জ্বলদর্চি

তালপিঠা ও জনজীবন /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব- ৮৭
তালপিঠা ও জনজীবন
সূর্যকান্ত মাহাতো

ভাদ্র মাস হল তাল পাকার মাস। সেইসঙ্গে পাকা তাল ও তাল পিঠার মাসও বটে। জঙ্গলমহলের ঘরে ঘরে এই সময় পাকা তালের নির্যাস বা মাড়ি দিয়ে হরেক রকমের 'পিঠা' তৈরি হয়। শুধু কি পিঠা? তালের লুচি, তালের রুটি, পরোটা সবই খুব জনপ্রিয় খাবার। এছাড়াও তালের নির্যাস কে মুড়ি মাখিয়েও অনেকে খেতে ভালোবাসে। অনেকে আবার আবার ক্ষীর বানায়। তবে তার মধ্যে সেরার সেরা হল, 'তালের বড়া'। গোল গোল মিষ্টির আকারের বড়াগুলো স্বাদে ও গন্ধে দুটোতেই অতুলনীয়। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের 'তালনবমী' গল্পেও 'তালের বড়া'র উল্লেখ রয়েছে। সেখানে ক্ষুদিরামের বড় ছেলে 'নেপাল' তার ভাই 'গোপাল'কে এক জায়গায় বলছে, "তালনবমীর বের্তোয় তালের বড়া করে তুই জানিস?" পাশাপাশি পুলি পিঠে, সরু চকলি,পাটিসাপটা সহ অন্যান্য পিঠে তৈরি হলেও বেশি পছন্দ 'তালের বড়া'ই। জঙ্গলমহলবাসীদের আরও একটি পছন্দ হল, তালের 'পাতা সেদ্ধ'। শাল পাতা, টগর পাতা, কাঁঠাল পাতা, কলা পাতা ছাড়াও অন্য পাতা ব্যবহার করা হয় তালের এই পাতা সেদ্ধ পিঠে বানাতে।

তবে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় 'তালের বড়া' বা পিঠা তৈরির সময়কাল হিসাবে কেবল 'তালনবমী' ব্রতের কথাই উল্লেখ করেছেন। কিন্তু জঙ্গলমহলের অধিকাংশ গ্রামের ঘরে ঘরে কেবল 'তালনবমী' ব্রতের দিনই শুধু নয়, তার আগে ও পরের যে কোন দিনই 'তালের বড়া' সহ অন্যান্য পিঠা বানানো হয়। এই 'তালনবমী' সম্পর্কে  প্রাচ্য বিদ‍্যার্ণব নগেন্দ্রনাথ বসু বলেছেন, ভাদ্র মাসের শুক্লা নবমীতে সৌভাগ্য কামনায় স্ত্রীগণ তাল উপহার দিয়ে এমন ব্রতের অনুষ্ঠান করেন বলেই এর নাম 'তালনবমী'।(বিশ্বকোষ, সপ্তম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৭১৭) এই ব্রতে যে নয়টি ফল প্রদান করা হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ফল হল 'তাল'। এই ব্রতে নারীদের কী ধরনের সৌভাগ্য লাভ ঘটে সে প্রসঙ্গে নগেন্দ্রনাথ বসু বলেছেন, এই ব্রতে স্ত্রীদের সবধরণের সুখ, স্বর্গ লাভ এবং জন্ম জন্ম অবৈধ্য লাভ ঘটে। এবং তাদের বাড়িতে লক্ষ্মী নিশ্চলা থাকেন।(বিশ্বকোষ, সপ্তম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৭১৯)

বাড়ির আনাচে কানাচে, পুকুর পাড়ে, মাঠের আলে সর্বত্রই একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে তালগাছগুলো। কিন্তু সব গাছেই তো আর তাল ধরে না। গ্রামের মানুষেরা বলে, পুরুষ তাল গাছে তাল ধরে না। নারী তালগাছগুলোতেই একমাত্র তাল ধরে। কাঁধির উপর পাকা পাকা তালগুলো দেখলে মনে হবে যেন তাদের গলায় ঝুলে আছে। পরিণত আর পক্বতার ভারে সময়ে সময়ে স্খলিত হয়ে পড়ছে। ছেলে থেকে বুড়ো সকলেই ছোটে তাল কুড়োতে।  ছোটরা পাকা তালের গন্ধ শুঁকে নিতে নিতে ছড়া কাটে, 'তাল পড়ল ধুম/তালের পিছন শুঁক।' 
কোনওটা ছোট তাল। এক আঁটি বিশিষ্ট। কোনওটা আবার বেশ বড়। তিন আঁটি বিশিষ্ট। এগুলোকে হাঁড়ি তাল বা হেঁড়ে তাল বলে। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের 'তালনবমী' গল্পের জটি পিসিমাও ঠিক এমন তাল-ই চেয়েছিলেন। নেপাল তাল দেওয়ার কথা বললে, উনি জানতে চেয়েছিলেন, "বেশ কালো হেঁড়ে তাল তো?" আসলে কুচকুচে কালো হাঁড়ি তালগুলোর চাহিদা ও কদর বরাবরই বেশি। কারণ অন্যান্য তাল বিশেষ করে যাদের পিছনের অংশটা কালো না হয়ে হলুদ বা তামাটে হয় সেইসব তালগুলো স্বাদে ততটা ভালো হয় না। একটা তিক্ত ভাব থাকে।
🍂

বর্ষায় চাষের কাজে এসময় সকলেই ব্যস্ত। সারাটা দিন কাজে কাজেই কেটে যায়। তারপরেও কিছুটা অবসর বের করে মায়েরা বসে যান তালের মাড়ি বা নির্যাস বের করতে। দেড় থেকে দু ফুট লম্বা অনেকটা মই বা সিঁড়ির মতো দেখতে একটি 'তালমাড়া'-কে একাজে ব্যবহার করা হয়। দুপাশের কাঠে পরপর কতকগুলো লোহারপাত বসানো থাকে। যার উপর নির্যাসে ভরপুর হলুদ আঁটিগুলোকে কিছুটা জল মাখিয়ে ঘষে ঘষে তালের নির্যাসটা বের করা হয়। যাদের বাড়িতে এমন 'তালমাড়া' নেই তারা দড়ির খাটিয়াকেও এই কাজে ব্যবহার করে। আবার অনেকে ঝাঁজরি ঠেকাকেও ব্যবহার করে। ঠেকাকে উপুড় করে বসিয়ে তার গায়ে ঘসর ঘসর শব্দে উপরের ছাল ছড়ানো তালের আঁটি ঘসলেই ভিতরের দিকে তালের হলুদ নির্যাস পড়ে। মা, কাকিমারা তাল মাড়াতে মাড়াতেই কত সুখ দুঃখের গল্প বলে চলেন। ছোটরা অধির আগ্রহ নিয়ে কেবল অপেক্ষা করে চলে কখন তাল মাড়া শেষ হবে। তালের বড়া খাওয়ার লোভ যেন আর কিছুতেই তাদের সয় না। চলতে থাকা স্বামী-স্ত্রীর মান অভিমান, শাশুড়ির সঙ্গে খোঁটাখুঁটি সবই সহজ হয়ে যায় পিঠা বানানোর খুশিতে। তালের পিঠা তৈরির এই খুশিটা যেন তাদের সব দুঃখ কষ্টকে মুহূর্তের জন্য ভুলিয়ে দেয়। তালের পিঠা কেবল একটি পরিবারের সদস্যদেরই এক সুতোয় বাঁধে না। প্রতিবেশীদেরকেও বাটি ভর্তি পিঠা দেওয়া হয়। সম্পর্কটা আরো নিবিড় করে তোলার জন্য। আত্মীয়দের সম্পর্ককেও তালপিঠা মজবুত করে। এ সময় মেয়ে বাপের বাড়ি গেলে তালের বড়া বা পিঠা নিয়ে যাবেই যাবে। আবার শ্বশুরবাড়িতে এলেও তালের পিঠা সঙ্গে নিয়ে আসে। মেয়ে না এলে মায়েরাও আবার অনেকে তালের পিঠা নিয়ে মেয়ের বাড়ি যান। ছোটবেলা থেকেই মেয়েকে তালপিঠা খাওয়ানোর খুশিটা যেন বড়বেলাতেও শেষ হতে চায় না।

বাড়ির বয়স্করা মাঝে মাঝেই  ছোটদের তাল কুড়ানোর নানান সব রোমহর্ষক গল্প শোনায়। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শেষ রাত্রি বা ভোরবেলাতেই সকলে তাল কুড়োতে যায়। দিনের বেলা পাকা তাল সহজে পাওয়া যায় না। কেউ না কেউ কুড়িয়ে নেয়। তাই রাত্রির অন্ধকারে হাতি ও সাপের ভয়কে উপেক্ষা করে কীভাবে তারা তাল কুড়োতে যেত তার নানান সব গল্প শোনায়। কতবার ভুত দেখেছে, বা ভুতের মুখোমুখি হয়েছে তারও নানা রোমহর্ষক গল্প শোনায় ছোটদের। 

জন্মাষ্টমীতে তালের ক্ষীর ভোগ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এই উৎসবে তালের নানা পিঠাও তৈরি করা হয়। তাই তালের চাহিদাও থাকে দারুণ। পাঁচ দশ টাকার তাল তখন ত্রিশ থেকে চল্লিশ টাকা পর্যন্ত দর উঠে। তাই অনেকেই এই সময় তালপাকা বিক্রি করে বাড়তি কিছু রোজগারও করেন। সুতরাং ভাদ্র মাসে  অভাব ও কষ্ট যেমন থাকে সেরকম তালের পিঠা খাওয়ার খুশিও থাকে অনেক বেশি।

Post a Comment

0 Comments