জ্বলদর্চি

সবুজ দ্বীপ আন্দামান-২১/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

সবুজ দ্বীপ আন্দামান-২১                           
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী      
 
পূর্ব প্রকাশিতের পরবর্তী অংশ   

জারোয়াদের বিবাহ প্রথা-                   
গ্রেট আন্দামানিজদের মতো জারোয়ারাও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে। স্ত্রী মারা গেলে জারোয়া পুরুষ পুনরায় বিয়ে করে এবং স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা মহিলাদেরও বিয়ে করার সামাজিক অধিকার আছে। যার ফলে তাদের মধ্যে স্বামী স্ত্রীর বন্ধন দৃঢ়। নিজের ভাই বোন বা খুব কাছাকাছি রক্তের সম্পর্কের মধ্যে বিয়ে হয়না। খুব অল্প বয়সেই জারোয়াদের বিয়ে হয় স্বাভাবিক নিয়মে। বিয়ের সময় ছেলের বয়স মেয়ের বয়সের থেকে বেশি হয়। বিয়ের আগে তাদের মধ্যে বাগদান হওয়ার কথা আছে এবং বাগদান হওয়ার পরে ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে অবাধ মেলামেশায় সমাজের সম্মতি থাকে। বাগদানের পরে যৌনমিলনকে তারা স্বাভাবিকভাবেই দেখে। অবশ্য জারোয়া সমাজেও উচ্ছৃংখল জীবনযাপনের দৃষ্টান্ত আছে। বিধবা মহিলা বা অবিবাহিতা তরুনীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই সমস্ত ঘটনাগুলি ঘটে থাকে, তবে কখনো কোন বিবাহিত স্ত্রীর অপর পুরুষের সাথে যৌনমিলনের ঘটনা নেই। জারোয়ারা অবৈধ ধর্ষণকে যদিও ঘৃনার চোখে দেখে তথাপি ধর্ষিতা নারীর মধ্যে মানসিক ক্ষত খুবই স্বল্পস্থায়ী হয়। বারো থেকে পনেরো বছর বয়সের মধ্যে জারোয়া তরুণ-তরুণীদের বাগদান পর্ব শেষ হয়। এই বাগদান পর্বকে জারোয়া ভাষায় 'আটিয়াপিছে' বলা হয়। বাগদানের পর সমাজের স্বীকৃতি লাভ করে তারা অবাধ মেলামেশায় পূর্ণ স্বাধীনতা পায়। একটি তরুণ বা তরুণী সাবালক না হওয়া পর্যন্ত তার বাগদান পর্ব হয়না। সাবালকত্বের প্রমাণ স্বরূপ তরুণকে জঙ্গলে যেয়ে নিজের হাতে এক তীরের সাহায্যে জংলী শুকর মেরে আনতে হয় এবং তরুণীরা ঋতু প্রাপ্ত হলে তবেই  সাবালিকা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জারোয়া তরুণ-তরুণীরা তাদের জীবনসঙ্গী নিজেরাই সমাজের মধ্য থেকে পছন্দ করে। এরপরে মা বাবা সম্মতি দিলে জারোয়াদের সমাজ তাদের মধ্যে বিয়ের ব্যবস্থা করে। জারোয়াদের বিবাহকে তাদের ভাষায় বলে 'ওয়াঙ্গে'। এই বাগদান বা বিয়ের সময় তারা সাদাটে ও ধূসর রঙের মাটির প্রলেপ দিয়ে মুখে ও গায়ে নকশা করে। 
🍂
বনফুল ও লতাপাতার ব্যান্ড বা রিং বানিয়ে মাথা, গলা ও কোমরে দুজনে বাঁধে। এরপরে ছেলে এক জায়গায় বসে থাকে এবং মেয়েকে নিয়ে যেয়ে ছেলের কোলে বসিয়ে দেওয়া হয় অথবা অনেক ক্ষেত্রে মেয়ে নিজেই এসে ছেলের কোলে বসে। বাগদান বা বিবাহের এই অনুষ্ঠানের পরে জারোয়ারা শিকার করা শুকরকে প্রথাগত পদ্ধতিতে রান্না করে সকলে মিলে খায় ও আনন্দে মেতে ওঠে। তাদের বিয়ে সাধারণত সন্ধ্যাবেলায় হয়। জারোয়া