জ্বলদর্চি

কালের অতল তলে কলোরাডো /১৯ পর্ব/ চিত্রা ভট্টাচার্য্য

কালের অতল তলে কলোরাডো 
১৯ পর্ব

চিত্রা ভট্টাচার্য্য
                                                                                  
প্রকৃতির তীর্থ পথে ঘুরে নিত্য নতুনের মাঝে আনন্দের লহরী তুলে এত দিন যে অন্তহীন চলার স্রোতে ভেসেছি তাতে পথকে  আপন সখার মত ভালবেসেছি । সে পথের অসংখ্য ছোট বড়ো বাঁকে ঘুরে সঞ্চয়ের থলি দুই হাত ভরে কুড়িয়ে নিয়েছি  অজস্র মণি মুক্তো।  অজানা ,অচেনা কে চেনা জানার নেশায় ,অদেখা কে দেখার আনন্দে বাঁধ ভাঙা যৌবনের দুরন্ত স্পর্শে বাঙময় হয়ে উঠেছিল আমার পথ পরিক্রমা। কখনো পথ চলার ক্লান্তি এসে পা দুটোকে জড়িয়ে ধরলেও হাল ছাড়িনি। অবসন্ন শরীরের সমস্ত জড়তা ক্লান্তি এক নিমেষে মুছে ফেলে উপত্যকা পাহাড় প্রান্তর পার হয়ে  ষাটোর্ধ্ব আমি উদ্ধত যৌবনের সাথে তালেতাল মিলিয়ে চলেছি তাদের ই একজন হয়ে। অতনু হিসেব করে এক নতুন তথ্য বলে ,   এই যুক্তরাষ্ট্রে মোট প্রদেশের সংখ্যা প্রায় ৫০ টির মত। তার প্রতিটি প্রদেশে রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব ভাবনা। একটি প্রদেশ থেকে আরেকটি প্রদেশ বিভিন্ন দিক থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেছে যুগের পর যুগ ধরে এবং তারা সম্পূর্ণ আলাদা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রদেশ গুলো বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন কারণে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম নেভাদা রাজ্য টির এই শহর লাস-ভেগাস। ইয়াম বলে এখানে পা দিয়েই তার বিশেষত্বের পরিচয় যে কোনো বিদেশী মানুষ অনায়াসেই পেয়ে যাবে । 

      দিনের আলোয় সবুজ শ্যামল কার্পেটে ঢাকা মাটির ঢিবির মত পাহাড়ের পাশ দিয়ে যাবার সময় ইয়ামের নীল চোখের তারা বড়ো হয়ে ওঠে, ঘন আঁখি পল্লব মেলে স্বগোতক্তি করে ''রাতে যেখানে জনস্রোত বই ছিল,এখন দেখো দিনের আলোয় এক নির্ঝঞ্ঝাট শান্ত ঘুমন্ত পুরী। রাতের  প্রমোদে মত্ত   নগরী, পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত ,বর্ণে গন্ধে সাজে আলোক সজ্জায় আলোকিত এক লাস্যময়ী নগরী। দিনের আলোয় তার এখন ক্লান্ত বিমর্ষ ,শান্ত সমাহিত রূপ। রাতের বাসরের সাথে এ লাস ভেগাসের কোনো তুলনা হয় না। আসলে এই বিশাল শহরটি  গড়ে উঠেছে আমেরিকান বাসী নানা জাতির অজস্র মানুষের সঙ্ঘবদ্ধ  mixed culture.এ। যে পরিবেশের সাথে কোনো সুস্থ সামাজিক জীবন অভ্যস্থ নয়। সারা রাত জেগে ক্যাসিনোর হুল্লোর বাজি আলোর রোশনাই মদের ফোয়ারায় আলুথালু যে সামাজিক চিত্রের পরিচয় পেলাম ,সেই নগর জীবনের ভবিষ্যতের মানুষ গুলোর পরিণতি কী হতে পারে ?        ডলার আছে , বৈভব আছে , প্রকৃত সুখ কি আছে? আমাদের আলোচনায় এই বিলাসী  শহরের গল্পই বারবার ঘুরে ফিরে আসছে যদিও আজ এতদিন পর ঘরে ফেরার তাগিদে মন চঞ্চল।  

