জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ১৯ /বিজন সাহা


ভোলগা নদীর খোঁজে – ১৯

বিজন সাহা 

কস্ত্রোমা 

কস্ত্রোমা, ভোলগার তীরে রাশিয়ার প্রাচীন শহরগুলোর একটি। ১১৫২ সালে ইউরি দোলগোরুকি এই শহর প্রতিষ্ঠা করেন। মস্কো থেকে ৩৩০ কিলোমিটার দূরে এই শহরে বর্তমানে ২৬৬ হাজার মানুষ বসবাস করে। দ্বাদশ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত এই শহর ত্রয়োদশ শতকে স্থানীয় রাজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়। শহরের ঐতিহাসিক কেন্দ্রে অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকের স্থাপনা কমবেশি সুরক্ষিত আছে। তবে পিটার দ্য গ্রেট পূর্ববর্তী যেসব স্থাপনা এখনও আছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ইপাতিয়েফস্কি আর বোগোইয়াভলেনস্কি-আনাস্তাসিনি মনাস্তির দুটো। এই শহর বর্তমানে সরকারীভাবে ঐতিহাসিক শহরের মর্যাদা প্রাপ্ত। এছাড়া বর্তমানে কস্ত্রোমা রিজিওনের রাজধানী কস্ত্রোমা শ্রম শক্তির শহরের মর্যাদাও পেয়েছে। আর এর অর্থ হল কস্ত্রমা শুধু প্রাচীন ঐতিহাসিক শহরই নয়, বর্তমান রাশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাছাড়া কস্ত্রোমা রাশিয়ার গোল্ডেন রিঙের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৬০ এর দশকে ইউরি বিচকভ, যিনি গোল্ডেন রিং নামক এক ট্যুরিস্ট রুটের প্রস্তাব করেন, নিজে কস্ত্রোমা শহরের নাম এখানে যোগ করেন।

আমরা বেশ কয়েকবার গোল্ডেন রিঙের কথা উল্লেখ করেছি। হয়তো এ নিয়ে পাঠকদের মনে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। দেখা যাক কখন, কিভাবে এর উৎপত্তি। রাশিয়ার গোল্ডেন রিং বা জালাতোয়ে কালৎসো রাসিয়ি – এটা একটা ট্যুরিস্ট রুট যা উত্তরপূর্ব রাশিয়ার বিভিন্ন শহরকে, যেখানে রাশিয়ার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ইউনিক মনুমেন্ট ও স্থানীয় শিল্প অক্ষত অবস্থায় আছে, এক সূত্রে বেঁধেছে। ১৯৬৭ সালে নভেম্বর সংখ্যার সোভিয়েতস্কায়া কুলতুরা বা সোভিয়েত কালচার নামক জার্নালে সাংবাদিক ও লেখক ইউরি বিচকভ এই রুটের নাম ও আইডিয়া প্রকাশ করেন। পরে এটা সোভিয়েত পর্যটন ব্যুরো কর্তৃক গৃহীত হয়। গোল্ডেন রিঙের শহরগুলো হল – সেরগিয়েভ পাসাদ (সোভিয়েত আমলে জাগোরস্ক), পেরেস্লাভল-জালেস্কি, রোস্তভ ভেলিকি, ইয়ারোস্লাভল, কস্ত্রোমা, ইভানভা, সুজদাল, ভ্লাদিমির। ট্র্যাডিশনালি এই আটটি শহরই গোল্ডেন রিঙের অন্তর্ভুক্ত। তবে এখন আরও অনেক শহরই নিজেদের গোল্ডেন রিঙের অংশ ভাবতে পছন্দ করে। এখানে বলে রাখা ভালো যে গোল্ডেন রিঙের শহরগুলোর প্রতি আমার আকর্ষণ সেই সোভিয়েত আমল থেকেই। ১৯৮৩ সালে এদেশে আসার পর বিভিন্ন সময়ে গোল্ডেন রিঙের বেশ কয়েকটি শহরে যাই। জাগোরস্ক, যা বর্তমানে সেরগিয়েভ পাসাদ নামে খ্যাত ও রুশ অর্থোডক্স চার্চের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র, গেছি বেশ কয়েকবার – সেটা সেই সোভিয়েত আমলে আর নতুন রাশিয়ায়ও। পেরেস্লাভল-জালেস্কিতে শুধু যাইই নাই, ১৮৮৯ সালে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলেক্টের উপর ইউনেস্কোর সেমিনারে অংশ নিয়ে প্রায় দু সপ্তাহ সেখানে ছিলাম। সুজদাল গেলেও সেটা অপূর্ণ রয়ে গেছে, কেননা রাস্তায় গাড়ি নষ্ট হলে আমরা সেখানে পৌঁছুই রাতের বেলায় তাই তেমন কিছু দেখা হয়নি। রোস্তভ, যা বর্তমানে রোস্তভ ভেলিকি নামে পরিচিত সেখানেও যাই ছাত্রাবস্থায়। আর ভ্লাদিমির যাই নব্বুইয়ের দশকে লেখক দ্বিজেন শর্মা আর বন্ধু মামুনের সাথে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে সোভিয়েত আমলে চাইলেই কোথাও যাওয়া যেত না, আগে থেকে পারমিশন বা ভিসা নিতে হত। ইয়ারোস্লাভলের কথা তো আগেই বলেছি। তাই বাকি দুই শহর কস্ত্রোমা আর ইভানভার প্রতি একটা আকর্ষণ সব সময়ই ছিল। তাই সে অর্থে এবার কস্ত্রোমা আসা মানে আরও একটা স্বপ্ন পূর্ণ হওয়া। 
🍂
কস্ত্রোমা নামটি কোত্থেকে এলো সে ব্যাপারে বিভিন্ন ইতিহাসবিদদের মধ্যে এখনও মতৈক্য নেই। অনেকের ধারণা  যে নদীর উপর শহর দাঁড়িয়ে বা এখানে যে নদী ভোলগায় পড়ছে সেই নদীর নাম থেকে শহরের নাম করা হয়েছে। কিন্তু রুশ সাম্রাজ্যের ১৭৪৫ সালের বিশাল সাধারণ মানচিত্রে ও ১৭৬০ সালের ডাক বিভাগের মানচিত্রে কস্ত্রোমা ভাসসেইয়া নদীর উপর অবস্থিত বলে উল্লেখ আছে। তাই ধারণা করা হয় যে পরবর্তীতে নদী নিজেই শহরের নাম গ্রহণ করে। কস্ত্রা বা কস্ত্রিকা পূর্বাঞ্চলের স্লাভিক ডায়ালেক্টে লিনেন ইত্যাদি যেসব গাছের আঁশ থেকে থেকে কাপড় তৈরি করা যায় তাদের কাণ্ড বোঝায়। যেহেতু বস্ত্র শিল্প কস্ত্রোমার অর্থনীতিতে বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে তাই অনেকের ধারণা এখান থেকেই শহর তার নাম পেয়েছে। আবার কেউ কেউ পূর্বস্লাভিক জাতির রীতির সাথে জড়িত এক পুতুল, যাকে কস্ত্রোমির সৎকার্য নামে গ্রীষ্মের এক উৎসবে পুড়ানো হত, তার নাম থেকে শহরের নাম হয়েছে বলে মনে করেন। এটা শুনে আমার মনে পড়ে গেল পৌষ সংক্রান্তিতে ভেলাভূলা পুড়ানোর কথা। ভিন্ন এক মতে কস্ত্র, কস্ত্রোমা, কস্ত্রুমা – এসব দুর্গের প্রতিশব্দ। তাই দুর্গ থেকেই শহরের নাম এসেছে। তবে হয় নদী অথবা প্যাগান গড - এই দুটোর একটা থেকে শহর তার নাম পেয়েছে বলে বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ মনে করেন।           

প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যে বর্তমান শহরের কেন্দ্রে খ্রিষ্টপূর্ব ৩ হাজার বছর আগের ফাতিয়ানভ কুঠারের সন্ধান মেলে যা ব্রোঞ্জ যুগের সমাধিতে ছিল বলে মনে করা হয়। সুলি নদীর অন্য তীরে প্রথম সহস্রাব্দের মধ্যবর্তী সময়ের কেরামিক পাওয়া যায় যা এখানে ফিন্নো-ইউগ্রিক জাতির বসবাসের সাক্ষী দেয়। কস্ত্রোমা ক্রেমলিনের ওখানে একাদশ শতকের মহিলাদের কাঁচের ব্রেসলেট পাওয়া গেছে। তাছাড়া এখানে গাছের বাঁকলে লেখার মেটালিক বস্তুও পাওয়া গেছে। তবে সরকারি ভাবে ১১৫২ সালকে কস্ত্রোমার প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী হিসেবে গ্রহণ করা হয়।     

ধারণা করা হয় যে সুলি নদীর তীরে উঁচু জায়গায় শহর স্থাপন করা হয়। এখানে ত্রয়োদশ শতকের শহরের প্রাচীনতম ফিওদরভ গির্জার উপস্থিতি সে কথাই বলে। ১২৭৬ সালের দিনপঞ্জি থেকে জানা যায় এই গির্জায় কস্ত্রোমার রাজা ভাসিলি সমাহিত। এক সময় সুলি নদীর দু পাশের শহর বিস্তৃত ছিল বলে অনেকেই মনে করেন। কিন্তু মূল অংশ ছিল নদীর ডান দিকে কস্ত্রোমা নদীর ওখানে কেননা আনাস্তাসিন, স্পাসো-জাপ্রুদনেনস্কি, ইপাতিয়েভস্কি এসব প্রাচীন মনাস্তির শহরের এই অংশেই অবস্থিত।   

কস্ত্রোমার প্রধান প্রধান দর্শনীয় স্থানের মধ্যে ভস্ক্রেসেনস্কি গির্জা, সভ্যাতো- ত্রইস্কি ইপাতিয়েফস্কি মনাস্তির, জারের আমলের কস্ত্রোমা শপিং মল, সুসানিন স্কয়ার, বোগোইয়াভলেনস্কি আনাস্তাসিন মহিলা মনাস্তির, ইভান সুসানিনের স্ট্যাচু, স্পাস গির্জা, স্পাসো-প্রেওব্রাঝেনস্কি কাফেদ্রালনি সাবর, পবিত্র শহীদদের নামে গির্জা, জনামেনস্কি মহিলা মনাস্তির, ইয়োয়ান্নো-জলাতোউসভস্কায়া গির্জা, ইয়োয়ান বোগোস্লব গির্জা, কস্ত্রোমা ড্রামাটিক ও পাপেট থিয়েটার, ইতিহাস, স্থাপত্য ও শিল্পকলার যাদুঘর, থিয়েটার পোশাকের মিউজিয়াম ইত্যাদি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।  এখানে বলা দরকার যে ইভান সুসানিন এদেশের জাতীয় বীর। তাঁর বুদ্ধিমত্তার কারণেই রোমানভ ডাইনাস্টির প্রতিষ্ঠাতা মিখাইল ফিওদরোভিচ পোলিশদের হাত থেকে রক্ষা পান ও পরবর্তীতে এ দেশের জার নির্বাচিত হন। এর মানে এই নয় যে এখানে আধুনিক কিছু নেই। তবে এসব ঐতিহাসিক শহরে মানুষ আসে মূলত প্রাচীন জিনিস দেখতে। যেমন দিল্লি গেলে অন্যান্য অনেক কিছুর আগে মানুষ যায় কুতুব মিনার বা মোঘল আমলের স্থাপত্য দেখতে। তাই ট্যুরিস্ট গাইডে এসবের উপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের প্রায় কিছুই দেখা হয়নি। সব মিলিয়ে আমরা মোটামুটি আধাঘন্টা থেকে চল্লিশ মিনিট সময় সেখানে কাটিয়েছি। যেহেতু ওখানে পৌঁছতে বেলা একটা বেজে গেছে তাই এর বেশি সময় বের করা সম্ভব ছিল না। দেমিদকে রেস্ট নেবার সময় দিয়ে আমি আর দিলীপ হাঁটতে হাঁটতে উঠে গেছি ভোলগার উপরে বিশাল সেতুতে। সেখান থেকেই আশেপাশের যা দু একটা গির্জা দেখা যায় তার ছবি নেয়া আর নীচে জাহাজ ঘাঁটের কিছু ছবি। বৃষ্টি ততক্ষণে থেমে গেলেও মেঘ কাটেনি। তাছাড়া ব্যস্ত ব্রীজের উপর দিয়ে মিছিল করে চলে যাচ্ছে বিভিন্ন রকমের গাড়ি। আমি নিজে কখনই উঁচু জায়গাতে খুব একটা স্বস্তি পাই না, তাই ইচ্ছে থাকলেও ব্রীজ ধরে যে অনেক দূরে চলে যাব সেই সাহস ছিল না। মোটামুটি ব্রীজের মাঝামাঝি গিয়ে আবার ফিরতে শুরু করলাম। দূরে চারিদিকে বিভিন্ন পুরানো গির্জা হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। খুব ইচ্ছে ছিল কাছে গিয়ে ছবি তোলার। কিন্তু আমাদের যেতে হবে অনেকটা পথ। দুপুরের খাবার হবে প্লিওসে। সেটাও ঘণ্টা দেড়েকের পথ। তারপর নিঝনি নভগোরাদ। তাই দুগগা দুগগা করে পথে নামাই   ভালো। তাছাড়া আবহাওয়া তেমন অনুকুলে নয়। সব মিলিয়ে ফিরে এলাম দেমিদের কাছে। গাড়িতে বসেই আশেপাশে কিছুটা দেখে শহর থেকে বেড়িয়ে পড়লাম অজানার পথে।    

কস্ত্রোমার কিছু ছবি 

http://bijansaha.ru/albshow.html?tag=246 

   

Post a Comment

0 Comments