জ্বলদর্চি

প্রথম মহিলা বাঙালি পদার্থবিদ ড. বিভা চৌধুরী /পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী — ৮৬

বিভা' – অন্য আকাশের তারা-২

প্রথম মহিলা বাঙালি পদার্থবিদ ড. বিভা চৌধুরী 

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

এক
বিশ শতকের গোড়ার কথা। ঔপনিবেশিক বাংলার সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, মনন, সংষ্কৃতি থেকে জীবনবোধ – সর্বত্র আলোড়ন, রূপান্তর তথা জাগরণের স্পষ্ট ছাপ। বিদগ্ধ সমাজ ও অসীম ক্ষমতাধর নিষ্ঠুর প্রশাসনের মধ্যে এক অসম লড়াই। লড়াই আপাতত একপেশে। সে লড়াই মূলত শক্তের বিপরীতে নরমের অধিকারের লড়াই। সুষ্ঠু বেঁচে বর্তে থাকার লড়াই। স্বাধীনতার লড়াই। আত্মসম্মানের লড়াই। এ লড়াই নিজের মেরুদন্ড সোজা রেখে আত্মবিশ্বাস জাগরণের লড়াই। এর সঙ্গে যুক্ত হল আরও এক লড়াই! পুরুষ শাসিত সমাজে অবলা নারীর পট পরিবর্তনের রূপকথার উত্থান। নারী শিক্ষা ও অধিকারের উত্তোরণের গল্প। বিদ্যায়তনিক পরিমণ্ডলে একজন নারীর বেড়ে ওঠা ও অগ্রগমন বজায় রাখার অনন্ত সংগ্রাম। একজন নারী হয়ে লড়াই বজায় রাখা বেজায় কষ্টের। আকাশের নীহারিকা ছোঁয়ার লক্ষ্যে অবলা নারীর অদম্য স্পৃহা পুরুষ তান্ত্রিকতার মুখে এক স্পর্ধিত হুঙ্কার। অথচ আজীবন অবহেলা আর নিরন্তর তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের মধ্যে জীবন অতিবাহিত হওয়াই যেখানে ভবিতব্য, সেখানে পঁচা নর্দমার মধ্যে থেকে হঠাৎ যে একখান অপূর্ব সুন্দর পদ্মফুল জন্ম নেবে – কে জানত? সারাজীবন সমাজের অর্ধাংশকে দমিয়ে রাখার কৌশলের বিরুদ্ধে এক নারীর দৃষ্টান্তমূলক লড়াই বাকি সমাজের অনুপ্রেরণা জোগায়। বাল্যকাল থেকে অন্তঃপুরের বাইরের জগত দেখার ও জানার তাঁর অদমনীয়‌ কৌতুহল। অথচ, বিশ শতকের গোড়াতেও বাল্যবিবাহের সমস্যা বেশ প্রকট ছিল ভঙ্গুর সমাজে। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে নারীর শিক্ষা দীক্ষা ও স্বাধীনতা ছিল দূর গ্রহের জীব। কখনও ফলপ্রসূ হবার চান্স বেজায় কম। সর্বত্র বাধা বিপত্তি। এবং রক্ত চক্ষুর আস্ফালন।

এ হেন অন্তঃপুরবাসী বাড়ির অন্দরমহল থেকেই একদিন বেরিয়ে পড়ল সফলতার সাদা বিড়াল। মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুঁড়ে দিল এ বিরাট বিশ্ব ভুবনে। সেই সাফল্যের আরেক নাম বিভা। বিভা চৌধুরী। ডক্টরেট। প্রথম মহিলা বাঙালি বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী। আর পাঁচটা সাধারণ বাঙালি মেয়ের মতোই কেটেছে তাঁর মেয়েবেলা। যদিও তাঁর বর্ণময় জীবনের পরতে পরতে অবহেলা আর মনখারাপের আকাশ সমান দিনলিপি। পাহাড় প্রমাণ প্রতিবন্ধকতার আগ্নেয় স্তুপ। অথচ হাজার একটা বাধার মধ্যেও তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ। সাধারণের মধ্যে অসাধারণীয় রূপকথার উত্তোরণ। 