 একটি সমীক্ষায় দেখেছিলাম আমেরিকার প্রসিদ্ধ শহর গুলোর মত লাস ভেগাস শহরটি নিজেকে বিশ্বে বিনোদনের রাজধানী হিসাবে তুলে ধরায় এখানে জনসংখ্যা মারাত্মক ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে অবসর জীবন যাপনের জন্য লাস -ভেগাস বেছে নিচ্ছেন কারণ মেগা ক্যাসিনো-হোটেল সম্পর্কিত কাজের সুবিধার জন্য ক্রমশঃএই শহর বিখ্যাত হয়ে উঠছে। এখানের বেশীর ভাগ মানুষ আসে  ক্যালিফোর্নিয়া থেকে  শহরটির আলোচনা সহজে শেষ হতে চায় না ,আমার মনে হয় সমাজ জীবনের নানা ওঠা পড়া ,ভালো মন্দ ভরা এক দুষ্প্রাপ্য উপন্যাসের ছেঁড়া পাতা দিয়ে সাজানো কয়েকটি পর্ব। যত দেখছি তত প্রশ্নের পর প্রশ্ন মনের মাঝে উঁকি দিয়ে চলেছে। অতনু উচ্ছসিত হয়ে ওঠে বলে ,উপন্যাস নয় গো , এ শহর যেন মন্দ ভালো মেশানো কোনো ছোট গল্পের মত যার কথা শেষ হয়েও শেষ হতে চায় না। পারভীন কে খুব  মিস করছি আমরা সবাই। ইয়াম বলে ও থাকলে অতনুর সাথে এখনি তুমুল তর্ক, বেশ ঝগড়া শুরু হয়ে যেত।       
 ইয়াম স্মৃতি চারণ করে ,এর আগে একবার মহাকাশ থেকে প্লেনে রাতের বেলায়  লাসভেগাস কে দেখেছিলাম  ,যখন ওপর থেকে ভেগাসের বুকে নামছিলাম,তখন নীচের দিকে তাকিয়ে প্লেনের প্রতিটি যাত্রী আলোকজ্জ্বল ভেগাসের রূপের মুগ্ধতায় মোহিত হয়ে  শহরটি কে পৃথিবীর সবচেয়ে এক অপরূপ  আলোকজ্জ্বল স্থান নামে নামাঙ্কিত করে ছিল। এবং সে যে বাস্তবিক ই এক আলোকজ্জ্বল নগরী ,সারারাত ধরে লক্ষ লক্ষ বাতি জ্বলতে থাকার কারণেই মূলত রাতের রানী  স্বর্ণালংকারে সজ্জিতা হয়ে জরোয়ার ঝুমকোর মত ঝলমলে করে  ত্রিভুবন মাতিয়ে রাখে। রাত ভর দীপাবলি উৎসবের আয়োজনে আঁধারের সব মলিনতা মুছে এ শহর রাতে নব আনন্দে জেগে ওঠে।                       
 অজস্র প্রশ্ন মনের মাঝে,ঘোরে ,ভাবছি এতো যে আলোর বন্যায় প্লাবিত শহর ,এতো বাতি জ্বালানোয় একদিকে যেমন বিদ্যুৎ শক্তির অপচয় ,অপরদিকে তেমন পরিবেশ ও দূষিত হচ্ছে। ব্রতীন বলে ,না ,না তুমি যা ভাবছো তা একদম ই ঠিক নয়। সবচেয়ে উল্লেখ যোগ্য ঘটনা হল এই ভেগাসে সকল সরকারি দালান, রাস্তার বাতি,পার্কে পুনঃ নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করা হয়। ‘বুল্ডার সোলার ১’ নামে ভেগাসে ১০০ মেগা ওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন একটি সোলার প্ল্যান্ট গড়ে উঠেছে। ২০০৮ সালে যার সৃষ্টি এবং ব্যবহার শুরু হয়েছিল। তৎকালীন সময়ে এই সোলার প্লান্ট তৈরী করতে খরচ হয় প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার। এই প্ল্যান্টের কারণে ভেগাসে বিদ্যুৎ শক্তির অপচয় প্রায় ৩০% কমে গিয়েছে।

