বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক সুশীল কুমার দে
নির্মল বর্মন
অধ্যাপক ড. সুশীল কুমার দে লন্ডন স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডিজে সংস্কৃত অলংকার সাহিত্যের ইতিহাসের উপর রিসার্চ করে পৃথিবীর সর্বোচ্চ ডিগ্রি "ডি.লিট" উপাধি পান। বাংলা,ইংরেজি ও সংস্কৃত সাহিত্যে ভরপুর অভিজ্ঞ , প্রাবন্ধিক ও সমালোচক সুশীল কুমার দে ডা. সতীশ চন্দ্র দে'র সন্তান । ড.সুশীল কুমার দে কটকের Revenshaw কলিজিয়েট স্কুল থেকে বৃত্তিসহ Entrance পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে পাশ করে ১৯০৭ সালে এফ.এ পাশ করার পর ঐ কলেজ থেকেই ১৯০৯ সালে ইংরেজি অনার্স সহ প্রথম শ্রেণী তে বি.এ পাশ করেন। ১৯১১ তে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ পাশ করেন। প্রথমেই প্রেসিডেন্সি কলেজেই ইংরেজি অধ্যাপক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯১৩ থেকে ১৯২৩ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি, ভারতীয় ভাষা এবং সংস্কৃতের লেকচারার হিসাবে কাজকর্ম করেছিলেন। ১৯২৩ এ প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি রীডার ও সংস্কৃতের প্রধান অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেছিলেন। এবং ১৯৪৭ এ অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের পর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রধান ছিলেন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং লেকচারার ছিলেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পুঁথি সংগ্রহের উপর সুশীল কুমার দে'র অবদান অনস্বীকার্য।তিনি প্রায় দশ হাজার টাকায় কুড়ি হাজার পুঁথি সংগ্রহ করেছিলেন। পুঁথি সর্বোচ্চ সংখ্যা ২৫ হাজার। অন্য কোন ক্ষেত্রে তিনি "প্রেম মুকুল জানা" এবং শান্তশিব গাজনদার ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন যা বাংলা সাহিত্যের বিরল দৃষ্টান্ত ।
🍂
সাহিত্যিক সুশীল কুমার দে মহোদয়ের গ্রন্থ সমূহ:-
মূলত ইংরেজি গ্রন্থের সংখ্যা যথেষ্ট বেশি পরিমাণ ছিল। সেগুলো হল:-Studies in the History of Sanskrit poetics" (1,11,1923,1925), Bengali Literature in the 19th century" , "History of Sanskrit Literature" 1947, "Early History of Vaishnava Faith and Movement in Bengal"i , "Treatment of love in Sanskrit " ।
অধ্যাপক সুশীল কুমার দে বাংলা ভাষাতেও বেশ কয়েকটি বই রয়েছে। যেমন---
"কাব্যলীলায়তা"- ১৯৩৪, "প্রাকতনী" ১৩৪১, "অদ্যতনী" ১৩৪৮, "ক্ষণদীপিকা" ,১৩৫৫, "সায়ন্তনী" ১৩৬১, "বাংলা প্রবাদ" ১৩৫২, "নানা নিবন্ধ" ১৩৬০।
প্রাবন্ধিক সুশীল কুমার দে মহাভারত সহ আটটি গ্রন্থের তিনি সম্পাদনা করেছেন। সম্মানীয় প্রাবন্ধিকের প্রবন্ধ গুলি "সাহিত্য পরিষদ", "প্রবাসী", "প্রগতি", "শনিবারের চিঠি", "বঙ্গশ্রী", ও "মাসিক বসুমতি" ইত্যাদি পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছিল।
সুশীল কুমার দে সংস্কৃত সাহিত্য ও অলংকার শাস্ত্রের ইতিহাস রচনা ও তথ্য বিশ্লেষণে, জগৎজোড়া নাম কুড়িয়েছেন। বাংলা বৈষ্ণব ধর্মের প্রামাণ্য তথ্যপূর্ণ ইতিহাস তার বিশেষ কীর্তি। বিজ্ঞানসম্মতভাবে সংস্কৃত সাহিত্যের চর্চা সুশীল কুমার দে পাশ্চাত্য পন্ডিতদের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। বিজ্ঞানসম্মত ও পাশ্চাত্য ভাবনায় 'পুঁথির পাঠ'কাল, উৎস ইত্যাদির নির্ণয়, শিলা লেখ, কুলজি, মুদ্রা ইত্যাদি প্রদানের সাক্ষ্য আমরা জানতে পারি। রাজেন্দ্রলাল মিত্র ও হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বিঞ্জানসম্মত ধারা অনুসরণ করেছিলেন। এই মহান ব্যক্তিদের উত্তরসূরী হলেন অধ্যাপক সুশীল কুমার দে।
সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য ও অলংকার শাস্ত্রে আলংকারিক কুন্তকের মৌলিকতা যেমন তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন তেমনি ধ্বন্যালোক এর অভিনব গুপ্ত রচিত লোচন টীকার সম্পাদনা ও তিনি যত্ন সহকারে করেছিলেন । বৈষ্ণব সাহিত্য, ধর্ম তত্ত্ব নিয়ে তিনি প্রবন্ধ নিবন্ধ রচনা করেছেন।
প্রাবন্ধিক সুশীল কুমার দে বাংলার লোকজীবন সম্বন্ধে গভীর আগ্রহ ও ব্যুৎপত্তি থাকার ফলে যত্ন সহকারে "বাংলা প্রবাদ"গ্রন্থটি বিনির্মাণ করেছেন। বাংলা ভাষায় প্রচলিত প্রবাদ গুলি কে লৌকিক জীবনের স্বাভাবিকতা গতিশীলতার পথিক হিসেবে পরিচিত দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে স্বয়ং প্রাবন্ধিক বলেছেন--
----"অসংখ্য প্রবাদ বা প্রবাদের টুকরা, বাংলা Idiom বা বাক্যরীতিতে অবাধে মিশিয়া গিয়া ভাষার ভিত্তিমূল গঠিত করিয়াছে"।
সাহিত্যিক সুশীল কুমার দে'র "নানা নিবন্ধ" গ্রন্থটিতে ১৯টি প্রবন্ধ--- যেগুলি প্রাচীন ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে নানাভাবে সমন্বিত। এই প্রবন্ধ গুলি প্রকাশিত হয়েছে সংস্কৃত সাহিত্য ও ভারতীয় রসশাস্ত্র' প্রতি তার নিষ্ঠার ও গভীর অধ্যয়নের ফলশ্রুতি।
"জয়দেব ও গীতগোবিন্দ" প্রবন্ধে স্বয়ং প্রাবন্ধিকের মন্তব্য পরিধানযোগ্য-----
"কবির রাধা শুধু কল্পলোকের কল্পনারূপিণী নহেন, তাঁহার সমস্ত অনুভূতি ও প্রীতির বাস্তব লক্ষ্মী"!
সমালোচক সুশীল কুমার দে সমালোচনার ক্ষেত্রে মোহিতলালদের মতন রক্ষণশীল। ব্যক্তি মনের রোমান্টিক প্রকাশের ধরনটি আদৌ পছন্দ করতেন না রোহিনী প্রবন্ধে রোহিনী"র কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে, লিখে ফেলেছেন---
" ইংরেজিতে যাকে more sinned against than sinning"বলে, হতভাগ্য রোহিনী তাহার শোচনীয় নিদর্শন"!
0 Comments