জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ১৮/বিজন সাহা


ভোলগা নদীর খোঁজে – ১৮
বিজন সাহা 

গির্জা আর মিউজিয়ামের শহর ইয়ারোস্লাভল  

২০২১ সালে আমাদের ইয়ারোস্লাভল ভ্রমণ শুরু হয় শহরের ঐতিহাসিক কেন্দ্র থেকে। শহরের ঐতিহাসিক কেন্দ্রে বুল্ভারড মিরা বা শান্তি সরণীতে অনির্বাণ শিখা বা চিরন্তন শিখা নামে মেমোরিয়াল কম্পোজিশন আছে। যে দুটো গ্রানাইটের দেয়ালের মাঝে এই চিরন্তন শিখা জ্বলছে তার একটাতে আছে শ্রমজীবী নারী – অন্যটায় সৈনিক। এটা ইয়ারোস্লাভলের শ্রমজীবী ও সেনাদের বীরত্বের প্রতীক। এখান থেকে উসপেনস্কি সাবর স্পষ্ট দেখা যায়। মস্কো ক্রেমলিনের পাশে অজানা সেনাদের সমাধি থেকে আনা আগুন দিয়ে এই চিরন্তন শিখা জ্বালানো হয়েছিল।  এরপরে দীর্ঘ রাস্তা যেটা পর্যটকদের নিয়ে যায় সোনালী গম্বুজের উসপেনস্কি গির্জার দিকে। ১২১৫  সালে প্রতিষ্ঠিত এই গির্জা বিংশ শতকের শুরুতে ধ্বংস করা হয়। ৫০ মিটার উঁচু ও ৪০০০ স্থান বিশিষ্ট এই গির্জা ২০১০ সালে পুনর্নির্মাণ করা হয়। এই এলাকা ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষিত। এক সময় এখানে ক্রেমলিন বা দুর্গ থাকলেও আজ আর তার অস্তিত্ব এখানে নেই। বিভিন্ন আক্রমণে ধ্বংস হয়ে গেছে সেই ক্রেমলিন। এর ভেতরে বিভিন্ন গির্জা পরবর্তী পর্যায়ে জনগণের অর্থে পুনর্নির্মিত হলেও ক্রেমলিন আর গড়ে তোলা হয়নি। ভোলগার উঁচু তীরে অবস্থিত এই স্থানটায় আছে একটা পাথর যার গায়ে লেখা ১০১০ সালে ইয়ারোস্লাভ মুদ্রি বা জ্ঞানী ইয়ারোস্লাভ এই শহরের গোড়াপত্তন করেন। আছে সভ্যাতাইয়া ত্রইৎসা। নীচে ভোলগা ও কতরসলের মিলন স্থলে অবস্থিত “পার্ক না স্ত্রেলকে”  মনে হয় স্থানীয় লোকজনদের সময় কাটানোর প্রিয় জায়গা। পার্কের এক প্রান্তে ইয়ারোস্লাভলের হাজার বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে তৈরি মনুমেন্ট। ২০১০ সালে ইয়ারোস্লাভলের ১০০০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে পার্ক না স্ত্রেলকের ভোলগা তীরে স্থাপন করা হয় ২০ মিটার উঁচু গ্রানাইটের মনুমেন্ট। এর মাথায় আছে দুই মুখো ঈগল, আর পাদদেশে ইয়ারোস্লাভল মুদ্রি, শিশু সহ তাঁর রানী, নাগরিক, সৈনিক ও পুরোহিতের খোদিত ছবি। পার্ক না স্ত্রেলকের অদূরে বর্তমান উসস্পেনস্কি গির্জার পাশে আছে কম্পোজিশন ত্রিমূর্তি বা ত্রইৎসা। এটা আসলে ধ্বংসপ্রাপ্ত উস্পেনস্কি গির্জার জায়গায় স্থাপিত।  ইয়ারোস্লাভলের নববিবাহিতরা এখানে সাধারণত কয়েন ছড়িয়ে দেয়। 