 গত রাতে শহরের পথে বেড়ানোর সময় আলোর নগরীতে মনোমুগ্ধকর স্থাপনা দেখে উৎফুল্ল  হয়ে   ছিলাম। বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে দেখেছি শহরের মাঝখানে গড়ে তোলা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কাঁচের তৈরি পিরামিড টির সাথে অজস্র স্থাপত্যের নিদর্শন দিকে দিকে সাজানো রয়েছে। আতিথেয়তায় তাই সমগ্র বিশ্বের দরবারে এক নেতৃত্ব প্রদানকারী শহর হয়ে উঠেছে লাস ভেগাস। এবং সেখানে ফাইভষ্টার ডায়মন্ড হোটেলের কত যে অবস্থান রয়েছে সে গুনে শেষ করা যাবে না।এখানে ঐশ্বর্য্যের আড়ম্বর যত সহজে চোখে পড়ে ঠিক তত টা সতর্কতার সাথেই আড়াল করে রাখা হয়েছে নগরের কুৎসিত তম রূপ কে ,তার অন্তহীন দারিদ্র্যতা কে। সকালেই তো গ্যারি সাহেবের সাথে সেই অকল্পনীয় জীবন সংগ্রামের দৃশ্য স্বচক্ষে দেখে বিমূঢ় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। এখন শহরের মাঝখানে গড়ে ওঠা বিশালাকার সেই বিলাসবহুল হোটেল টির পাশ দিয়ে চলেছি  যেখানে ৫০০০ কক্ষ রয়েছে। কিন্তু সেই কক্ষ গুলোতে স্থান হয় শুধুই পয়সাওয়ালা সমাজের পদাধিকার জনিত রহিস শ্রেণীর। ,ভি.আই.,পি ,বা আরাম বিলাসে মত্ত ছুটি কাটাতে আসা সেলিব্রেটি হলিউডের ফ্লিমস্টারদের।

  রাতের পথে যত এগিয়েছিলাম ,দেখেছি   ,কত যে --ঝর্না ধারা বয়ে চলেছে পথের বাঁকে ,পার্ক ও লেকের জলের বাহারে সাজ ,তাতে  নানা রকমের led   ল্যাম্প দিয়ে সাজানো । শুধু কৃত্রিম আলোক সজ্জায় ভেগাস সেজে ওঠেনি , মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যে পরিপাটি করে সাজানো শহরটি মনের কোণে আপনা থেকেই রেখাপাত করে। ইয়াম হাততালি দিয়ে সুন্দর কে স্বাগত জানায় ,.--ঐ যে অপরূপ প্রস্রবণ তীর তীর করে পাথুরে গা বেয়ে গড়িয়ে চলে  ,অসংখ্য ঝর্ণা ধারার  রূপ নিয়েছে। ঐ যে ফাউন্টেন শ্বেত শুভ্র নৃত্য রতা পরীর মত মাটি ফুঁড়ে  ওপরের দিকে উঠে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। অঢেল নীল জলের লেগুন গুলো দেখেছো শহর কে অনন্য সুন্দর করে কঠিন মরুর বুকে নমনীয় রূপ দিয়েছে। এইসব জায়গার জল গুলো কে বলা হয় গ্রে ওয়াটার বা ধূসর জলের ধারা যা তৈরি করা হয়েছে সিঙ্ক ,বাথটাব কিংবা স্নানঘরের ব্যবহৃত জল কে রাসায়নিক ভাবে প্রক্রিয়াজাত করে। কিন্তু সেই দূষিত জল কে দেখে বোঝার উপায় নেই যে জাস্ট ড্রেনের জল কে কাজে লাগিয়ে শহরের এমন স্বর্গীয় সৌন্দর্য সৃষ্টি করা যায়।  

 মাথার ওপরে গনগনে সূর্যের আলো ঘড়িতে প্রায় একটা। ইয়ামের ব্রেকফাস্ট অনেকক্ষণ হজম হয়ে গিয়েছে।বেচারা লাঞ্চ টাইমের ব্রেকের জন্য হাঁপিয়ে উঠে বলে অতনু ,তোদের ঘড়িতে লাঞ্চ ব্রেকের সময় হয়নি ? অতনুর গলার ভারী গম্ভীর মেজাজে আমি ও বেশ ঘাবড়ে যাই। রাস্তার সাইনবোর্ড ফলো করে বলে আরো আধ ঘন্টার মত সময় তো লাগবেই। অধৈর্য্য হলে চলবে না. নতুন শহর আসতে এখোনো বেশ দেরী আছে। আমার সঞ্চয়ের শুকনো খাবারের ঝোলা খালি হয়ে গিয়েছে। পারভীন কে যাবার বেলায় জলে ভেজা  চোখ মুছিয়ে হাতে কিছু চকলেট গুঁজে দিয়েছিলাম তার ই আর ও অবশিষ্ট গোটা কয়েক উঠে এলো ব্যাগের পরিত্যাক্ত কোণ হাত্ড়ে। ক্ষিদের মুখে তাই অমৃত সমান। ইয়ামের হাতে দিতেই ওর বালিকা সুলভ গাল ভরা হাসি। মনে হলো,মানুষ যতই বড়ো হোক ,শরীরে বেড়ে উঠুক কর্ম ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত হোক না কেন ছোট্ট শিশু মন টা যেন সব সময় তার  ভেতরে অন্তর্নিহিত হয়ে   আজীবন সঙ্গী থাকে। সবার গালেই এখন আমার প্রিয় সানফ্রান্সিসকোর  ঘিরাডেলী কোম্পানীর ক্যাডবেরী চকলেট, সে যেন  ভারী মহার্ঘ্য ,এখন সবাই কে অতিরিক্ত এনার্জী দিচ্ছে।   
🍂