তরুণীরা শিকারি তরুণকেই মনের মত জীবনসঙ্গী বিবেচনা করে। জারোয়া সমাজে অবিবাহিতা ও বিধবা মহিলারা আলাদা কুটিরে থাকে এবং সেখানে কোন পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। বিধবা বিবাহ জারোয়া সমাজে খুবই প্রচলিত। আসলে তাদের জীবন যাপনের রীতিনীতি ও সমাজব্যবস্থা যেরকম তাতে বিধবা বিবাহের প্রয়োজন বেঁচে থাকার তাগিদেই। স্বামী বা স্ত্রীর যেকোনো একজনের মৃত্যু হলে অপরজন পুনরায় বিবাহ করতে পারে এবং দ্বিতীয় বিবাহের পরেও স্বামী বা স্ত্রীর কেউ একজন মারা গেলে অপরজন পুনরায় বিবাহ করতে পারে- এটাই জারোয়া সমাজব্যবস্থায় প্রচলিত।
আদিম জনজাতির কুসংস্কার ও মৃতদেহের সৎকার প্রথা  -                         
মৃতের সৎকার প্রথা জারোয়া সমাজে বিচিত্র। গ্রেট আন্দামানিজদের সৎকার প্রথা তুলনামূলকভাবে বেশি বৈজ্ঞানিক। তারা মৃতদেহ কবর দিয়ে সৎকার করে। শিশুদের মৃতদেহ কুটিরের নিচে মাটি খুঁড়ে কবর দেয়। কিন্তু জারোয়াদের সৎকার প্রথা ভিন্ন ধরনের। তারা শিশুদের মৃতদেহ কুটির থেকে অল্প দূরে মাটি খুঁড়ে কবর দেয় কিন্তু বড়দের মৃতদেহ তারা কবর দেয় না। এই কবর দেওয়াকে জারোয়ারা বলে 'ডিউটে'। জারোয়ারা বড়দের মৃতদেহ কুটির থেকে বেশ কিছুটা দূরে ঘন জঙ্গলের মধ্যে কোন বড় পুরাতন গাছের নিচে যেয়ে সেই গাছের মোটা দুই শিকড়ের মাঝে যে গহ্বর আছে সেখানে মৃতদেহ শুইয়ে দিয়ে তার উপরে লতাপাতা বিছিয়ে গাছের ডাল ও বড় পাথর চাপা দেয়। মৃতদেহ এইভাবে ঢাকা পড়ে যায়। ভারী কাঠ বা পাথর চাপা দেওয়ার ফলে বন্য পশুরা মৃতদেহের কোন ক্ষতি করতে পারে না। সৎকারের এই পদ্ধতিকে জারোয়ারা বলে 'এটিওটে'। মৃতদেহ সৎকার করার সময় জারোয়ারা শোক পালনের চিহ্ন হিসেবে কপালে ধূসর মাটির প্রলেপ লাগায়, গ্রেট আন্দামানিজেরা কপাল ছাড়াও সারা গায়ে মাটির প্রলেপ লাগিয়ে রাখে। জারোয়ারা কপালের মাটির প্রলেপ কয়েকদিন রাখার পরে ধুয়ে ফেলে কিন্তু গ্রেট আন্দামানিজেরা বেশ কিছুদিন মাটি ধোয়ে না। যে কুটিরের নিকটে এই সৎকার হয় সেখানে তারা তিন চার মাস কেহই আসেনা, এটা তাদের অন্ধবিশ্বাস। অবশ্য বৈজ্ঞানিক দিক দিয়ে দেখতে গেলে এর একটি তাৎপর্য আছে, কারণ তিন চার মাস পর্যন্ত মৃতদেহের দুর্গন্ধ আসতে পারে। তিন চার মাস বা তারও পরে জারোয়ারা সৎকারের সমাপ্তি হিসেবে মৃতের শরীরের হাড়গুলি দিয়ে বিভিন্ন সাইজের গয়না বানিয়ে গলা কোমর ও হাতে বাঁধে। ছোট হাড়গুলি দিয়েই তারা গয়না বানায়। মাথার খুলি ও বড় হাড়গুলি তারা গভীর জঙ্গলে বড় গাছের কোটরে বা কোন গোপন স্থানে লুকিয়ে রাখে। মৃত প্রিয়জনের হাড়ের গয়না পরা তাদের কাছে গর্বের বিষয়। তাদের অন্ধবিশ্বাস এগুলি পরলে রোগ মুক্তি হয় এবং কোন অশুভ শক্তি তাদেরকে স্পর্শ করতে পারে না। হাড়ের গয়নার দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে তারা হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের স্মৃতিচারণে বিভোর হয়ে যায় এবং