জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা/পর্ব -৮৯/প্রীতম সেনগুপ্ত

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা
পর্ব -৮৯

প্রীতম সেনগুপ্ত

 নেতাজী সুভাষচন্দ্রের জীবনে বিবেকানন্দ

 বাংলা তথা ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তেজস্বী সন্তান নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অধ্যায়ে তিনি অবশ্যই এক মুখ্য ও বিশেষ চরিত্র। সুভাষচন্দ্রের উপর অপরিসীম প্রভাব ছিল স্বামী বিবেকানন্দের। দক্ষিণ-কলিকাতা সেবক সমিতির অন্যতম তরুণ কর্মী হরিচরণ বাগচিকে মান্দালয় জেলে থাকাকালীন একটি পত্রে সুভাষচন্দ্র লিখছেন -- “ভয় জয় করার উপায় শক্তিসাধনা। দুর্গা, কালী প্রভৃতি মূর্ত্তি শক্তির রূপবিশেষ। শক্তির যে কোন রূপ মনে মনে কল্পনা করিয়া তাঁহার নিকট শক্তি প্রার্থনা করিলে এবং তাহার চরণে মনের দুর্বলতা ও মলিনতা বলিস্বরূপ প্রদান করিলে মানুষ শক্তিলাভ করিতে পারে। আমাদের মধ্যে অনন্ত শক্তি নিহিত হইয়াছে, সেই শক্তির বোধন করিতে হইবে। পূজার উদ্দেশ্য মনের মধ্যে শক্তির বোধন করা। প্রত্যহ শক্তিরূপ ধ্যান করিয়া শক্তিকে প্রার্থনা করিবে এবং পঞ্চেন্দ্রিয় ও সকল রিপুকে তাঁহার চরণে নিবেদন করিবে।
 ...প্রত্যহ ( সম্ভব হইলে ) দুইবেলা এইরূপ ধ্যান করিবে। কিছুদিন ধ্যান করার সঙ্গে সঙ্গে শক্তি পাইবে, শান্তিও হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করিবে। আপাততঃ স্বামী বিবেকান্দের এই বইগুলি পড়িতে পার‌। তাঁহার বইয়ের মধ্যে ‘পত্রাবলী’ ও বক্তৃতাগুলি বিশেষ শিক্ষাপ্রদ। ‘ভারতে বিবেকানন্দ’ বই-এর মধ্য এ সব বোধ‌ হয় পাইবে।‌ আলাদা বইও বোধহয় পাওয়া যায়। ‘পত্রাবলী’ ও বক্তৃতাগুলি না পড়িলে অন্যান্য বই পড়িতে যাওয়া ঠিক নয়। ‘Philosophy of Religion’ ‘Jnanyoga’ বা ঐ জাতীয় বইতে আগে হস্তক্ষেপ করিও না। তারপর সঙ্গে সঙ্গে ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ পড়িতে পার।” ( তরুণের স্বপ্ন -- সুভাষচন্দ্র বসু ) সুভাষচন্দ্রের চিন্তাভাবনার মধ্যে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবধারার যে মোক্ষম অনুপ্রবেশ ঘটেছিল তা এই পত্রে পরিষ্কার।‌ আরেকটি পত্রে হরিচরণ বাগচিকে বইয়ের তালিকা দিয়েছেন সেগুলি পাঠ করার পরামর্শ দিয়ে। ধর্ম, সাহিত্য, কবিতা, ইতিহাস ইত্যাদি নানা বিষয়ের বইয়ের তালিকায় ধর্মসম্বন্ধীয় যে বইগুলির কথা উল্লেখ করেছেন সেগুলি এইরকম --“(১)‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’; (২)‘ব্রহ্মচর্য্য’-- সুরেন্দ্র ভট্টাচার্য্য ; ঐ-- রমেশ চক্রবর্তী; ঐ-- ফকিরচন্দ্র দে; (৩)‘স্বামী-শিষ্য সংবাদ’ -- শরৎ চক্রবর্ত্তী; (৪)‘পত্রাবলী’ -- বিবেকানন্দ; (৫)‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্য’-- বিবেকানন্দ; (৬) ‘বক্তৃতাবলী’-- বিবেকানন্দ; (৭)‘ভাববার কথা’--ঐ; (৮)‘ভারতের সাধনা’ -- স্বামী প্রজ্ঞানন্দ; (৯) ‘চিকাগো ( Chicago )বক্তৃতা’ -- স্বামী বিবেকানন্দ।“ ( তরুণের স্বপ্ন -- সুভাষচন্দ্র বসু ) এই তালিকা থেকে স্পষ্টতই অনুধাবন করা যায় যে সুভাষচন্দ্রের জীবনে স্বামী বিবেকানন্দের প্রভাব ছিল সুগভীর।
🍂

