পর্ব ৯০
শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা
প্রীতম সেনগুপ্ত
বিবেকানন্দের গুডউইন
মানবজাতির কাছে তাঁর বাণীর প্রচারকরূপে শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন পেয়েছিলেন শ্রীম-কে, বিবেকানন্দ তেমনই পেয়েছিলেন পরম আস্থাভাজন ও অনুগত গুডউইনকে। জে জে গুডউইন মাত্র ২৫ বৎসর বয়সে স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ করেন। তিনি ছিলেন পেশাদার শ্রুতিলিপিকার। শুধু তাই নয় শহুরে ও ভয়ানক বিষয়ী গুডউইন ব্রিটিশজাত নীল রক্তের আভিজাত্যে গর্বিত ছিলেন। মাত্র ২৭ বছর বয়সে এই ভারতে তাঁর জীবনাবসান হয়।
১৮৯৫ সালে নিউইয়র্কে বিবেকানন্দ অনুরাগীরা অনুভব করলেন যে, তাঁদের আচার্যের অমূল্য, অসাধারণ বক্তৃতা ও উপদেশ সমূহ সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। শুধুমাত্র তাঁদের নিজেদের জন্য নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও। তাই সংবাদপত্রে তাঁরা একটি ছোট্ট বিজ্ঞাপন দিলেন। ‘শ্রুতিলিপিকার চাই’। আর এই বিজ্ঞাপনটিই গুডউইনকে তাঁর ভাবী জীবনদেবতার কাছে পৌঁছে দিল। গুডউইন স্বামীজীর এই কাজে যে পারিশ্রমিকে নিযুক্ত হলেন, তা তাঁর আগের কর্মস্থলে প্রাপ্ত পারিশ্রমিকের তুলনায় অনেক কম ছিল। তবু তিনি রাজি হলেন কেন? এক্ষেত্রে স্বামীজীর ভালোবাসার অমোঘ শক্তিই কাজ করেছিল। এর চৌম্বকীয় আকর্ষণ উপেক্ষা করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল। স্বামীজীর এই মহত্তম কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। বস্তুতপক্ষে স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা-রূপ যে অমূল্য সম্পদলাভে এই জগৎ ঋদ্ধ হয়েছে তার জন্য সমগ্র মানবজাতি তাঁর কাছে চিরঋণী হয়ে থাকবে।
স্বামীজীর গুরুভ্রাতা স্বামী সারদানন্দজীকে গুডউইন তাঁর নবজীবনের রূপকার বিবেকানন্দ সম্পর্কে বলেছিলেন --“যে দেশে ইংরেজী ভাষা চলে সেই দেশেই ছুটেছি। কি করব, গরিব লোক অল্পবয়স থেকে রোজগারের চেষ্টায় ঘুরতে হয়েছে। মুরুব্বি তো কেউ নেই। অনেক জায়গায় ঘুরলাম, অনেক লোকের সঙ্গে মিশলুম -- সকলেই কাজ করিয়ে নেয়, দামটা দেয়, কিন্তু বুকের ভালবাসাটা কেউ দেয় না। অবশেষে আমেরিকায় স্বামীজীর কাছে জুটলুম। এখানেই প্রাণ থেকে একটা ভালবাসা দেখতে পেলুম। তাই রোজগারপাতি হোক আর না হোক, আটকে তো পড়ে আছি। জগৎ ঘুরে অনেক লোকের সঙ্গে অনেক নামজাদা লোকের কাছে গিয়েছি, কিন্তু স্বামীজীর মতো এমন একটা উচ্চতর লোক পাইনি। আপনার বলে টেনে নিতে এমন আর দুটি দেখি নি।” ( আমার গুডউইন, প্রব্রাজিকা ব্রজপ্রাণা, উদ্বোধন কার্যালয় )
স্বামীজীর বক্তৃতা-দানের নির্ধারিত সূচী ছিল অসম্ভব ব্যস্ততাময়। দেখা যাচ্ছে ৯ থেকে ২৩ ডিসেম্বরের মধ্যে তিনি বক্তৃতা দিয়েছেন দিনে দু'বার করে সপ্তাহে চারদিন। ক্লাস নিয়েছেন সপ্তাহে কুড়িটি, কখনও কখনও তারও বেশি। রবিবারগুলিতে থাকত প্রশ্নোত্তরপর্ব। সকাল-সন্ধ্যা দুবেলায়ই ক্লাস হত। স্বামীজীর সব বক্তৃতাই হত তাৎক্ষণিক। কোনওরকম পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই তিনি বক্তৃতা দান করতেন। সেগুলি সংরক্ষণের কোনও প্রচেষ্টা তাঁর ছিল না। গুডউইনের উপর কাজের বোঝা কীরকম ছিল তা এই বর্ণনা থেকে অনেকটা ধারণা করা যায় --“স্বামীজীর কাজের বোঝা যদি দুর্বহ হয়ে থাকে তাহলে গুডউইনেরও তাই। স্বামীজীর ক্লাসগুলি হত দীর্ঘ এবং তিনি বক্তৃতা দিতেন দ্রুত; কখনও কখনও বাক্য অসম্পূর্ণ রেখে। সকাল-সন্ধ্যা দু-বেলার বক্তৃতাই গুডউইন শর্টহ্যাণ্ডে লিখে রাখতেন; মাঝখানের সময়টুকুতে তিনি টাইপ-করা প্রতিলিপি সম্পূর্ণ করে রাখতেন; তারপর এই প্রতিলিপিগুলি পাঠিয়ে দিতেন মাদ্রাজে ‘ব্রহ্মবাদিন’ পত্রিকায় ( ১৮৯৫ সালের সেপ্টেম্বরে, স্বামীজীর নির্দেশে সবেমাত্র পত্রিকাটি প্রকাশ পেয়েছে )। আলাসিঙ্গাকে লেখা একটি চিঠিতে স্বামীজী জানাচ্ছেন, ‘এইসঙ্গে আমি ভক্তি-যোগের কয়েকটি পৃষ্ঠা এবং কর্ম-যোগের উপর একটি বক্তৃতা অগ্রিম পাঠাচ্ছি। আমি ক্লাসে যা যা বলব তাই লিখে রাখার জন্য ওরা একজন শ্রুতিলিপিকার নিয়োগ করেছে। কাজেই এখন থেকে তোমার লেখার কোন অভাব হবে না।’
জানুয়ারি মাসে নিউইর্য়ক সিটি-র হার্ডম্যান হল-এ রবিবারের দুপুরগুলিতে স্বামীজী সাধারণের জন্য একগুচ্ছ বক্তৃতা দেওয়া শুরু করলেন। এই বক্তৃতাগুলিও গুডউইন প্রথমে শ্রুতিলিখন ও পরে টাইপ করে রাখলেন। এই রবিবাসরীয় পর্যায়ে স্বামীজীর প্রথম বক্তৃতা ‘দ্য ক্লেমস অব রিলিজিয়ন; ইটস ট্রুথ অ্যাণ্ড ইউনিটি’। দ্বিতীয়টি, ‘দ্য আইডিয়াল অব আ ইউনিভর্সাল রিলিজিয়ন’। পুস্তিকাকারে প্রকাশিত এটাই স্বামীজীর প্রথম বক্তৃতা। এইসব মুদ্রিত পুস্তিকার ব্যয় বহন করত নিউ ইয়র্ক বেদান্ত সমিতি। এর স্বত্বাধিকারীও ছিল তারা। নিউ ইয়র্ক বেদান্ত সমিতির কর্মকর্তাগণ নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে ছাপার খরচ মেটাতেন আর গুডউইনকে যৎসামান্য পারিশ্রমিক দিতেন। গুডউইন ভাষণের শ্রুতিলিপি করে নিতেন এবং পরে দ্রুত খসড়াটি টাইপ করে ফেলতেন, তারপর এই খসড়াটি সম্পাদনা করতেন। মিস ওয়াল্ডো এবং স্বামীজী তা যত্ন করে পড়ে দিতেন। পুরো ব্যাপারটা মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে সম্পন্ন হয়ে যেত। পুস্তিকাগুলি ১০ সেন্ট দামে বিক্রি হতো। পাওয়া যেত পরের সপ্তাহের বক্তৃতার সময়। পরের দুটি রবিবারে স্বামীজী বললেন, ‘দ্য কসমসঃ দ্য ম্যাক্রোকোজম’, এবং ‘দ্য কসমসঃ দ্য মাইক্রোকজম’। এই দুটি বক্তৃতা ‘জগৎ’ নামে একটি বৃহত্তর পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। আগের মতো এখানেও সেই একই পদ্ধতি অনুসরণ করে পুস্তিকাটি তৈরি করা হয়েছিল।
জানুয়ারির মাঝামাঝি স্বামীজী তাঁর ‘কর্মযোগ’-এর ক্লাস শেষ করে ফেললেন। ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রকাশের উপযুক্ত হয়ে মুদ্রকের কাছে চলে যায়।
...‘জ্ঞানযোগ’-এর ক্লাসগুলিতে স্বামীজী যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেগুলিই পরবর্তীকালে ‘ধর্মবিজ্ঞান ও দর্শন’ নামে প্রকাশিত হয়।
🍂
যে রচনা আজ আমাদের কাছে ‘রাজযোগ’ নামে পরিচিত, তার প্রথম আটটি অধ্যায় নবাগত শিক্ষার্থীদের নিকট প্রদত্ত স্বামীজীর ‘রাজযোগ’ বিষয়ক গৌরচন্দ্রিকার প্রতিলিপি। ‘পতঞ্জলির যোগসূত্রের’ অনুবাদ করতে মনস্থ করে স্বামীজী এই প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্র মুখে মুখে অনুবাদ করে এবং সেই সঙ্গে নিজস্ব ব্যাখ্যা যোগ করে মিস ওয়াল্ডোকে শুনিয়েছিলেন। ‘রাজযোগ’-এর অন্তর্গত ‘যোগসূত্র’ অংশটি মিস ওয়াল্ডোকে প্রদত্ত মৌখিক পাঠ এবং ‘রাজযোগ’- এর ক্লাসে প্রদত্ত স্বামীজীর মূল বক্তৃতার গুডউইন-কৃত প্রতিলিপির একত্রিত রূপ। ‘কর্মযোগ’-এর অব্যবহিত পরেই ‘রাজযোগ’ মুদ্রিত হয়।“ ( আমার গুডউইন, প্রব্রাজিকা ব্রজপ্রাণা, উদ্বোধন কার্যালয়)
0 Comments