সেই সময় বিন্দু বিন্দু জল প্রস্তর যুগের আদিম মানুষদের চোখে দেখা যায়। সুদূর অতীতে নাবিক, পরিব্রাজকেরা বঙ্গোপসাগরের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় যারা আদিম জনজাতির মানুষদের দেখেছেন বা খুব কাছে এসেছেন তারা বলেছেন আন্দামানের নেগ্রিটো উলঙ্গ মানুষেরা নরখাদক। আসলে তারা কিন্তু মানুষের মাংস খায় না বা নরখাদক নয়। তারা তাদের মৃত আত্মীয়-স্বজনের হাড়ের তৈরী গয়নাগুলি গয়না পরে থাকাকালীন সভ্য মানুষেরা তাদের দেখে ভাবতেন নেগ্রিটো উলঙ্গ মানুষেরা নরখাদক। তারা মনে নরখাদক এই প্রমান এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। বড়দের সৎকার ও শিশুদের সৎকারের মধ্যে একটু তফাৎ আছে। শিশুদের সৎকার দু'রকমের। মৃত্যু স্বাভাবিক হলে কুটিরের নিকটেই সৎকার করা হয়। আর যেখানে তাদের মনে হয় শিশুর মৃত্যুর মধ্যে কোন অশুভ শক্তি ভর করেছে সেখানে তারা অন্যভাবে সৎকার করে। প্রথমে জারোয়া মা তার মৃত শিশুকে কোন বয়স্কা মহিলারা হাতে তুলে দেওয়ার পরে মা-বাবা শিশুর মুখের দিকে না তাকিয়ে সোজা কুটিরে ফিরে যায়। বয়স্কা মহিলা এরপর মৃত শিশুকে এক বয়স্ক জারোয়ার হাতে তুলে দেয়। বয়স্ক জারোয়া পুরুষ মৃত শিশুকে নিয়ে সৎকারের জন্য গভীর অরণ্যে নিয়ে চলে যায়। গভীর অরণ্যে নিয়ে গিয়ে শিশুটিকে এক কাঁধে রেখে বয়স্ক জারোয়া পায়ের উপর দাঁড়ায়। চোখ বন্ধ করে একটু বের করা জিভকে দাঁতে চেপে সে তার দুই কান টেনে ধরে। তারা মনে করে এই সময়ে এক শক্তি তার মধ্যে ভর করে এবং সে মৃত শিশুকে স্বর্গে নিয়ে যায়। জারোয়াদের স্বর্গের নাম হলো 'পাঙনাং চাড্ডা'। চোখ খোলার পরে মৃত শিশুকে সেই বয়স্ক জারোয়া গাছের তলায় কবর দেয়।আবার অবৈধ কোন জারোয়া শিশু সাত থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সমাজের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের হাতে প্রাণ হারায়। জারোয়া সমাজে অবৈধ শিশু অশুভ শক্তির আধার বলে বিবেচিত। বহু শিশুর অকাল মৃত্যু এই কুসংস্কারের ফলে হয়। আবার কোন নবজাতক যদি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে খুবই রুগ্ন বা ওজনে কম থাকে এবং মায়ের বুকের দুধ টানতে পারেনা তখন জারোয়া সমাজের দলপতি কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে নিদান দেয় যে শিশুটি অশুভ শক্তির আধার এবং তাদের সমাজের রীতি-নীতি মেনে তারা সেই শিশুটিকে গভীর জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। গ্রেট আন্দামানিজেরা এবং জারোয়ারা কেহই মৃত ব্যক্তির নামে স্মৃতিস্তম্ভ বা সৌধ বানায় না, শুধু কুটিরস্থানের নাম রাখে মৃত ব্যক্তির নামে। মৃতদেহের সৎকার করার পরে তারা তাড়াতাড়ি শোকগ্রস্ত মনকে স্বাভাবিক করে জীবন যাপন করে। জারোয়াদের সমাজে কিছু কিছু কুসংস্কারের উল্লেখ করছি।     
                                                   পরবর্তী অংশ দ্বাবিংশতি পর্বে

Post a Comment

0 Comments