Comment

1 Comments