 অপর একটি পত্রে সুভাষচন্দ্র এইরকম মত পোষণ করেছেন যে -- স্বামী বিবেকানন্দের জীবনাবসান হয় ১৯০২ সালে এবং সেই ধর্মীয়-দার্শনিক আন্দোলন চলতে থাকে অরবিন্দ ঘোষের ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে। অরবিন্দ রাজনীতি থেকে কখনও দূরে থাকেননি। বরং রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত থেকে ১৯০৮ সালের মধ্যে দেশের অগ্রণী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। তাঁর ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে রাজনীতির মেলবন্ধন ঘটেছিল।
 
স্বাধীনতা সংগ্রামীর চোখে স্বামী বিবেকানন্দ

 প্রখ্যাত মুক্তিসংগ্রামী, রাইটার্সের অলিন্দযুদ্ধখ্যাত বিনয়-বাদল-দীনেশের বিপ্লবগুরু হেমচন্দ্র ঘোষ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন --“...স্বামীজী ব্যক্তিগতভাবে যে-সমস্ত উপদেশ দিয়াছেন, তাহার সারমর্ম এই: ‘সর্বপ্রথমে চরিত্রবান হও। ভারতমাতার সেবা করিতে যদি চাও তাহা হইলে বীর্যবান হও। দেশমাতৃকার দুর্গতি দূর করিবার জন্য প্রচণ্ড শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করিয়া অগ্রসর হও। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ পাঠ করিলে শক্তিলাভ করিবে।’ স্বামীজীর এই উপদেশ আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করিয়াছি এবং আমার সাধ্যমতো দেশমাতৃকার সেবা করিয়াছি।
 ১৯০২ খ্রীষ্টাব্দের ৪জুলাই স্বামীজীর পরলোক-প্রাপ্তি হয়। সেই হইতে আজ পর্যন্ত একদিনের জন্যেও আমি মনে করিতে পারি না যে, স্বামীজী আমাদের মধ্যে নাই। তাঁহার সেই অমোঘ বাণী আমাদের কানে প্রতিনিয়ত ধ্বনি দিতেছে: ‘সাহস অবলম্বন করিয়া স্ব স্ব কর্ম করিয়া যাও। জয় তোমাদের অনিবার্য।’ আমার বয়স যতই বাড়িতে লাগিল, ততই বুঝিতে পারিলাম স্বামী বিবেকানন্দের বাণীই আমাদের একমাত্র অবলম্বন এবং একমাত্র সম্বল।
 সেই কারণে স্বামী বিবেকানন্দ আমাদের হৃদয়ের মানুষ, সমগ্র চৈতন্যের সাথী। স্বামী বিবেকানন্দ যত বড় মহাপুরুষই হউক না কেন -- বাংলার বিপ্লবীরা তাঁহাকে দেখিয়াছেন বন্ধুরূপে, পথদ্রষ্টা অগ্রজরূপে। ( স্মৃতির আলোয় স্বামীজী, স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ )

Post a Comment

0 Comments