দেশে তখন ইংরেজ শাসন অব্যাহত। অসাধু শ্বেতাঙ্গ শাসকদের অত্যাচারে অতিষ্ট সাধারণ মানুষ। দিকে দিকে স্বাধীনতার বাণী ধ্বণিত হচ্ছে দেশের যুবসমাজের কণ্ঠে। শত শত তরুণ দ্বিধাহীন ঝাঁপিয়ে পড়ছে স্বাধীনতা আন্দোলনে। ইংরেজের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে বাংলাকে দুভাগ করার ব্রিটিশের কুটিল চক্রান্ত ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের বিপ্লবীগণ। মাথার উপর বিশ্ব রাজনীতি কালো মেঘে ঢেকে যাওয়ার উপক্রম। অন্ধকার সময়ের ভ্রুকুটি। সবমিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ জটিল ও কঠিন হয়ে পড়ছে দিনকে দিন। এ হেন প্রেক্ষাপটে বিভা চৌধুরীর জন্ম ১৯১৩ সালের ৩রা জুলাই কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে। দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। লক্ষ্মীবারে চৌধুরী বাড়িতে যেন সাক্ষাৎ এক লক্ষ্মীর আগমন ঘটল। বাবা বঙ্কু বিহারী চৌধুরী একজন প্রথিতযশা নামকরা ডাক্তার। মা ঊর্মিলা দেবী। সবমিলিয়ে পাঁচ কন্যা ও একজন পুত্র সন্তান নিয়ে তাদের ভরা সংসার।
     
বাবা বঙ্কু বিহারী চৌধুরী ছিলেন জমিদার বাড়ির ছেলে। হুগলি জেলার ভাণ্ডারহাটি গ্রামে ছিল তাদের আদি নিবাস। তাঁর শরীরে বইছে জমিদারি রক্ত। কিন্তু তিনি নিজে আদ্যপান্ত উদার প্রকৃতির মানুষ। জাত-ধর্ম-বর্ণ'র ভেদাভেদ তাঁর ধাতে নেই। অথচ, তাঁর পরিবার ছিল গোঁড়া জমিদার। গাঁ গঞ্জে তাদের জমিদারির দারুণ প্রতাপ। বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায়। উল্টোদিকে, মা ঊর্মিলা দেবী ছিলেন গিরিশচন্দ্র মজুমদারের কন্যা। তাঁরা সব ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে যুক্ত। ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনের অনুসারী ঊর্মিলা দেবীর পুরো পরিবার। ব্রাহ্ম সমাজে আক্ষরিক অর্থে এমন পুরুষদের সম্প্রদায়কে বোঝায় যারা ব্রাহ্ম সম্পর্কে জ্ঞান রাখে। চূড়ান্ত বাস্তবতা এর ভিত্তি। বাস্তবে ব্রাহ্ম সমাজ জাতপাত, ধর্ম কিংবা ধর্মের মধ্যে ভেদাভেদ করে না। এটি ছিল ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী ধর্মীয় আন্দোলন এবং আধুনিক ভারত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এ হেন উদারনৈতিক মানসিকতার ব্রাহ্ম সমাজের মধ্যে ঊর্মিলা দেবীর বড় হয়ে ওঠা। ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে আধুনিকতার বীজ বপন হয়েছিল অজান্তে। সেই ঊর্মিলা দেবীর সঙ্গে সাত পাকে বাঁধা পড়লেন বঙ্কু বিহারী চৌধুরী। ঊর্মিলা দেবীকে বিয়ে করে তিনি ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে গেলেন। ওদিকে, ভাণ্ডারহাটির জমিদার বাড়িতে তখন হৈ চৈ কাণ্ড। হুলস্থুল ব্যাপার ঘটে গেল। গোঁড়া জমিদার বাড়ি এ বিয়েতে নিমরাজি। শেষমেশ ফলাফল কী? চিকিৎসক বঙ্কু বিহারী বাবু তাঁর পারিবারিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হলেন। মনের কষ্ট বুকের ভেতর চাপা রইল। চার বোন ও এক ভাইয়ের সঙ্গে বড় হতে থাকলেন বিভা চৌধুরী। তাঁর এক বোন রমা চৌধুরী ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়ে শিক্ষিকা হয়েছিলেন। তাঁর মাসি নির্মলা দেবী বিবাহ করেছিলেন কলকাতার বিখ্যাত চিকিৎসক স্যার নীলরতন সরকারকে, যাঁর নামানুসারে ক্যামবেল মেডিকেল কলেজের নামকরণ হয় নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল (সংক্ষেপে, এন আর এস মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল)। 
      