 নেভাদার বিশাল অঞ্চল জুড়ে মরুভূমি। এ রাজ্যের আবহাওয়া তাই বেশ গরম। ঠান্ডার লেশ মাত্র নেই ।   মরুভূমির মধ্যে লাস ভেগাসে গড়ে ওঠার কারণে বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩০০ দিনেই রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়া,থাকে। সূর্য দেব এখানে মেঘের আড়ালে ঢাকা থেকে লুকোচুরি খেলায় কখনো তেমন মাতেন না। এখানে তাই মেঘ বৃষ্টির দৌরাত্ম্যের খেলায় মোটেই হয়রান হতে হয় নি। উম্মুক্ত আকাশে সর্বত্র  তিনি রাজকীয় ভঙ্গিমায় বিরাজ করেন। তবে আমি ওয়েদার রিপোর্ট দেখছিলাম। এক নজরে চোখে পড়লো জুলাই মাসে সবচেয়ে বেশী তাপমাত্রা থাকে। সেই সময়ে এখানের উষ্ণ তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে অনেক সময় ৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠে যায়। আর শীতলতম মাস জানুয়ারি তে লাস ভেগাসের গড় তাপমাত্রা থাকে ১৪ ডিগ্রির মত।  কিন্তু এখন মার্চের মাঝামাঝি  প্রায় ১৮ ডিগ্রী ,সর্বক্ষণ উদাসী বসন্ত বাতাস এলো মেলো বইছে। বেশ রোম্যান্টিক বাতাবরণ। বিশাল বড়ো শিরিষ গাছের মত দেখতে  ঝিরঝিরে পাতাওয়ালা গাছ গুলো থেকে দুধে আলতা রঙের  শিরিষ ফুলের ,কোথাও বা হালকা বেগুনী রঙের ফুলের ঝরা পাপড়ি গুলো চলার পথে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রকৃতির মোহময় সৌন্দর্যে আত্মবিস্মৃত মন কিশোরীর মত ছুটে চলে কল্পনায় গড়াগড়ি দিয়ে বেড়ায় সবুজে মোড়া পাহাড়ের ঢাল গুলোতে।  শহরের ব্যস্ততম এলাকায় আজ জানিনা কি কারণে রাস্তা ঘাট শুনশান ফাঁকা। একটা ভিয়েতনামী রেস্টুরেন্ট সামনে দেখে ব্রতীন গাড়ি পার্কিং করলো ।  