এরপর আমরা যাই প্রশাসনিক কেন্দ্রের দিকে যেখানে আছে ইয়ারোস্লাভলের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ প্রফেট ইলিয়ার গির্জা। এটা শহরের সর্বপ্রথম গির্জা ইয়ারোস্লাভ মুদ্রি নিজে হাতে যার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। সেই সময় এসব এলাকা ছিল বন জঙ্গলে ঢাকা। কথিত আছে তিনি এখানে এক ভালুকের সাথে যুদ্ধে জয়ী হন। আর এটা ঘটে প্রফেট ইলিয়া দিবসে। সেই কারণেই তিনি এ গির্জা স্থাপন করেন। পরবর্তীতে ভালুক হয় শহরের প্রতীক। এই গির্জার দেয়াল ফ্রেস্কি ও এক হাজার আইকন দিয়ে সুসজ্জিত। সেখান থেকে আমরা গেলাম    ইয়ারোস্লাভলের আরবাত নামে খ্যাত কিরভ স্ট্রীটে। ওখানে বিশাল এক ভালুক বসে আছে। যেহেতু ভালুক এই শহরের প্রতীক তাই পর্যটকদের কাছে এসব মূর্তি খুবই জনপ্রিয়। গুলিয়া ওর সাথে কয়েকটা ছবি তুলে নাক ডলে দেয়। এটাই নিয়ম।   

ইয়ারোস্লাভ সংরক্ষণ মিউজিয়াম দেশের বৃহত্তম যাদুঘরগুলোর একটি। এখানে প্রদর্শিত বস্তুগুলো এই অঞ্চলের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও স্থাপত্য সম্পর্কে আমাদের জানায়। এর মূল প্রদর্শনী স্পাসো-প্রেওব্রাঝেনস্কায়া মনাস্তিরে অবস্থিত। স্পাসো-প্রেওব্রাঝেনস্কি সাবর প্রথমে তৈরি হয় দ্বাদশ শতকে যা ১৫০১ সালে পুনর্নির্মাণ করা হয়। এখানে প্রায়ই ইভান গ্রজনি বেড়াতে আসতেন। তল্গি নদী যেখানে ভোলগায় পড়ছে সেখানে ১৩১৪ সালে তলগস্কি মহিলা মনাস্তির প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে ১৫৫৪ সালে ইভান গ্রজনি বেড়াতে আসেন। বলা হয়ে থাকে এখানে গড মাদার আইকনের কাছে প্রার্থনা করে তার পায়ের ব্যথা সেরে যায়। পরবর্তীতে পিটার দ্য গ্রেট, দ্বিতীয় ইয়েকাতেরিনা ও দ্বিতীয় নিকোলাই এখানে এসেছিলেন। এখনও এখানে ১৬২০ সালের কাঠের স্থাপনা সংরক্ষিত আছে। এসব গল্প ঘোরার ফাঁকে শোনাবেন আমাদের স্থানীয় গাইড। 

🍂
১৬৭১ থেকে ১৬৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ইয়োয়ান (যোহান) প্রেদচাতি গির্জার প্রধান আকর্ষণ দেয়াল লিখন ও অলঙ্কার। ইয়ারোস্লাভল মুদ্রির স্ট্যাচুর পাশাপাশি এই গির্জার ছবি বর্তমানে রাশিয়ার ১০০০ রুবলের নোটে শোভা পাচ্ছে।  ১৯৯৩ সালে তৎকালীন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনের উপস্থিতিতে বোগোইয়াভলেনস্কি স্কয়ারে ইয়ারোস্লাভ মুদ্রির পাঁচ মিটার উঁচু ব্রোঞ্জের স্ট্যাচু স্থাপন করা হয়। ১৬১০ সালে তৈরি কাজানস্কি মহিলা মনাস্তির ১৮৩৫ সালে পাথর দিয়ে পুনর্নির্মাণ করা হয়। এই মনাস্তির বিখ্যাত তার গান আর আইকন আঁকার জন্য। কাজানস্কি মনাস্তিরের পবিত্রতম আইকন ছিল বর্তমানে হারিয়ে যাওয়া গড মাদারের আইকন। বর্তমানে সেখানে এই আইকনের কপি আছে যেটা সোভিয়েত সরকার কর্তৃক বন্ধ করার ঠিক আগে গির্জার সন্যাসিনীরা রক্ষা করেছিল।  