শিশুকাল থেকেই বিভা চৌধুরী অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তাঁর লেখাপড়া বেথুন স্কুলে। স্কুলে পড়াশুনার সময় থেকে তাঁর বিদ্যার স্ফুরিত দ্যুতি টের পায় সবাই। ছেলে শিক্ষার্থীদের মাঝে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি আলাদা নজর কাড়ে ক্লাসে। বিজ্ঞানের বিষয়গুলোয় তুখোড় সে। অল্প সময়ে সব টিচারদের প্রিয় বনে যায়। সফলভাবেই বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার করে ফেলে সে। তারপর হাট করে খুলে যায় কলেজের দরজা। তাঁর প্রিয় বিষয় ফিজিক্স। পদার্থবিদ্যায় তাঁর দখল কল্পনাতীত। প্রিয় বিষয়ে অনার্স সহযোগে সে ভর্তি হয় কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে। সেখানেও রীতিমতো ভালো রেজাল্ট। ১৯৩৪ সালে বিএসসি ডিগ্রি অর্জনের পর তাঁর প্রবল ইচ্ছা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ। পাখির চোখ ফিজিক্সে মাস্টার ডিগ্রি। সেবছর কলেজ পাশের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে পদার্থবিদ্যায় ভর্তি হল সে। ১৯৩৪ - ১৯৩৬ শিক্ষাবর্ষে মাস্টার ডিগ্রির ক্লাসে সর্বসাকুল্যে ২৪ জন স্টুডেন্টের মধ্যে একমাত্র মহিলা বিদ্যার্থী সে। স্বভাবতই তাঁর উপস্থিতি সহজে নজরে পড়ে মাস্টার মশাইদের। ১৯৩৬ সালে রেজাল্ট বের হয়। এবারেও তাঁর নজর কাড়া সাফল্য। এ পর্যন্ত মাত্র তৃতীয় মহিলা হিসাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করলেন তিনি। 

দুই

সময়টা ছিল ১৯৩৯ সাল। বিশ্ব রাজনীতির টালমাটাল এক সন্ধিক্ষণ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের তৎকালীন অধ্যাপক ছিলেন প্রফেসর দেবেন্দ্র মোহন বসু ওরফে ডি এম বসু। বিভা চৌধুরীর মায়ের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় তিনি। তায় আবার বেশ বড় মাপের একজন বিজ্ঞানী। এ হেন বৈজ্ঞানিকের অধীনে গবেষণার সুপ্ত ইচ্ছা বিভা চৌধুরীর মনে। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি অধ্যাপক বসুকে অনুরোধ করলেন তাকে তাঁর গবেষক দলে নেওয়ার জন্য। কিন্তু গবেষণা ফিল্ডে একজন নারীর দক্ষতা সম্পর্কে প্রফেসরের মনে জোরদার সংশয় ছিল। মহিলারা যে পদার্থবিদ্যার দুরূহ জটিল ও কঠিন গবেষণায় পেরে উঠবে না এ তাঁর বদ্ধমূল ধারণা। ফলে যা হওয়ার তাই ঘটল। অচিরেই বিভা চৌধুরীর অনুরোধ নাকচ হয়ে গেল। অগত্যা তিনি আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর প্রতিষ্ঠিত বসু বিজ্ঞান মন্দিরে যোগ দিলেন একজন তরুণী গবেষক হিসেবে। অধ্যাপক বসু যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বসু বিজ্ঞান মন্দিরে গবেষণা করতে আসতেন, ঠিক সেই সময়ে বিভা চৌধুরীর গবেষক হিসেবে অন্তর্ভুক্তি হয়েছিল বিজ্ঞান মন্দিরে। এখান থেকেই তাঁর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রিসার্চ পেপার প্রকাশিত হয়। তাঁর তিনটি গবেষণা পত্রের একটি মাত্র কমন বিষয়। তা হল কসমিক রে (Cosmic Ray)। বাংলায় মহাজাগতিক রশ্মি। সেসময় এ হেন রশ্মিই পরা-পারমানবিক কণিকা (Sub-atomic particles)-র একমাত্র উৎস ছিল। কিন্তু অবধারিত প্রশ্ন জাগে মনে – 
কসমিক রশ্মি কী? এমন উদ্ভট রশ্মির মাহাত্ম্যই বা কী? কোত্থেকে আসে? কোথায় যায়? ইত্যাদি। হাজার একটা প্রশ্ন।

