জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ২০ / সালেহা খাতুন

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ২০ / সালেহা খাতুন 

বুকের ভেতর কত মানুষ যে বসত করে আছেন! একে একে তাঁদের টেনে আনছি আমার আত্মকথায়। কে আমি? আলাদা আমি-র কোনো অস্তিত্ব নেই। অন্যের সঙ্গে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমি-র সত্তা। আমার ব্যক্তিসত্তা, সামাজিক সত্তা, পারিবারিক সত্তা। 

সে কারণে যখন শিক্ষককূলের কথা বলি তাঁরা শুধু আমার শিক্ষক-ই থাকেন না। সমগ্র মানব জাতির শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্ব করেন। 

উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে আরো যাঁদের পেয়েছিলাম তাঁদের অতোটা গভীরভাবে চিনতে পারি নি ঠিকই তবে তাঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধাজ্ঞাপন অব্যাহত রাখতে চাই। অধ্যাপক অখিল রঞ্জন সাহাকে রুটিনে সংক্ষেপে এ আর এস নামে পেয়েছিলাম। ছাত্রাবস্থায় আমরা সকলেই মনে হয় ক্লাসে শিক্ষকের হাতে বই তুলে দিতে পারলে নিজেকে কৃতার্থ মনে করতাম। কেমিস্ট্রির ক্লাসে আমি স্যারের হাতে আমার কেমিস্ট্রি বইটি দিতাম। আসলে সহপাঠীরা ওসব বই নিয়ে কলেজে আসত না। উলুবেড়িয়া কলেজের পেছন দিকের সরু প্রতিকূল রাস্তার উপর দিয়ে আমরা সময় বাঁচানোর জন্য প্রায়ই যাতায়াত করতাম। দ্রুত স্টেশনে এসে ট্রেন ধরতাম। এ আর এসও আমাদের সঙ্গে আসতেন এবং ট্রেন ধরতেন। এ আর এস স্যার টিউশন পড়াতেন না। কিন্তু এম এম টিউশন পড়াতেন। ক্লাসেও ভালো পড়াতেন। আত্মভোলা মানুষ। কিন্তু শুনেছিলাম তাঁর কাছে টিউশন না নিলে প্র্যাকটিক্যাল  পরীক্ষায় ভালো ফল করা যেতো না। যথারীতি আমি প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাইনি।

 ফিজিক্সে পি এন এম, পি পি এঁরা পড়াতেন। একবার ক্লাসে পি এন এম স্যার বৃষ্টির ডিরেকশন উল্টো দিয়েছিলেন। ফলে বন্ধুরা কেউ কেউ স্যারকে সঠিক নির্দেশনা দিয়েছিল। আসলে শিক্ষার্থীরাই শিক্ষকদের জাগিয়ে রাখে। গবেষণাগারে খুব আনন্দের সঙ্গে  প্র্যাকটিক্যাল করতাম আমরা। 

বায়োলজি ক্লাসে অনেক ব্যাঙ কেটেছি। কাণ্ডের প্রস্থচ্ছেদ করেছি। নিজের আঙুলে ছুঁচ ফুটিয়ে স্লাইডে রক্ত নিয়ে নিজের রক্ত পরীক্ষা করেছি। ঠোঁট থেকে চামড়া উঠিয়ে কোষের পরীক্ষা করেছি। সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ার পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছি। কোরকবাবু, তুহিনকণা ম্যাডাম, পঞ্চাননবাবু, এস বি প্রমুখ অধ্যাপক এবং নীহারদা ও শ্যামলীদি আমাদের অত্যন্ত যত্ন করে প্র্যাকটিক্যাল করাতেন। আমাদের প্রত্যেকের ছিল আলাদা আলাদা বায়োলজি বক্স।
🍂

উলুবেড়িয়া কলেজে ফিজিক্স কেমিস্ট্রির ল্যাবরেটরি অত্যন্ত উন্নত ছিল। কত কী চিনেছিলাম। বুনসেন বার্নার, তারজালি, বিকার, টেস্টটিউব, ব্যুরেট, পিপেট, রিয়েজেন্ট বোতল, কনিক্যাল ফ্লাক্স, গ্যাসজার, লাল লিটমাস, নীল লিটমাস আরো কত কী। ব্যারোমিটার, ম্যাগনেট, মাইক্রোস্কোপ আরো কত যন্ত্রের নাম স্মৃতিতে আসছে না। কিন্তু কী আশ্চর্য সেই নব্বই একানব্বইয়ের ল্যাবরেটরিতে যেন এক্ষুনি ঘুরে এলাম।
অঙ্ক করাতেন অধ্যাপক মাজেদ মোল্লা এবং অর্চনা ম্যাডাম। মাজেদবাবু বলতেন, “জিরো ইজ দ্য হিরো অফ ম্যাথমেটিক্স”। অর্চনাদি একমনে বোর্ডে অঙ্ক করিয়ে যেতেন। অর্চনাদির কথা সিনিয়রদের কাছে শুনেছিলাম। তাঁর এক প্রিয় ছাত্র অঙ্কে খুব ভালো রেজাল্ট করায় তিনি তাঁকে কিছু উপহার দিতে চাইলে ছেলেটি ম্যাডামের কাছ থেকে প্যান্ট শার্টের পিস চায়। কেননা ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার মতো তার কোনো জামা ছিল না। শিক্ষক শিক্ষার্থীর সম্পর্ক মনে হয় এমনই হয় যাঁর কাছে নিজের সমস্ত দুর্বলতার কথা বলা যায়।
(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments