গুচ্ছ কবিতা / শুভশ্রী রায়
পরী পাড়ি
যে পরীটা আটকে ছিল আমার মায়ের ভেতর,
আমার গভীরে সে মনমরা হয়ে থাকে আজও,
বোনের আকৃতির মধ্যে শুধু একটু ছটফট করে।
আমার মায়ের কাঠামোয় যে পরীটা বন্দী ছিল,
মুক্তি সে পেয়েছে বোনের মেয়ের গহন থেকে,
চার সমুদ্র অন্তত একশো নদীর পরে ইচ্ছা-ঘরে
বোনঝির চুল নিয়ে বিদেশি হাওয়া যখন খেলে,
সেই পরীটা কিশোরীর পাশাপাশি তাথৈ নাচে,
চাঁদের পাশে চুল খুলে দেয় দু'জনেই ভালোবেসে;
রেশমি চুলের ফাঁকে ফাঁকে মখমলি চাঁদ গল্প আঁকে।
মায়ের অবয়বে পরী এক আবদ্ধ ছিল অবধারিত,
আমাকে পুরো বিয়োগ করে, বোনকে পেরিয়ে
বোনঝির ভেতর জেগে উঠেছে নিজের মতো-
আলোর সাথে গল্প করে হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দেয়,
পরীর অঙ্গে অবশেষে মায়ের মুক্তি হয়ে গেছে।
বিভ্রম
নিজের মতো করে স্বপ্নটিকে জড়ো করো তুমি,
পানীয়ের বাহারি গ্লাসে জ্যোৎস্না মেশাও,
টলটলে সুরায় ভাসে-ডোবে হাসিখুশি চাঁদ,
রাত এসে পানীয়তে ঝাঁপ দেয় পোষাক খুলে রেখে;
ক্রমশ তোমার পৃথিবী সন্তোষে ভরে ওঠে।
খুশির লালিমা লাগে দেওয়ালের বিবর্ণ গালে,
ঘরে থইথই আনন্দ, যার শেকড় তোমার বোধে;
স্বপ্ন নিজের নেশায় তোমাকে দিলদার করে তোলে।
নন্দিনীর কাকু
সোওয়া ন'টা নাগাৎ অফিসের জন্য বেরতো নন্দিনীর কাকু,
পাটপাট টেরিকট বা সুতির জামায় ঝকঝকে,
পেছন পেছন দু' বিনুনি, স্কার্ট পরা আমি ছুটতাম যে কোনও দিন..
এই কারণে পড়াশোনায় মনোযোগ একটু কমে গিয়েছিল সেই সময়,
কাছের লোকেদের ধারণা আর কী!
অত ছোটাছুটি করে কোনও লাভ হয়নি অবশ্য
বরঞ্চ আমার কিছু খুচরো দুর্নাম জুটেছিল,
উনিশ থেকে কুড়ির মধ্যে ওটুকু অর্জন হতেই পারে...
তেত্তিরিশ বছর পরে বাস্তবের আজ
সে সব গল্পকথা হয়ে ক্রমে ক্রমে মরে গেছে,
এত দিনে সম্ভবত অবসর নিয়েছে নন্দিনীর কাকু, নিজের নয় অবশ্য..
তার আর আমার মাঝখানে ধকধক করে উনিশ বছর বয়সী একটা হৃৎপিন্ড,
জীবনের বেশ কিছু অদ্ভুত মোচড়
আর আলো-হাওয়া-বৃষ্টি ভেদ করে প্রত্যাশার দিকে চলমান একটা দুর্নিবার রিক্সা,
যেটায় বসে বাস স্ট্যান্ড অবধি পৌঁছত নন্দিনীর সুপুরুষ কাকু।
পথসর্বস্ব
টাকা নেই, সামান্য কিছু চঞ্চল পয়সা ঝনঝন করে,
চাঁদসূর্যের গুঁড়ো যথাসাধ্য কুড়িয়ে নিয়ে
কোথায় রাখব বুঝতে পারি না,
ভেতরে এনে রাখতে না রাখতেই,
একটুখানি ঘরবাড়ী জ্বলতে শুরু করে,
আবার রাস্তায় নিজেকে খুঁজে পাই;
দুনিয়ার সব রাস্তা নির্বিকার,
চুপচাপ দেখে আমার চাঁদসূর্য সঞ্চয়ের বাতুলতা,
সহানুভূতিতে ভরে যায় তাদের হৃদয়।
প্রতিটি পথই নিঃস্ব আমার মতন,
করুণ হাতে আলো কুড়োতে কুড়োতে
নিজেও ক্রমশ পথ হয়ে যাই।
0 Comments