কসমিক রশ্মি :

শূন্যস্থান প্রকৃতপক্ষে স্থান-কালের বক্রতার জ্যামিতিক বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এই শূন্যতার মধ্য দিয়ে প্রায় আলোকের বেগে পৃথিবী লক্ষ্য করে দশ দিক থেকে ছুটে আসছে এক অসীম ক্ষমতাধর অদৃশ্য শত্রু। কত তার ক্ষমতা? এক আধটা অ্যাটম বোমা নয়, লক্ষ নিযুত কোটি হাইড্রোজেন বোম (একটি হাইড্রোজেন বোমার শক্তি দশখান অ্যাটম বোমার সমান)-এর সমান বা তারও বেশি। এমনই শক্তিধর সে যে নিমেষে ধ্বংস করতে পারে পৃথিবীতে প্রাণের সকল স্পন্দন। একবার ভূপৃষ্ঠে পৌঁছলে মুছে যাবে সবকিছু― সবুজ গাছপালা, কীটপতঙ্গ, জীবজন্তু, মানুষ ইত্যাদি। ১৮৯৯ সালে বিজ্ঞানীদ্বয় এলস্টার ও গেইটাল এবং ১৯০০ সালে সি টি আর উইলসন প্রথম সে-শত্রু 'মহাজাগতিক রশ্মি বা কসমিক রশ্মি' শনাক্ত করেন।  
কসমিক রশ্মি মুলত খুব উচ্চ শক্তির আহিত কণার স্রোত, যা চারিদিক থেকে পৃথিবীর দিকে ছুটে আসছে বিনা বাধায়। এ রশ্মি প্রায় ৯২% ধনাত্মক প্রোটন কণা, ৭% ধনাত্মক হিলিয়াম নিউক্লিয়াস এবং ১% ভারি মৌল (ভরসংখ্যা ৬০-এর সমান বা কম)-এর নিউক্লিয়াস দিয়ে তৈরি। এদের গড় শক্তি গিগা ইলেকট্রন-ভোল্ট (১৫ GeV) পাল্লার। এক গিগা ইলেকট্রন-ভোল্ট শক্তি এক বিলিয়ন (একশো কোটি) ইলেকট্রন-ভোল্ট শক্তির সমান। অথচ পরমাণু বোমার গড় শক্তি মাত্র ৭ মিলিয়ন (এক মিলিয়ন = দশ লক্ষ) ইলেকট্রন-ভোল্ট থেকে ৫০০ মিলিয়ন ইলেকট্রন-ভোল্ট। শেষোক্ত পাল্লার শক্তি বিজ্ঞানীগণ সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডরে তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন। কখনো-কখনো একটি কসমিক কণার শক্তি একশো বিলিয়ন গিগা ইলেকট্রন-ভোল্ট (GeV) পর্যন্ত হতে পারে। এ হেন শত্রুকণা রশ্মি নামে পরিচিত হল কেন ? কারণ প্রথম দিকে পণ্ডিতরা ভেবেছিলেন এ বুঝি আলোকের মতো উচ্চশক্তির তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। তখন থেকেই নামের পাশে 'রশ্মি' যোগ। কিন্তু পরে স্বর্ণপত্র তড়িৎবিক্ষণ যন্ত্রের পরীক্ষায় প্রমাণ হয় এ আসলে তড়িদাহিত কণা।

কোন বস্তু তড়িৎগ্রস্থ কিনা, তার তড়িতের প্রকৃতি (ধনাত্মক, ঋনাত্মক, নিস্তড়িৎ) কী― এসব জানবার যন্ত্র স্বর্ণপত্র তড়িৎবিক্ষণ যন্ত্র। একটি সরু উল্লম্ব ধাতব দণ্ডের ওপর প্রান্তে আটকানো একটি গোল ধাতব চাকতি ও নীচের প্রান্তে একই বিন্দুতে দু'টি পাতলা সোনার পাত যুক্ত। পাত দু'টির মুক্ত প্রান্ত বাধাহীনভাবে নড়াচড়া করতে পারে। চাকতি বাদে পুরো ব্যবস্থাটি কাচ দিয়ে ঘেরা। এটাই স্বর্ণপত্র তড়িৎবীক্ষণ যন্ত্র। ধরা যাক, এ যন্ত্রে সোনার পাত দু'টি সম জাতীয় আধানে আহিত। ফলে পাত দুটির মধ্যে বিকর্ষণের দরুন সামান্য ফাঁক। খোলামেলা জায়গায় যন্ত্রটি রেখে যদি দেখা যায় পাতদ্বয়ের মাঝখানের ফাঁকা ব্যবধান ধীরে ধীরে কমে, তখন বুঝতে হবে যন্ত্রের ধাতব চাকতি-সহ পাতের আধান ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। অদৃশ্য বিপরীত আধান চাকতির তড়িৎ ক্রমাগত প্রশমিত করছে। কিন্তু কে সেই বিপরীত আধান ? কোত্থেকে এল ? এ হেন পরীক্ষার জন্য যন্ত্রটিকে তড়িৎগ্রস্থ বস্তুর সংস্পর্শ থেকে বাঁচিয়ে  সূর্যের আলোতে বা অন্ধকারে ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা রেখে দেওয়া হল। তারপর ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেল সোনার পাত দু'টির মাঝখানে গ্যাপ খানিকটা কমে গেছে। কেন ? দু'রকম সম্ভাবনা। এক, সৌরঝড়ের সঙ্গে আগত আহিত তড়িৎ কণাগুচ্ছ। দুই, পৃথিবীর অভ্যন্তরে থাকা তেজস্ক্রিয় মৌলের বিকিরণ। রাতের অন্ধকারে যখন সূর্যের আলো আসে না তখন পরীক্ষা করে দেখা গেছে সোনার পাত দু'টি একই রকম নিমিলিত হয় যতটা দিনের আলোয় হত। সুতরাং প্রথম তত্ত্বটি এখানে খাটে না। আবার যন্ত্রটি বড় বেলুনের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে মাটি থেকে ওপরে পাঠিয়ে পুনরায় এক্সপেরিমেন্ট করা হল। ভূপৃষ্ঠ থেকে ভিন্ন ভিন্ন উচ্চতায় বায়ুতে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই করে দেখা গেল, পৃথিবীপৃষ্ঠের চাইতে আকাশে পাত দু'টির নিমিলিত হওয়ার হার যত ওপরে ওঠা যায় তত বেশি। অথচ উল্টোটা ঘটার কথা যদি তেজস্ক্রিয় বিকিরণের জন্য এ ঘটনা ঘটে থাকত। মাটিতে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের হার বেশি, ওপরে কম। ১৯১১ সালে বিজ্ঞানী হেস (Hess) এমন পরীক্ষা সংঘটিত করেছিলেন। তাহলে স্থির সিদ্ধান্তে আসা যাক – নিশ্চয় তেজস্ক্রিয়তার জন্য এ ঘটনা ঘটেনি। কোন‌ও তৃতীয় কারণ আছে নিশ্চিতরূপে। তা মহাজাগতিক রশ্মি – যার জন্য মেরু অঞ্চলে রঙ বেরঙের অরোরা দৃশ্যমান হয়, বায়ুমণ্ডলে আয়নোস্ফিয়ার বা আয়নমণ্ডল সৃষ্টি হয়েছে। বাতাসের এই স্তরে তাপমাত্রা প্রায় ১২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ২০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (বিশুদ্ধ জল মাত্র ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতায় ফোটে)। এত উষ্ণতা এল কোত্থেকে ? কসমিক কণা বিশেষত প্রোটনের সঙ্গে বায়ুর অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন পরমাণুর সংঘাতে অক্সিজেন বা নাইট্রোজেন পরমাণু ভেঙে আয়ন উৎপন্ন করে এবং প্রচুর শক্তি মুক্ত হয়ে এই স্তরের উষ্ণতা এত বাড়িয়ে দেয়। 

পৃথিবীর এমন বিপদের দিনে তার রক্ষাকবচ হবে কে ? প্রবাদ আছে― যে সৃষ্টি করে, রক্ষা করার দায়-দায়িত্বও তার। তাই বুঝি শূন্যস্থানে পৃথিবীর চারপাশে জীবকুলের রক্ষার্থে অদৃশ্য ভূ-চৌম্বকক্ষেত্রের কেরামতি সাজিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা। (ক্রমশ)
🍂

Post a Comment

0 Comments