 এখানেও এক স্মরণীয় মজার ঘটনা ঘটলো। রেস্তোরাঁটি তে বলতে গেলে আমরাই বোধহয় আজকের প্রথম অতিথি। প্রায় দুটো বেজে গিয়েছে ,হলঘরটিতে অন্তত কুড়িটা টেবিল পাতা আছে ,কিন্তু ভর দুপুরের লাঞ্চ টাইমে কোনো ভীড় নেই। সারা রেস্তোরাঁটি সাজানো সবুজ দিয়ে। দোকানের সবুজ সাইনবোর্ড এ  ড্রাগনের  ছবি আঁকা ,সবুজ দেওয়াল, জানলা দরজার পর্দা টেবিল ক্লথ সব সবুজ। এমনকি চার জন কর্মচারী সবাই সবুজ ড্রেস পরে আছে। এতো সবুজের সমারোহ আমি ইয়াম দুজনেই হোহো করে জোরে হেসে উঠেছি। আমেরিকার নিয়মে যাকে মোটেই সভ্যতা বলে না তবে সদ্য ভেগাস   হয়ে এসেছি ,তাই বোধহয় বেশ বেপরোয়া।  লাস-ভেগাসের নিয়মে যে সব চলে।  অতনু ও ব্রতীন আশঙ্কা প্রকাশ করে বলে হয়তো খাবারের  রঙ ও সবুজ হবে। পরিষ্কার হিন্দি ভাষায় কর্তব্য রত ভিয়েৎনামী  ছেলেটি বলে  ''নানা কোনো চিন্তা নেই ,রান্নার রং অরিজিনাল কালারেই পাবেন।সাদা ভাত অথবা বাসন্তী পোলাউ ,মিক্সড  ফ্রায়েড রাইস চিকেন কারী ,চিকেন কষা, স্যুপ ভেজিটেবিল চিলি চিকেন চিলি ফিস গোবী মাঞ্চুরিয়ান ইত্যাদি। আমরা অবাক হয়ে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। এযে একেবারে তাজ্জব ঘটনা! আমেরিকায় এই সাত সমুদ্র্র তের নদীর পাড়ে বিদেশীর মুখে হিন্দি ! আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা শুনছি যে , নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
                                                                                      দ্রুত আলাপ জমে ওঠে  ওরা সহজ ছন্দেই বলছে কিশোর কুমার,হেমন্ত মুখার্জি , মহম্মদ রফি সাহেবের গান শুনে ইন্ডিয়াকে ভালবেসেছি। হিন্দি সিনেমা সঞ্জীব কুমারের আঁধি ,শোলে, বারবার দেখি ফেভারিট সিনেমা। ট্রান এবং হোয়াং, অল্প বয়সের ভিয়েতনামী ছেলে দুটোর ইন্ডিয়া সম্বন্ধে জানার কত কৌতূহল ,আগ্রহের যেন শেষ নেই। বলে ,তোমাদের দেখেই বুঝেছি ইন্ডিয়ান।এক অদ্ভুত ভালোলাগা আন্তরিক পরিবেশে মন ভরে উঠলো। লাঞ্চের সময় থেকে আড্ডা শুরু পরেও স্বদেশের এমন গল্প চললো যে মন অপার্থিব আনন্দে ভরে উঠলো। খাবার গুলো চাইনিজ আর ভিয়েতনামী মিক্সড রেসিপি। এক অন্য্ স্বাদের অন্য ঐতিহ্যের বার্তা বহন করে আনছে। 

 ট্রান এবং হোয়াং দুই ভাই উত্তর ভিয়েৎনামের ছেলে। আমেরিকা ভিয়েৎনামের বিধ্বংসী সেই যুদ্ধ বন্দি সৈনিক পিতা কর্নেল সোয়াং ভাগ্য চক্রের নির্মম পরিহাসে অসুস্থ হয়ে এখানেই  আটক থেকে যায়। ওদের মা দিদি ছোট বোন টি কে  রেহাই  দেয়নি নারী দেহ লোভী বুভুক্ষু সৈনিক দল। ওদের ঘর ভেঙেছে স্বপ্ন ধূলিসাৎ করেছে ,মাতৃভূমিকে পায়ে দলে গুড়িয়ে দিয়েছে শত্রু পক্ষ। ট্রান ও হোয়াং কিভাবে  সে যাত্রায় রেহাই পেয়েছিল নিজেরাও জানে না অবশ্য যুদ্ধ মিটে গিয়ে শান্তির পতাকা উড়লে বন্দি পিতা কে খুঁজতে এসে দুইপুত্র এদেশেই অনেক প্রচেষ্টায় হুইলচেয়ার আশ্রিত অসুস্থ অবস্থায় কর্ণেল সোয়াং কে  উদ্ধার করেছিল। কর্ণেলের শেষ আশ্রয় স্থল হয়েছিল  লাস ভেগাসের ঐ আন্ডারগ্রাউন্ড বস্তিতে। পাঁচ বছর রোগ জ্বালা যন্ত্রনা ভোগের পর কর্ণেল মারা গেলে ছেলেদের ও আর স্বদেশে ফেরা হয়নি। ট্রান ও হোয়াংদের এই গল্পটি ও বিরাট , ওদের কথা আজ থাক। হয়তো অন্য কোথাও কোনোদিন লিখতে বসবো। ট্রান ,হোয়াং সেই থেকে নেভাদায়  মিষ্টার লরিয়েল সাহেবের রেস্তোরাঁয় কাজ নিয়েছিল। এই ভিয়েতনামী রেস্তোরাঁর মালিক মিষ্টার লরিয়েলের সবুজ রঙ বিশেষ প্রিয় তাইবুঝি  রেটুরেন্ট টি তে এত সবুজের বাহার।   
                                                                 
