জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৮৮/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৮৮
শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা
প্রীতম সেনগুপ্ত

 এই দুনিয়াকে পরতে পরতে চিনেছিলেন বিবেকানন্দ
 
 এই পৃথিবীকে পরতে পরতে চিনেছিলেন স্বামীজী। বিশিষ্ট বিবেকানন্দ গবেষক, প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক শঙ্করীপ্রসাদ বসু লিখছেন ---- “জীবন বিচিত্র, পৃথিবী বিচিত্র --- একথা বিবেকানন্দের চেয়ে বেশি কে জানেন। যিনি মায়ার ছাল ছাড়িয়ে ব্রহ্মফলটি খাওয়ার চেষ্টা করে গেছেন সারাক্ষণ। সবাইকে তিনি দেখতে পারতেন তাদের আসল চেহারায়। যদি দেখতেন, নিজের লেজ কেটে কেউ পরের লেজে হাত দিচ্ছে, তখন হ্যাঁচকা টানে তার খোলসটা খুলে দিতেন আর উপভোগ করতেন উদোম নাচ।
 এহেন  বিবেকানন্দ ইংরেজের আসল চেহারা একবার দেখাচ্ছিলেন আমেরিকার এক সভাস্থলে। ইংরেজ মুখে ভালবাসার কথা বলেও কিভাবে অপরের গলা কেটে রক্ত খায়, সেই কথা বলার সময়ে  অল্পদিন সভ্য হয়েছে, তাও বলতে ছাড়েননি।‌ -- ‘আঃ -- হাঃ -- ঐ ইংরেজরা! এই তো কিছুদিন আগেও তারা বন্য ছিল! তাদের মেয়েদের জামার মধ্যে পোকা কিলবিল করে বেড়াত। গায়ের বিকট দুর্গন্ধ ঢাকতে তারা প্রচুর সেন্ট ঢালত।’ এসব কথা শুনে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে এক শ্রোতা বলে উঠল -- ‘আপনি কী বকছেন? অল্পদিন আগে? বাজে কথা। ও অন্ততঃ পাঁচশো বছর আগেকার ব্যাপার --।’ স্বামীজী তাতে মধুরতম উত্তর দিয়েছিলেন --‘কিন্তু আমি কি বলিনি মাত্র কিছুদিন আগে? মানবজীবনের প্রাচীনত্বের তুলনায় কয়েকশো বছর আর এমন কি? -- ঠিক নয়?’
 পরাধীন ভারতের ছেলেরা শতাধিক বৎসর ধরে ইংলণ্ডের ইতিহাস পড়ে জেনেছিল -- হিংস্র মুসলমানদের বিরুদ্ধে ধর্মপ্রাণ খ্রীস্টানরা ক্রুজেড লড়েছিল। স্বামীজী উল্টো কথাই শুনালেন। আসলে সভ্য ছিল মুসলমানেরাই -- বর্বর ছিল খ্রীস্টানরা, যারা যুদ্ধকালে ‘খাবার না পেলে মুসলমান ধরেই খেয়ে ফেলত।’ এমনকি তাঁর মারফত এই প্রসিদ্ধির কথা জানা গেল যে, ‘সিংহ-হৃদয়’ মহাত্মা ‘রাজা রিচার্ড মুসলমান -মাংসে বিশেষ খুশি ছিলেন।” ( সহাস্য বিবেকানন্দ, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, নবভারত পাবলিশার্স, পৃঃ ১৬৯ )
 রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের ইংরেজি মুখপত্র ‘প্রবুদ্ধ ভারত’-এর নভেম্বর, ১৯০২ সংখ্যায় জনৈক খ্রিস্টান লেখক লিখছেন একটি নিবন্ধ ‘The Christian Missionaries’। এই লেখক বিষয়ে পরিচয় দিতে গিয়ে সম্পাদক জানাচ্ছেন -- “We invite the attention of our readers to this paper contributed by an esteemed brother, a true Indian in instincts, though he happens to be christian.“ যাই হোক, এই লেখক লিখছেন -- “We have been told that when an Englishman leaves Suez and comes eastward, a transformation comes over him. He becomes a different man altogether, mentally and morally; but unfortunately, in the wrong direction. However this may be, we have often wondered how it was that the average Anglo-Indian missonary never found it necessary to modify his ideas as to the object of his coming out here. From the reports we read of missionary meetings in England, it is evident that the impressions created in minds of  people there, by the missionaries, of their work in this country is an utterly false one. For they represent Hinduism as altogether a gross and unshapely superstition, and the people, as sunk in the densest darkness, mental, moral and spiritual. The whole vast population of this great and ancient country, from the intellectual Brahmin down to the very lowest class, are actually made out as living without hope and without God; and created, it would appear, for no other purpose than to serve as a field of ripened corn for the christian missionary to cut down with his biblical sickle carry away in cart-loads to his church, Chapel or Gospel Hall, according to the particular caste of the many sectioned creed he happens to belong to.”
 শঙ্করীপ্রসাদ আরও লিখছেন -- “সব দেশে ধর্মের আজগুবিগুলি বিজ্ঞানের যুক্তি দিয়ে করবার এক ঢেউ উঠেছে, স্বামীজী বললেন। পরাধীন দুর্বল মানুষ যখন ও-চেষ্টা করে, তবু সহ্য করা যায় কিন্তু সত্যাভিমানীরা যদি তা করে? অনেক খ্রীস্টান পাদরী তাই করেছিলেন, যখন দেখেছিলেন -- বিজ্ঞানের ধাক্কায় তাঁদের ধর্মভিত্তি টলোমলো। খ্রীস্টান ধর্মের এহেন এক শশধর তর্কচূড়ামণি স্বামীজীকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন -- ইহুদি-নেতা মুসা লোহিত সাগর পায়ে হেঁটে পার হয়েছিলেন, আর পিছনে ধাবমান মিশরী ফৌজ জলে-কাদায় ডুবে গিয়েছিল -- এসব জিনিসের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সম্ভবপর। এই প্রকার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পরক্ষণে যখন দেখা গেল ধোপে টিকছে না, তখন এঁরা বলে বসলেন -- ‘ওটা আমি বিশ্বাস করি। আমার মন সাক্ষ্য দেয়।’ এরকম ব্যক্তিদের সম্বন্ধে স্বামীজী বিতৃষ্ণায় বলেছিলেন -- ‘ওঁদের আবার মন। ছটাক নয়, আবার মণ।’
🍂

 স্বামীজী এই তামাসা দেখলেন -- পাশ্চাত্ত্যদেশ যীশুখ্রীষ্টের নির্বৈর ও বৈরাগ্যের উপদেশ নিল না, নিল ভারতবর্ষ, এবং সে প্রত্যাখ্যান করল কৃষ্ণের মহা রজোগুণের এই বাণী --‘মহা উৎসাহে কার্য করো, শত্রুনাশ করো, দুনিয়া ভোগ করো।’ ঐ বাণী উল্টো-পক্ষে পাশ্চাত্ত্যদেশ নিয়ে নিয়েছে। তাঁর ফলে স্বামীজীকে হিন্দু-নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে ‘খ্রীষ্টান’ ইউরোপের এই অপূর্ব পরিহাস শুনতে হয়েছিল -- ‘হিন্দুরা করেছে কি? একটা জাতিকেও জয় করেনি।’
 ইতিহাসের আরও পরিহাস স্বামীজী ভারতে দেখেছেন। ভারতে উচ্চবর্ণের কাছে নিম্নজাতির মানুষ ‘চলমান শ্মশান’ -- অকস্মাৎ সে ‘চলমান প্রাসাদ’ হয়ে পড়ে যদি কোনো পাদরী এসে মন্ত্র আউড়ে তার মাথায় খানিকটা জল ছিটিয়ে দেয়, আর সে একটা জামা পরতে পায়, যত ধুলধুলে ছেঁড়াই হোক তা। এখন সে গোঁড়া হিন্দুর বাড়িতে প্রবেশাধিকার পেয়ে যায়।’ স্বামীজী বলেছেন, ‘আমি তো এমন লোক দেখিনা যে, তাকে এখন একখানা চেয়ার এগিয়ে না-দিতে বা তার সঙ্গে সপ্রেম করমর্দন না- করতে সাহস করে। এর থেকে অদৃষ্টের পরিহাস আর কি হতে পারে?’
 জীবনের কত পরিহাস, প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্ত্যে! স্বামীজীর দেখলেন, ভারতে বিধবার অশ্রুতে পৃথিবী সিক্ত, পাশ্চাত্ত্যে আকাশ-বাতাস পূর্ণ কুমারীর দীর্ঘশ্বাসে। একদিকে রয়েছে বিধবা-সমস্যা, অন্যদিকে ওল্ডমেড-সমস্যা।... ইংলণ্ডে থাকাকালে একটি চাঞ্চল্যকর মামলাসূত্রে সংবাদপত্র থেকে তিনি জেনেছিলেন -- অজস্র সদ্যোজাত শিশুকে গলা টিপে মেরে টেমসের জলে ফেলে দেওয়া হয়। ও-পাপ যারা করে তারা অধিকাংশই কুমারী। স্বামীজী বলেছিলেন -- ‘The water of Thames has turned into babies soup.’ -- টেমসের জলে শিশুমাংসের ঝোলে পর্যবসিত হয়েছে।” ( সহআস্য বিবেকানন্দ, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, নবভারত পাবলিশার্স, পৃঃ১৬৯-১৭০ )
 চলমান সমাজ, তার ভাবনা, চিন্তাধারার মূলস্রোত, বস্তুবাদ, অধ্যাত্মবাদ, সংশয়বাদ সব কিছুই বিবেকানন্দ মননে মুহূর্তে বিশ্লেষিত হয়েছে।‌ সেইসব বিশ্লেষণ মানবজাতিকে সামগ্রিকভাবে আলোকিত করেছে। দেখিয়েছে ভাবনার পথ। ভাবতে শিখিয়েছে। জীবনকে এমনভাবে ভাবতে একমাত্র বিবেকানন্দ স্বামীই পেরেছেন তাঁর ঐশ্বরিক চেতনায়।‌ জনমানবের কাছে যা অমূল্য পাওনা। বেঁচে থাকার ‘খাঁটি রসদ’।

Post a Comment

0 Comments