যেখানে কতরসল ভোলগায় পড়েছে তার অদূরে আছে বেশ কিছু ধর্মীয় স্থাপনা। কারভনিকিতে এই মন্দির সমাহারে আছে ইয়োয়ান জলাতোউস্ত গির্জা, বেল টাওয়ার, ভ্লাদিমির গড মাদার আইকন গির্জা। কয়েক দশক ধরে এই কমপ্লেক্স তৈরি করা হয়। প্রত্যেক স্থপতি নিজের নিজের মত করে বিভিন্ন অংশ তৈরি করেন। কিন্তু সব মিলে এটা খুবই হারমনিক দেখায়। এটা ভোলগা তীরের শহরবাসী ও পর্যটকদের প্রিয় স্থানগুলোর একটি। তেরেশকভা প্ল্যানেটরিয়ামের নতুন বিল্ডিং উদ্বোধন করা হয় ২০১১ সালে। অসাধারণ স্থাপত্যের ৩০০ বর্গমিটার আকাশে ৭০০০ নক্ষত্র দেখানো যায়। নিকোলাই রুব্লেন গির্জা ১৬৯৫ সালে সাবেক ইয়ারোস্লাভল ক্রেমলিনের ওখানে তৈরি করা হয়। বলা হয়ে থাকে এটা শহরের সবচেয়ে সুন্দর ও হারমনিক স্থাপনা। ১৯১৮ সালের গণ অভ্যুত্থানে এটা বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বর্তমানে এখানে ইয়ারোস্লাভল আর্ট মিউজিয়াম কাজ করে। ক্ল্যাসিকাল গম্বুজের শ্বেত পাথরের স্পাসা না গোরাদু গির্জা কতরসল নদীর তীরে শহরের ঐতিহাসিক কেন্দ্রে অবস্থিত। কাঠের তৈরি পুরানো গির্জার জায়গায় এটা তৈরি হয় ১৬৯৫ সালে। বিশ জনের বেশি শিল্পী এর দেয়ালচিত্র এঁকেছিলেন। সোভিয়েত শাসনের সময় এর ভেতরের দিক প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বিংশ শতকের শেষের দিকে আঞ্চলিক মিউজিয়ামের কাছে হস্তান্তর করার পরে শুরু হয় এর পুনর্নির্মাণ কাজ। সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে প্রতিষ্ঠিত বোগোইয়াভলেনিয়া গির্জা এর ফ্রেস্কোর জন্য বিখ্যাত। কে এর স্রষ্টা বা কত  সালে এসব করা হয় তার সঠিক তারিখ আজও অজানা। লাল ইটের তৈরি এই সুন্দর গির্জার নয়টি জানালা এর অভ্যন্তর আলোকিত করে রাখে।  

বিভিন্ন শহরের মত ইয়ারোস্লাভলের ফায়ার টাওয়ার অনেকের মনোযোগ আকর্ষণ করে। প্রথম টাওয়ার তৈরি হয় শহরের কেন্দ্রে ১৮২০ সালে। পরে ১৯০৯ সালে সেই সময়ের দাবির সাথে সামঞ্জস্য রেখে একে রেড স্কয়ারে স্থানান্তরিত করা হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে রেড স্কয়ার বা ক্রাস্নায়া প্লসিদ আসলে সুন্দর স্কয়ার – তা শুধু মস্কোয় নয়, বিভিন্ন শহরেই আছে। ৩০ মিটার উঁচু এই টাওয়ার সে সময় অন্যান্য স্থাপনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করেছিল। সপ্তদশ শতকের শেষে তৈরি ভোলগা টাওয়ার এক সময় অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহৃত হত। এটা শহরের কেন্দ্রের বাইরে ধ্বংস হয়ে যাওয়া অংশের টিকে থাকা স্থাপনাগুলোর একটি।  

ইয়ারোস্লাভল আর্ট গ্যালারী ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ। এটা উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে তৈরি এবং সে সময় ইয়ারোস্লাভলের গভর্নর হাউজ ছিল। ১৯৬৯ সালে এটা আর্ট গ্যালারীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে সেখানে অফলাইন ও অনলাইন বিভিন্ন ধরণের এক্সারশনের আয়োজন করা হয়। এছাড়া সেখানে বল ড্যান্সে অংশ নেয়া যায়। ইয়ারোস্লাভলের এই গ্যালারীতে পলেনভ, রেপিন, শিশকিন, কুইঞ্জি সহ অনেক বিশ্বখ্যাত আর্টিস্টদের পেইন্টিং আছে।

শহরের ঐতিহাসিক অংশে ভোলগার তীরে আছে আছে ভিন্ন ধরণের সংগ্রহের ব্যক্তিগত মিউজিয়াম - শালিয়াপিন, উতেসভ, ভেরতিনস্কি সহ অনেকের রেয়ার গান সহ প্রায় ১৫০০০ গ্রামোফোন রেকর্ডের কালেকশন। আছে ঘণ্টা বা বেলের সংগ্রহ। এখানে আরও আছে সামোভার আর চিনেমাটির পাত্রের মিউজিয়াম। স্পাসো-প্রেওব্রাঝেনস্কি মনাস্তিরের গেটের সামনে অবস্থিত কাজানস্কি গড মাদার বেল টাওয়ার দেখতে রকেটের মত যা আকাশের দিকে  ধাবমান। মিনিন ও পঝারস্কির নেতৃত্বে মনাস্তির থেকে মিলিশিয়াদের বের হওয়ার স্মৃতির উদ্দেশ্যে ১৯৯৭ সালে তৈরি করা হয়। সেখানে কাজানস্কি গড মাদারের আইকনের ছবি আঁকা। ধারণা করা হয় যে বেল টাওয়ারে পয়সা ফেললে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়। ১৯৫৮ সালে ভোলগার তীরে যেখানে পেরভোমাইস্কায়া স্ট্রীট এসে পড়েছে সেখানে স্থাপিত হয় কবি নেক্রাসভের মূর্তি। তিনি তাকিয়ে আছে ভোলগার দিকে, দেখছেন অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য। পাশেই স্তম্ভে আঁকা তাঁর রচনার নায়ক নায়িকাদের ছবি।  

আমি দিলীপ আর দেমিদ এগুচ্ছি ইয়ারোস্লাভলের দিকে। কিন্তু বৃষ্টির বেগ কমছে না মোটেই। গতবার এসে আমার টাওয়ারে ওঠা হয়নি, সময় ছিল না। যখন ওখানে এলাম দেখি সময় আর তেমন নেই। যেহেতু আমার আবারও ইয়ারোস্লাভল আসাটা মোটামুটি ঠিক হয়ে গেছিল, তাই খুব একটা চেষ্টাও করিনি। কিন্তু এবারও হল না। এখানে একটা ক্যাফেতে চা কফি খেয়ে আমরা রওনা হলাম কস্ত্রোমার দিকে। ঠিক হল কস্ত্রোমায় ছোট্ট একটা যাত্রা বিরতি দিয়ে প্লিওসে দুপুরের খাবার খেয়ে আজই আমরা চলে যাব নিঝনি নভগোরাদে। 

ছবিতে ইয়ারোস্লাভল
http://bijansaha.ru/album.php?tag=211

ভিডিও
https://www.youtube.com/watch?v=lPq7CS6H7lk


Post a Comment

0 Comments