 গল্পবাজ  ট্রান গল্প শোনায় , মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রদেশ গুলো বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন কারণে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে তার অন্যতম হচ্ছে নেভাদার এই শহরের মানুষ গুলো এতোবেশী জুয়া আসক্ত যে জুয়ার আসরের জন্য যে কোনো বিষয় নিয়ে বাজি ধরে। ১৯৮০ সালে লাস ভেগাস হাস পাতালের বেশ কিছু কর্মী কে চাকরী থেকে ছাটাই করা হয়েছিল কারণ তারা নাকি হাসপাতালের রুগীদের উপর বাজি ধরতো যে কোন রুগী কখন মারা যাবে। এমন কি কথিত আছে এ শহরে একজন নার্স  বাজিতে  জিতবে বলে পেশেন্ট কে হত্যা পর্যন্ত করেছিল। কি সাংঘাতিক জুয়ার নেশা ! আমার মনে পড়ে ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারতে সেই পৌরাণিক কালে কৌরব পক্ষ জুয়া খেলায় ছলে বলে পান্ডব দের হারিয়ে সর্বশান্ত করার ছক কষেছিল। আর এই আধুনিক যুগের বিশ্বের সেরা মহাদেশে জুয়ায় বাজি জেতার জন্য অসুস্থ কে একেবারে মেরে ফেলা হলো। ধন্য লাস ভেগাস !  ধন্য তোমার এই জুয়ার শহরের জুয়াড়ী দের কান্ড কীর্তি । 
ব্রতীনের মন স্টীয়ারিংএ চোখ রাস্তার দিকে তবুও আমাদের গল্পে যোগ দিয়ে বলে ওর অফিস কলিগ আমেরিকান বনধুদের কাছে শোনা একটি সত্যি ঘটনা। যদিও  আমাদের  ভদ্র সমাজের চোখে জুয়া অনেক বেশী  দৃষ্টি কটু ,চরিত্র হীনতা খারাপ নেশার ব্যাপার। কিন্তু এই পাশ্চাত্য দেশ গুলোতে সে  রকম ব্যাপার নেই। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন কুরিয়ার কোম্পানি FedEx  এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান ফ্রেদরিখ স্মিথ লাস ভেগাসে এসে জুয়া খেলে বাঁচিয়েছিলেন তাঁর কোম্পানিকে। তিনি  জুয়া খেলে নিজের প্রায় ডুবন্ত ,ধারে নিমজ্জিত ভাগ্যতরীকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন। কোম্পানির সর্বশেষ ৫,০০০ ডলার নিয়ে সিন সিটি তে আসেন, সেখানে জুয়া খেলে ২৭,০০০ ডলার জিতে যান যার মধ্য থেকে ২৪,০০০ ডলার তিনি কোম্পানির জ্বালানি বিল দিয়েছিলেন।জুয়া দিয়েই  FedEx এর মত কোম্পানি খ্যাতির শিরোনামে ।   

আমাদের লাস ভেগাস নিয়ে গল্পের শেষ নেই। এর আলোচনা ঠিক মত লিপিবদ্ধ করতে গেলে আর কয়েক শত নতুন পাতা লেখা হয়ে যাবে ভাবছি যখন সে সময় পারভীনের ফোন বেজে উঠলো । আমরা সবাই উৎকর্ণ হয়ে আছি  ও প্রান্ত থেকে ওর গলার আওয়াজ পাওয়ার আশায়। না, রাবেয়ার শরীরের উন্নতির খবর নেই। ও সাংঘাতিক অসুস্থ ,শারীরিক অবস্থা ক্রমশঃ অবনতির দিকে। ওদের গ্রামের প্রতিটি ঘরে এক ছোঁয়াচে অসুখে ভুগছে মানুষ জন। যদিও কেউ জানেনা এ রোগকোথা থেকে কেমন করে হঠ্যৎ  এমন ছড়িয়ে পড়লো। জ্বর কাশি সর্দি শ্বাস কষ্ট গলা ব্যথা শরীরে নানা রকম উপসর্গ থেকে জীবন বিপন্ন হওয়ার জোগাড় ।স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে জানিয়েছে আজই রাবেয়াকে হস্পিটালাইজড করতে হবে। পারভীনের কান্না ভেজা গলায় আর শব্দ শোনা যায় না। আমাদের ও কারো মুখে কোনো ভাষা নেই। (ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments